আগ্রা ঘরানার গায়কি নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : আগ্রা ঘরানা (Agra Gharana ) কিরানা ঘরানার বিস্তার গান নয় ধ্যান, contemplative mood-এর সঙ্গীত। এই বিস্তার এনে খেয়ালের ভোল পালটে দিলেন আবদুল করিম। আমাদের মার্গসঙ্গীতে এই বিপ্লব আনার জন্য আমি ওঁকে রোম্যান্টিক বলেছি সেটা শুধু ওর lyrical style-এর জন্য নয়। যে অর্থে চারুকলা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে form-এর ঠিক পরিবর্তন ঘটানোর কারণে রোম্যান্টিক মুভমেন্টের উল্লেখ করা হয়, সেই অর্থে। সঠিক এই কারণেই ফৈয়াজ খাঁকে বলব neoclassicist।
আগ্রা ঘরানার গায়কি বলতে যদি ফৈয়াজ খাঁর গায়কি বোঝায় তো স্বীকার করতে হয় এর মধ্যে খেয়ালের অষ্টাঙ্গর কোনওটাই বাদ যায়নি। গোয়ালিয়রের সঙ্গে আগ্রার ঘনিষ্ঠতা বহু কালের। আকবর বাদশাহর সময় মিয়াঁ তানসেন ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক, দু নম্বর আগ্রা ঘরানার হাজি সুজান খাঁ।

নথন পীর বখ্শ, আল্লাদিয়া খাঁর বয়ান অনুযায়ী ধ্রুপদ শিখেছিলেন শ্যামরঙ্গের কাছে, কিন্তু অন্যত্র আমি লিখেছি কিভাবে ঘগ্গে খুদা বখ্শ খেয়াল আমদানি করেন নথুথ্থন পীর বখশের কাছে এক আধ বছর নয় চোদ্দো বছর তালিম হাসিল করে। এর ফলে ড. এম. আর. গৌতমের মতে ফৈয়াজ খাঁর গানের মধ্যে যত গোয়ালিয়র ছিল, নথুথুন খাঁ বা তাঁর ছেলেপুলেদের অর্থাৎ আবদুল্লা খাঁ, বিলায়েৎ হুসেন খাঁ কারও গানে তা পাওয়া যায়নি।
গোয়ালিয়রে রাগ বিস্তারের অভাব বোধে ফৈয়াজ খাঁ ধ্রুপদের নোম্তোম জুড়ে দিলেন। গোড়ায় গোড়ায় তারপর ধামার গেয়ে খেয়ালে আসতেন, পরে সোজা মধ্যবিলম্বিত লয়ে খেয়াল ধরতেন, বন্দিশ নায়কি অঙ্গে। বন্দিশে ওঁর গায়কি অঙ্গ বোল বানানোর জন্য বিখ্যাত। এর পর আসত বহলাওয়া যার অপূর্ব নিদর্শন রয়েছে আমার কাছে রেডিওর খাজানা থেকে উদ্ধার করা কামোদ ও হাম্বিরের পনেরো পনেরো মিনিটের খেয়ালে। ভারী লরজদার তান থাকত এই সঙ্গে।

ধ্রুপদ ধামারের ঐতিহ্যে লালিত ফৈয়াজ খাঁর বোলবাট লয়কারী আগ্রা ঘরানায় বরাবরের মতো কায়েম হয়ে যায়। বিলায়েৎ হুসেন ও খাদিম হুসেন খাঁ যুগলবন্দি গাইতেন ধামার ও খেয়ালের, এক দিকে পখাবজ ও অন্য দিকে তবলা নিয়ে, শয়ে শয়ে মরাঠিরা শুনত। কলকাতায় এককালে বেতিয়া ও বিষ্ণুপুর ঘরানার মিলন হয়েছিল, সেই শহরে এখন ধ্রুপদের সরল গাম্ভীর্য ও ধামারের লয়কারী মোটামুটি উবে গেছে এক আমাদেরই নিজস্ব বাঙালি ফাল্গুনী মিত্রর গানে ছাড়া।
খেয়ালেও শরাফৎ হুসেনের মৃত্যুর পর এ অঙ্গ দুষ্প্রাপ্য। ছোট খেয়ালে ফৈয়াজ খাঁর দান কাওয়ালির অনুকরণে বোল বানানো এবং ছোট ছোট ফিকরার সহকারে বন্দিশের মুখড়ায় আসা। এতে বন্দিশের মজা পাওয়া যায় এবং আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে খেয়াল গানও গান, তানবাজি ও সার্গমের ফুলঝুরি নয়।

জয়পুর গায়কির প্রসঙ্গে বলেছি কিভাবে তানেতে ধ্রুপদী আল্লাদিয়া খাঁর স্বর সংযোজন করেছিলেন মিড়ের দ্বারা। ফৈয়াজ খাঁর তানেতে হলক ও গমকের প্রাধান্য বেশি কারণ ধ্রুপদীরা সেই ভাবেই জোড় ও জমজমার কাজ করতেন, শুধু তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহার হত, খেয়ালের তানে স্বরবর্ণের।
আগ্রার ঘরে জয়পুরের মতো জটিল অথচ সুন্দর নকশার কাজ পাওয়া যায় না বটে কিন্তু ডবল ডবল বা তিন তিন স্বরের ব্যবহার করার পদ্ধতি এই দুটি ঘরেই আছে। উদ্দেশ্য, রাগের রূপ যাতে কায়েম থাকে তানকর্তবেও। জোহরা বাঈয়ের রেকর্ডে ছাড়া আমি আগ্রার উদ্ভাদয়ের কাছে সার্গম বড় একটা শুনিনি। ওঁর সম্পর্কে আমি লিখেছিলাম ইনি কল্লন খাঁ ও মেহবুব খাঁ দরস পিয়ার শিষ্যা ছিলেন।

পরে জানতে পেরেছি ইনি তালিম পেয়েছিলেন ঘগ্গে খুদাবখশের ভাইপো শের খাঁর কাছে দরস পিয়ার কাছে যাওয়ার পূর্বে। খেয়াল ছাড়া ঠুমরির তালিমও দেন দরস পিয়া। আল্লাদিয়া খাঁর আত্মজীবনীতে দরস পিয়ার ঠুমরির প্রতি অনুরাগ এবং বন্দিশ তৈরি করার খবর পড়ে বিস্মিত ও চমৎকৃত হয়েছি। এটা ঠিক, দরস পিয়ার জামাই ফৈয়াজ খাঁর পূর্বে মায়ূফিলে কোনও আগ্রার উদ্ভাদ ঠুমরি গাননি। কিন্তু শ্বশুর যে ঠুমরির অনুরাগী ছিলেন এ তথ্য আমার কাছে একেবারেই নতুন।

খেয়ালের নবম অঙ্গ ‘সার্গম’ আমি চার প্রকারের শুনেছি। শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর সার্গম করতেন রাগাঙ্গ তুলে ধরার জন্য। পাতিয়ালার সার্গমের ভিত্ পালটার ওপর। নিসার হুসেন খাঁরও তাই। আমীর খাঁর সার্গম সম্পূর্ণ সৃষ্টিছাড়া, মিরখণ্ড ও ছুটের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তার বৈশিষ্ট্য তার unpredictability।
ড. অশোক রানাডে লিখেছেন আবদুল করিম খাঁ কর্ণটকী সঙ্গীত থেকে সার্গম ধার করেছিলেন তবে দক্ষিণী গমককে বাদ দিয়ে। ভিত্তিবাজারের আমান আলি খাঁও (হংসধ্বনি ‘লাগি লগন’ গান যাঁর তৈরি) করেছিলেন যাঁর প্রভাব আমীর খাঁর ওপরও পড়েছিল। কিন্তু তা সৌকুমার্যের এই পর্যায়ে পৌঁছয়নি। আবদুল করিমের ‘পিয়া বিন নহি আওত চৈন’, দেবগান্ধার বা বিলাবলের রেকর্ড শুনলে মনে হয় এ রকম ঝুটঝামেলা বর্জিত সুরেলা সার্গমই এই নবম অঙ্গর পরাকাষ্ঠা।

খেয়ালে বিভিন্ন ঘরানার শৈলী ও অষ্টাঙ্গের আলোচনার মূল উদ্দেশ্য দুটি। এক, সব ঘরানারই মূল তত্ত্বের মধ্যে প্রভেদ নেই, আছে শব্দতত্ত্বে এবং স্টাইলে। ক্রিকেটে খেয়ালের আট-নটি অঙ্গর মতো সব ব্যাটসম্যানের হাতে আছে ড্রাইভ কাট হক পুল সুইপ মাদ ইত্যাদি কিন্তু ডন ব্র্যাডম্যানের চেয়ে আকর্ষক ব্যাটিং করেছেন তাঁর সতীর্থ আর্চি জ্যাকসন। মার্চেন্টের চেয়ে মুতাক আলির খেলা আরও দর্শনীয় ছিল। গাভাস্করের চেয়ে গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের। পার্থক্য শুধু ব্যক্তিত্ব এবং স্টাইলের।

অতএব আমার মতে ঘরানা নিয়ে মারামারি করার কোনও প্রয়োজন নেই আবার উপেক্ষাও করা উচিত নয়। উঠতি গায়ক বা বাদকের উচিত সব ঘরানারই গানবাজনা শোনা, বিশেষ করে বিগত দিনের মহাপুরুষদের রেকর্ড ও টেপ। আজকের দিনে ঘরানার গোঁড়ামি অসমাজতাত্ত্বিক, কারণ সব ঘরানারই সিংহদরজা ভেঙে পড়েছে, রেডিও টেপ রেকর্ডার এবং কনফারেন্সের দৌলতে।
crossfertilisation সঙ্গীতের ক্ষেত্রে হতে বাধ্য। সব নামকরা উদ্ভাদই শুধু গুরুর পাখি পড়ানো মুখস্থ করে বড় হয়নি। ভাস্কর বুমার চার শুরু : কিরানার বন্দে আলি খাঁ, বরোদার ফয়েজ মুহম্মদ, আগ্রার নথথন খাঁ এবং জয়পুর ঘরানার প্রবর্তক আল্লাদিয়া খাঁ। ফৈয়াজ খাঁর ওপর তানরস যাঁর প্রভাব উনি পনেরো মিনিটের একটি মারওয়ার খেয়ালে প্রদর্শন করেন যা আমার কাছে আছে।

শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর মিলিয়েছিলেন আগ্রা ও গোয়ালিয়র। নিসার হুসেন খাঁও তাই। তারাপদ চক্রবর্তীর গানে ফৈয়াজ খাঁ ও আবদুল করিমের আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী স্টাইলের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। প্রশ্ন শুধু ওঠে কে এপ্রকার কর্ম করছে এবং তার আধার ও তালিম কি প্রকার।

দ্বিতীয় কারণ আলোচনার : এই অঞ্চলে একটি ফরম্যাট বহু পরিমাণে চালু হয়েছে সেটি বড়ই বৈচিত্র্যহীন, একঘেয়ে এবং বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষাবিমুখতার নিদর্শন। তাতে তিনটি মাত্র অঙ্গ আছে। প্রথমে ভাতখণ্ডের বই খুলে বা গুরুর কাছে শেখা বা একটি বিলম্বিত খেয়ালের আধুনিক বানানো বন্দিশ কোনওরকমে দায়সারাভাবে গাওয়া। তারপরে রাগের স্বরবিস্তার, (রাগাঙ্গের বিস্তার নয়) কারণ একাধিক পুরনো কালের বন্দিশ জানা না থাকলে রাগাঙ্গের খোঁজ পাওয়া যায় না।
এই কারণেই সব ঘরানাতেই প্রতি রাগের একাধিক ধ্রুপদ ধামার সে-কালে শেখানো হত। ফলে এই হয় এ ধরনের গায়ক এখন সুর গান, রাগ গান না। তারপর আসে বিলম্বিত ও দ্রুত সার্গম, এবং সেইগুলিরই পুনরাবৃত্তি তানে। এটি যদি আমীর খাঁর স্টাইলের অপটু অনুকরণ হয় তা হলে মানতে হবে অমীর খাঁকে এ তল্লাটে কেউ বুঝল না। যে কোনও কম্পিটিশনে জজিয়তি করতে হলে বা নিয়মিত রেডিও শুনলে এই প্রকারের গায়কির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হবে।
অবশ্য আমি মুম্বই অঞ্চলের বা মহারাষ্ট্রর কথা বলছি না, সেখানে এখনও সব ঘরানারই কদর আছে। বিভিন্ন ঘরানার শৈলী ও খেয়ালের আট নটি অঙ্গ এখন বেশির ভাগ উঠতি গায়কের কাছে অর্থহীন। তবুও ক্ষীণ আশা আছে একটি জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে দু-চারজন সিরিয়াস সঙ্গীতের স্কলারের কাছে এ বার্তা হয়তো পৌঁছবে যাঁদের প্রয়োজনে আমি খুশি হয়ে গান রেকর্ড ও টেপের থেকে আমার বক্তব্যের সমর্থনে বহু উদাহরণ পেশ করতে পারি। ফলাফলের জন্য দায়ী কলিযুগ ও ঈশ্বর।
[ আগ্রা ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]
আরও পড়ুন: