জয়পুর ঘরানার গায়কি বিষয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : এই গায়কির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গেলে মনে রাখতে হবে আল্লাদিয়া খাঁর পিতা খাজা আহমদ খাঁ এবং কাকা জাহাঙ্গির খাঁ প্রধানত ধ্রুপদী ছিলেন। আল্লাদিয়া খাঁ সাহেবের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে বড়ে মুবারক আলি খাঁ সাহেবের। ওঁর গান না শোনবার সুযোগ পেলে আল্লাদিয়া খাঁ খেয়ালের দিকে ঝুঁকতেন কিনা সন্দেহ। তবে উনি এমন এক যুগের মানুষ যখন মোড়ে মোড়ে বড় বড় উদ্ভাদ পাওয়া যেত।
সে সময়ে যুগপৎ খেয়ালী এবং ধ্রুপদী হিসেবে নাম কেনা বড় সহজ কর্ম ছিল না। আমার চোখে এঁকে স্বচ্ছন্দে জিনিয়াস বলা চলে। কারণ ওঁর মহৎ কর্ম ঐতিহ্য ও পরম্পরার গণ্ডি না ডিঙোবার চেষ্টা করে একটি স্বতন্ত্র গায়কি এবং ঘরানার সৃষ্টি করা এবং নিজের জীবদ্দশায় উনি ওঁর তৈরি করা গায়কি ও ঘরানার রমরমা ও জনপ্রিয়তা দেখে গেছেন।
অন্যত্র আমি লিখেছি রাজস্থানের একটি ছোট রিয়াসত ‘আমলেটা’ থেকে আল্লাদিয়া খাঁর ডাক আসে। এখানকার রাজা ধ্রুপদ ধামার ভালবাসতেন, খেয়ালেরও শখ ছিল। সাত দিন সাত রাত্রি আমলেটার দরবারে গান করে খাঁ সাহেবের গলা সাংঘাতিক বসে যায় এবং দু বছর ধরে ক্রমান্বয়ে উনি গলা নিয়ে ভোগেন। ধ্রুপদ থেকে বেরিয়ে খেয়াল আশ্রয় করার প্রধান কারণ সম্ভবত তাই।
আল্লাদিয়া খাঁর আত্মজীবনীতে দেখছি উনি খেয়াল বরাবরই গাইতেন। দিল্লির মিরচ খাঁ তখন নামকরা সারেঙ্গি বাজিয়ে। তিনি হজরত নিজামুদ্দিনের দরগায় বসে দিবারাত্র অসাধারণ পরিশ্রম করে স্বপ্নে পীরের আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। রেয়াজ করে করে বাঁ হাতের আঙুলগুলি বরাবরের মতো বেঁকে গিয়েছিল। আল্লাদিয়া খাঁর মতে কিছু রাগ যার মধ্যে ওঁর স্মৃতিতে কামোদ নট ওঁর মতো উনি সারেঙ্গিতে বা গলায় কারও কাছে জীবনে শোনেননি। যোধপুরের দরবারে নাজির খাঁর সঙ্গে উনি অসাধারণ সঙ্গত করেছিলেন।
নাজির খাঁর গান শেষ হলে আল্লাদিয়া খাঁ গাইতে বসেন মহারাজার হুকুমে। যাই গান, মিরচ খাঁ তাই ছেপে দেন সারেঙ্গিতে, জটিল ফিকা এবং ফিরত্ সবই তাঁর কাছে জলভাত। অবশেষে এমনই একটি জটিল ওজনদার তান মারলেন আল্লাদিয়া খাঁ যে মিরচ খাঁ সারেঙ্গি নামিয়ে রাখলেন এবং মহারাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সরকার, আল্লাদিয়ার সঙ্গে সঙ্গত করা আমার কর্ম নয়, এঁর গায়কি এবং তান এতই জোরকস এবং পেঁচিলা যে ঠিক ঠিক সারেঙ্গিতে বার করতে গেলে আমার আঙুল ভেঙে যাবে।
নাজির খাঁর মতো উদ্ভাদদের গিলে খেতে পারে মিরচ খাঁ, কিন্তু আল্লাদিয়ার ব্যাপার আলাদা, এ ক্ষণজন্মা গায়ক।” এ প্রকারের একাধিক গল্প ওঁর আত্মজীবনীতে আছে তা ওঁর বিনয়গুণের পরিচায়ক না হতে পারে কিন্তু বুঝতে অসুবিধে হয় না ওঁর খেয়াল বড়ে মুবারক আলির গায়কিকেই অনুসরণ করেছিল।
রাজস্থানে যোধপুর, জয়পুর, আমলেটা, জাওরা, রলম এবং ইন্দোরে সর্বত্রই উনি প্রধানত খেয়ালই গেয়েছিলেন। সে সময়ের বর্ণনায় উনি বলছেন তানরস খাঁ, হদ্দু খাঁ এবং মুবারক আলি খাঁ এঁরা তখন সঙ্গীতজগতের ত্রিমূর্তি। খানদানি উস্তাদরা হদ্দু খাঁকে তত সম্মান দিত না কারণ উনি ঘর ছেড়ে বড়ে মহম্মদ খাঁর তানপ্রধান গায়কি অনুসরণ করার চেষ্টায় ওঁর গানে সিলসিলা এবং রাগদারির অভাব লক্ষ করা যেত।
অর্থাৎ হদ্দু খাঁ বাপ পিতামহর ভারী চালের খেয়াল ছেড়ে তানবাজির নেশায় মেতে গিয়েছিলেন। নাথুথু খাঁর গানে শাস্ত্রীয় সৌন্দর্য ছিল এবং উনি হদ্দু খাঁর ছেলে ছোটে মহম্মদ খাঁকে শেখান। অন্য ছেলে রহমৎ খাঁ সম্পর্কে আল্লাদিয়া খাঁ বলেছেন, তাঁর গান অসাধারণ সুরেলা এবং সৌন্দর্যে ভরপুর। তান জটিল না হলেও অতি সুশ্রাব্য। নাথুথু খাঁর দৌহিত্র বড়ে নিসার হুসেন খাঁরও উনি তারিফ করেছেন যাঁর শিষ্য ছিলেন শঙ্কর পণ্ডিত, সেই উস্তাদ, যিনি বেঙ্গলের গভর্নরকে বড়হংস রাগে ‘গড সেভ দা কিং’ শুনিয়ে আস্ত একটি ট্যাকঘড়ি এবং ভারত ভ্রমণের জন্য রেলে সেকেন্ড ক্লাসের ফ্রি পাস পেয়েছিলেন—–এ কাহিনী আমি লিখেছি ‘কুব্রত রঙ্গিবিরঙ্গী’তে।
আল্লাদিয়া খাঁর গলা যৌবনে খুবই ভাল ছিল। আমলেটার পর গলায় সে তাসির আর উনি ফিরে পাননি। ফলে ওঁর মনোযোগ গেল ফিকরাবন্দি এবং জটিল তানের প্যাটার্নের দিকে। ওঁর নিজের তৈরি করা গায়কির মধ্যে ঐতিহ্যর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে উনি এমনই এক স্বাতন্ত্র্যর নমুনা দিয়েছেন যে অন্য কোনও ঘরানার গানে সুর লয় এবং রাগের এমন অসাধারণ মেলবন্ধন পাওয় যায় না।
আল্লাদিয়া খাঁর এই গায়কির বিবর্তন একদিনে হয়নি, ফলে ওঁর ঘরানার বিভিন্ন নামকরা শাগীদদের গানে কিছু কিছু ফরক আছে। কেসরবাঈয়ের তানের প্যাটার্ন আর মল্লিকার্জুন মনসুরের তানের নকশা এক নয়। নিবৃত্তিবুয়ার তানে পার্থক্য আরও বেশি। তবে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি এঁদের সকলের গানেই পাওয়া যায়।
১) এটি প্রধানত তানপ্রধান গায়কি। গোয়ালিয়রের মতো বিস্তার এতে ন্যূনতম। ধ্রুপদী বিস্তার দূরে থাক, এর বিস্তারে ক্রমের অভাব অর্থাৎ বহলাওয়া ক্রমান্বয়ে স্বরের সিঁড়ি ভেঙে চলে না, এই প্রকার বহলাওয়া যা হয় তা বন্দ্দেশকে আশ্রয় করে করা হয় এবং এর বহুলাওয়া তানেরই পূর্বাভাস।
২) ধ্রুপদীরা খেয়ালিয়াদের বেসুরো বলেন, কারণ খেয়ালে তাঁদের ধারণা লম্বা মিড়ের অভাব। যেহেতু তার চরিত্র চঞ্চল সে জন্য খেয়ালে শ্রুতির স্থান বিপন্ন। তার চেয়েও বড় কথা তানবাজি রাগরূপকে পদে পদে ব্যাহত করে। আমাদের রাগসঙ্গীতে আমরা এক পর্দা থেকে আর এক পর্দায় লাফিয়ে যাই না, ভেসে যাই। মিড় এবং শ্রুতি আমাদের মার্গসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য যা অন্যান্য দেশের সঙ্গীত থেকে আমাদের পৃথক করে রেখেছে।
ধ্রুপদীরা তান করেন না কিন্তু দ্রুত জোড়ের কাজে গমক দিয়ে পর্দাগুলিকে জুড়ে দেন। আল্লাদিয়া খাঁর ঘরের তান তাই বহলাওয়ারই রূপান্তর, অর্থাৎ বহলাওয়ার স্পিড বাড়িয়ে দিলে যে ধরনের তান হবে তাতে দানা থাকবে না, পর্দাগুলির সংযোজন হবে মিড়ের দ্বারা। এর মূল নীতি সারে সারে, রেগা রেগা, গমগম এইভাবে তানকে তৈরি করে প্যাটার্ন বোনা হয়।
৩) এটি কিছু নতুন কথা নয়। গোয়ালিয়র গায়কিতেও তানের দানা বাদ দিয়ে মিড়ের দ্বারা স্বর সংযোজন করার রেওয়াজ আছে যা বহলাওয়ার পরের লজিকাল স্টেপ। তফাত জয়পুর গায়কির সঙ্গে যা তা তানের প্যাটার্নে। একহারা তানে রাগভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা বেশি বলে ডবল ডবল পর্দা লাগানো চালু করে আগ্রা এবং জয়পুর। এর ফলে যত শক্ত বা সঙ্কীর্ণ রাগই হোক না কেন রাগরূপ অক্ষুণ্ণ থাকে তানের বিস্তারে। নিবৃত্তি বুয়া কখনও পাঁচ পাঁচ, কখনও চার চার, কখনও তিন তিন স্বরের কম্বিনেশন করতেন তানে কিন্তু লয়ের বা তালের ছন্দকে কাটতেন না। যা করতেন রজব আলি খাঁ।
৪) জয়পুর গায়কিতে লয় আছে কিন্তু তালের চরিত্রর প্রতি দৃষ্টি একেবারেই দেওয়া হয় না। বিলম্বিত তিনতালের যে লয়, বিলম্বিত ঝাঁপতালেরও সেই লয়, রূপকেরও তাই। আল্লাদিয়া খাঁ নিজে ধ্রুপদী বলে ‘বীট’ বা মাত্রার ওপর জোর দিয়েছেন, তানও ছন্দপ্রধান কিন্তু সে ছন্দ একই ধরনের। তান সেখানে মাত্রার ওপর জোর দেয়, অনেকটা বিলম্বিত তিন তালে তবলার খানাপুরির মতো কিন্তু তালের চাল বা মজা এঁদের গায়কিতে নেই।
বন্দিশেও নেই, যদিও জয়পুর গায়কিও গোয়ালিয়র আগ্রার মতোই বন্দিশকে আলিঙ্গন করে চলে। জয়পুর ঘরানার গায়কদের উপর্যুক্ত তিন চারটি তালের বাইরে গাইতে শুনিনি। গোয়ালিয়রের পছন্দসই তাল মধ্য বিলম্বিতে ঝুমরা ও তিলবাড়া, দ্রুতে তিনতাল আড়াচৌতাল, ঝাঁপতাল ও একতাল, ক্বচিৎ কদাচ পঞ্চমসওয়ারী। জয়পুরীয়ারা লয়দার হলেও লড়ন্ত লয়কারী তেহাই ইত্যাদি অপছন্দ করেন।
৫) এঁদের তানের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। বব্বন রাও হলদঙ্কর জয়পুর ও আগ্রা দু ঘরেরই তালিম পেয়েছেন। ওঁর মরাঠি পুস্তক ‘জুলু পহনারে দৌ তম্বুরে’তে এই তান বিস্তারের পদ্ধতিকে অটুট আখ্যা দিয়েছেন। এঁদের তানের দায়রা তিন সপ্তকের, যার যতদূর গলা যায়, তবে তার মধ্যে ক্রম আছে। যথা প্রথম তান যদি গান্ধার থেকে শুরু হয়, তো দ্বিতীয় তান মধ্যম থেকে শুরু হবে, তৃতীয়টি পঞ্চম থেকে। প্রথম যখন ষোলো বছর বয়সে কেসরবাঈয়ের চিত্রবিচিত্র তানের খেলা শুনেছিলাম তখন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর দম শ্বাসের ক্ষমতা দেখে।
তিন তালের লয় অতি বিলম্বিত, এক একটি মাত্রার মাঝে ধীরে সুস্থে দুটো তেরেকেটে ঢুকে যায়, এমনই লয়। তার অর্ধেক থেকে তিন কোয়ার্টার তান এক নিশ্বাসে নিতে হবে এমনই নিয়ম। তানের গতি কী জটিল অথচ কী সুন্দর তার রচনা আর কী স্বচ্ছন্দ এগজিকিউশন। চরকিবাজির মতো ফুল কাটতে কাটতে ঘুরছে, কখনও মুহূর্তের জন্য এক এক পর্দায় স্থির হয়ে স্বরের ওপর আঘাত করছে, আবার যখন মনে হচ্ছে এই তো শম এসে গেল বলে, তান তো আরোহণের সিঁড়িতে, ঠিক সেই সময়ই তান ওপরের গান্ধার ছুঁয়ে ফিরত মুখে এক নতুন প্যাঁচ কষে এল, সঙ্গে সঙ্গে পোষা কুকুরের মতো বন্দিশের মুখড়া এসে হাজির।
প্রতিবার শমে এসে পৌঁছন যেন একটা event। মজিদ খাঁ সারাজীবন সারেঙ্গিতে কেসরবাঈয়ের সঙ্গে সাথসঙ্গত করেছিলেন। তাঁর শালা রহমান কুরেশি দিল্লির এক আসরে আমার সঙ্গে হার্মোনিয়াম বাজিয়েছিলেন। তাঁর কাছে খাসা একটি উপমা শুনেছি। “যব ভি বহু তান করকে বাপস্ আতি থি, মুখড়া ভি দুলহন বনকে আ যাতি থি।”
৬) জয়পুর ঘরানার স্বরপ্রয়োগ শুদ্ধ আকারে। মল্লিকার্জুন মনসুরের গান প্রথমবার শুনে জ্ঞানবাবু বলেছিলেন ‘এ তো আকার নয় হাঁকার।’ আজকের দিনে এ অঞ্চলের গায়ক গায়িকারা তান নিয়ে প্রচুর মাথা ঘামান। আমার মতে তানের স্পিডের দিকে নজর না দিয়ে তানের voice production এবং নিখুঁত execution-এর দিকটা সর্বাগ্রে দেখা উচিত। ‘ব্রডকাস্ট’ কোম্পানির ন’খানা রেকর্ড ধরে কেসরবাঈয়ের খান বিশেষ রেকর্ড শোনা তাঁদের অবশ্য কর্তব্যের মধ্যে পড়বে।
৭) এ ঘরানায় মিশ্র রাগ ও অপ্রচলিত রাগের ছড়াছড়ি। বসন্তবাহার, আড়ম্বরীকেদার, বাসন্তী কেদার, পটবিহাগ (পটদীপ + বেহাগ), ভৈরোবাহার, সম্পূর্ণ মালকোষ, রইসা কানাড়া, শুদ্ধ নট যাকে আগ্রা ঘরানায় সার নট বলা হয়, খোকর (এর নাম আগ্রায় চম্পক বিলাবল), ভৌশাখ, এ সব রাগ অন্যত্র বড় একটা শোনা যায় না। মল্লিকার্জুন মনসুর ক্যালকাটা মিউজিক সার্কল কনফারেন্সে বহুকাল পূর্বে একবার ভৌশাখ নামক কানাড়ায় সাংঘাতিক গমক তান শুনিয়েছিলেন যে প্রকার তান আল্লাদিয়া খাঁ করতেন। পরবর্তীকালে মনে করিয়ে দিতে উনি হেসে বলেছিলেন “বহ বুঢ়াপেকি চিজ্ নহী।”
৮) জয়পুর গায়কির উন্নতি সাধনের জন্য শ্রীমতী কিশোরী আমুনকর কিরানার অনুকরণে স্বরবিস্তার ঢুকিয়েছেন। এর ফল ভাল হয়েছে, কারণ গোয়ালিয়রের মতো জয়পুরের বিলম্বিত অংশে ধীরে সুস্থে রাগ বর্তানোর অভাব অনেকেই বোধ করেছেন। দুর্ভাগ্যবশত দ্রুত খেয়ালে এই অসাধারণ প্রতিভাময়ী গায়িকার স্কন্ধে আজকাল প্রায়শই বলিউডের ভূত চাপে এবং তার ফলে আল্লাদিয়া খাঁ সাহেবের সৃষ্ট জয়পুর গায়কি জুহু বীচ গায়কিতে পরিণত হয়।
[ জয়পুর ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]
আরও পড়ুন:
1 thought on “জয়পুর ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়”