মুঘল যুগের সঙ্গীত নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : সঙ্গীতশাস্ত্রী রাজ্যেশ্বর মিত্র মহাশয় তাঁর নিজের ক্ষেত্রে অসাধারণ কাজ করে গেছেন। সংস্কৃতে তাঁর যেমন ব্যুৎপত্তি ছিল ফারসি ভাষাতেও তেমনই। প্রথমটি আমি লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ অবধি টেনেছিলাম। ফারসি আমি পড়িনি তবে কৌতূহলের খাতিরে বাবরনামা ও আকবরনামা-র ইংরেজি অনুবাদে এককালে চোখ বুলিয়েছিলাম।
রাজ্যেশ্বর মিত্র তাঁর ‘মুঘল ভারতের সঙ্গীতচিন্তায় আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’, ফকিরুল্লার [ ফকীরউল্লাহ্। ‘রাগদর্পণ’ এবং মীর্জা খাঁ-র ‘তুহফাতুল হিন্দ’ নামক তিনটি অতি মূল্যবান গ্রন্থের সঙ্গীতবিষয়ক পরিচ্ছেদগুলি মূলানুগ অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের উপকারার্থে রেখে গেছেন। উপর্যুক্ত বইগুলির ওপর নির্ভর করেই আমি কিছু তথ্য এই পরিচ্ছেদে পরিবেশন করব। [ নবাব ওয়াজেদ আলি সাহেবের ‘দুলহন্’-ও এই গ্রন্থে আছে।
বাবুর [বাবর] বেশিদিন রাজত্ব করেননি আর হুমায়ুন যুদ্ধবিগ্রহ করে পালিয়ে বেড়িয়ে হিন্দুস্থানের সংস্কৃতির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিতির সুযোগ পাননি। জালালুদ্দিন আকবর নিজে [তথাকথিত] অশিক্ষিত হলেও ভারতীয় সংস্কৃতির সব শাখারই সমান অনুরাগী ছিলেন এ কথা সবাই জানে। সঙ্গীতকে তিনি বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু অনুরূপভাবে আকবরের সময় সঙ্গীতচিন্তার প্রসার তেমন ঘটেনি।
ঔরঙ্গজেবের সময় ফকিরুল্লার ‘রাগদর্পণ’-এ আকবরের যুগের একখানি গ্রন্থের উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু তিনি নিজেই তার প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন। বাদাওনী এ যুগে দুজন পণ্ডিত ব্যক্তির নাম নিয়েছেন যাঁরা গ্রন্থ রচনা করেন, তাঁদের একজনের নাম মিঞা কাসিম কাহী। দ্বিতীয় গ্রন্থকারের নাম চুঘতাই আমির খঞ্জুর বেগ যিনি পারস্যের ও ভারতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে অনেক তথ্য আহরণ করে বই লেখেন। কিন্তু সে বইয়ের কোনও হদিস পাওয়া যায় নি।
আকবরের সময় আবুল ফজল বলছেন গত হাজার বছরে তানসেনের মত কলাকার জন্মায়নি এবং তৎকালীন অধিকাংশ শিল্পী তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করলেও ‘রাগদর্পণ’ রচয়িতা ফকিরুল্লা তানসেনকে কেবলমাত্র বড় গাইয়ে হিসেবে গণ্য করেছেন। যদিও তিনি ঔরঙ্গ জেবের লোক, তাঁর মতে রাজা মানসিং তোমর, নায়ক বখশু প্রমুখেরা তানসেনের তুলনায় আরও বড় গায়ক এবং রচয়িতা ছিলেন। এমনকি ফকিরুল্লা তানসেনকে ‘আতাই’ পর্যন্ত বলতে পেছপাও হননি।
‘আতাই’ কথাটির মানে যারা উস্তাদের নকল করে গান করেন কিন্তু আসলে উস্তাদ নন। আমাদের বাল্যকালে আমাদের মতো ইংরেজি পড়া ভদ্রসন্তান গায়কদের উস্তাদরা আতাই বলে বিবেচনা করতেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করও বাদ যাননি। সেসব গোঁড়ামির কথা থাক, আসলে তানসেন সম্রাটের এতই প্রিয়পাত্র ছিলেন এবং এতই তাঁর রমরমা যে তাঁর শিষ্যবর্গও প্রমাণ করবার চেষ্টা করতেন যে দরবারি সঙ্গীত তো ধ্রুপদ, আর তানসেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী।
এর ফলে ও ধীরে ধীরে লোপ যায়। ফকিরুল্লা এই অপচেষ্টার উল্লেখ করেছেন এবং আকবরের পৃষ্ঠপোষকতাকে ভাল চোখে দেখেননি। শুধু এইটুকুই একাধারে কানাড়া এবং মিঞা তোড়ির মতো তিনটি রাগের জন্ম দিতে পারেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব পোষণ করা অপরাধের মধ্যে পড়ে। রাগ অনেকেই সৃষ্টি করেছেন কিন্তু কালের দরবারে সাক্ষ্য দিচ্ছে একই জনের তৈরি করা একাধিক রাগ এমন নজির কোথায়?
খিয়াল, খ্যাল বা খয়াল আকবরের প্রপৌত্রের সময় লেখা ‘রাগদর্পণ’-এ বলা এই গীত দুটি কলিতে গঠিত দেশি গাওয়া হয়। বর্তমানে এটি দিল্লি অঞ্চলে প্রচলিত। আকবরের সময়ে এটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। যখন আগ্রা (আকবরাবাদ) রাজধানী হল সেই সময় যাবতীয় গায়ক ও উস্তাদ যাঁদের তুলনা কোনও যুগে দেখা যায়নি তাঁরা সবাই ওইখানে জমা হয়েছিলেন।
এঁদের মধ্যে অধিকাংশই গোয়ালিয়রের বাসিন্দা ছিলেন। অতএব বর্তমান যুগের খেয়ালের রূপের সঙ্গে তৎকালীন খেয়ালের প্রচুর অন্তর থাকলেও আগ্রার চেয়ে গোয়ালিয়রের কী ধ্রুপদ কী খেয়ালে পরম্পরা আরও প্রাচীন এটা প্রমাণিত হচ্ছে।
আকবরের সময়ে যেসব কলাকারদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তাঁদের গুণাবলীর হিসেবে লিস্টি দিয়েছেন ফকিরুল্লা। [তদেব, পৃ. ৬৬] এঁদের মধ্যে কেউ খেয়াল গাইতেন কিনা জানা যায় না।
১. মিয়া তানসেন :
তানসেনের জন্ম ১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে, গোয়ালিয়রের ‘বেহট’ গ্রামে। প্রায় সকল বিশেষজ্ঞের ধারণা মতে উত্তর ভারতের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি মুঘল বাদশাহ আকবরের রাজদরবারের নবরত্নের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাকে সঙ্গীত সম্রাট নামে ডাকা হয়। তানসেন সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন : মিয়া তানসেন [ Miyan Tansen ] বা মোহাম্মদ আতা আলী খান
২. হাজি সুজান খাঁ :
হাজি সুজান খাঁ কে নওহার বাণী ও আগ্রা ঘরানার প্রবর্তক পবর্তক বলা হয়। এই ঘরানার সমসাময়িক গায়কদের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে এই ঘরানার সূচনা করেছিলেন হাজী সুজন খান। সাহিত্যিক প্রমাণ অনুসারে, তিনি একজন রাজপুত ছিলেন যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং সম্রাট আকবরের দরবারে একজন গায়ক ছিলেন।
জনশ্রুতি আছে যে তিনি দীপক রাগ গেয়ে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন এবং আকবর উচ্চ প্রশংসায় তাকে দীপক জ্যোত উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন। সুরকারও ছিলেন সুজন খান। সুজন নামে তাঁর গাওয়া বহু ধ্রুপদ আজও পাওয়া যায় এবং গাওয়া হয়। কারো কারো মতে সুজন খান ও তানসেন সমসাময়িক ছিলেন।
৩. সুরগিয়ান খাঁ
৪. চান্দ খাঁ ও সূরৎ খাঁ ফতেপুরী [ দুই ভাই
৫. মিয়াঁ তানসেনের দুই শিষ্য চান্দ ও রশিদ মিয়াঁ
৬. তানতরঙ্গ ও বিলাস খাঁ— তানসেনের দুই পুত্র
৭. রামদাস মুঠিয়া
৮. দাউদ খাঁ ঢাড়ী
১০. মদন রায় ঢাড়ী
১১. মুল্লা আস্হাক্ ঢাড়ী (অনুসন্ধান করে বিদ্যা অর্জন করেছিলেন
বলে মুল্লা)
১২. খিজির খাঁ ও ভাই নবাৎ খাঁ
১৩. হুসেন খাঁ পটন্নী—জাতে আফগান
১৪. বাজ বাহাদুর—মালবের শাসনকর্তা
১৫. নায়ক চরজ্ (চরজুকি মহলারের সৃষ্টিকর্তা)
১৬. নায়ক ভগবান
১৭. সুরতসেন— প্রিয় পুত্র
১৮. লালা এবং দেবী, এঁরা বরহমণ (ব্রাহ্মণ) আকিলের দুই ভাই
১৯. সুন বাচ্ছী
এঁরা পদস্থ গায়ক ছিলেন কিন্তু নায়ক ভানু, নায়ক পাণ্ডুয়ী ও নায়ক বশুর মতো শিক্ষিত ছিলেন না। নায়ক তাঁরাই যাঁরা শুধু গায়ক ছিলেন না, বিদ্বানও ছিলেন। এঁরা কুরসিতে বসে গাইতেন ও গান শেখাতেন। বীণ ও মৃদঙ্গবাদকরা পেছন থেকে অথবা নীচে বসে সাথসঙ্গত করতেন। গ্রন্থে অর্থাৎ ‘মানকুতূহল’ ও শাঈদেবের পুস্তকে যা বর্ণিত আছে তা বুঝিয়ে দিতেন অর্থাৎ গানের তালিমের সঙ্গে থিওরি বা ব্যাকরণের ওপর সমান জোর দেওয়া হত। যাঁরা গান গাইতেন না বা ভাল গাইতেন না অথচ বিদ্বান তাঁদের বলা হত পণ্ডিত, নায়ক নয়।
‘রাগদর্পণে’র অষ্টম অধ্যায়ে গায়কদের গুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে— এঁদের আওয়াজ আকর্ষক হবে, গানের সময়ে রুচির পরিচয় পাওয়া যাবে। গ্রহ ন্যাস, রাগাঙ্গ, ভাষা অঙ্গ, ক্রিয়া অঙ্গ, আলাপ অঙ্গ সব জানা থাকবে।
আলাপ ও গমকের রীতির প্রয়োগ সুষ্ঠুভাবে হবে, তিন সপ্তকে কণ্ঠ সমানভাবে বিচরণ করবে, বিভিন্ন অলঙ্কার প্রভৃতির ওপর পুরো দখল থাকবে, তাল সম্বন্ধে উত্তম ধারণা, নিয়মবহির্ভূত গায়কি চলবে না, কন্ঠে ওজস্বিতা থাকবে, শুদ্ধ ও ছায়ালগ এই দুই প্রকার রাগ অবগত হওয়া চাই, কাকু প্রয়োগ বা ধ্বনি বিকারে অভ্যাসের জন্য কণ্ঠ বিভিন্ন পর্দায় পরিভ্রমণে সক্ষম হবে, উত্তম স্মৃতিবিশিষ্ট হবে, যথাযথভাবে রাগ নির্ণয়ের ক্ষমতা থাকবে, সর্বোপরি সঙ্গীতে রঞ্জকতা ও সৌন্দর্যের পরিচয় থাকা চাই। [তদেব, পৃ. ৬৪]
আজকের দিনে এম্বপ্রকার বেয়াড়া ফরমাস করলে ভারতের কোনও গায়ক পাস করতে পারবেন কি না সন্দেহ। সেকালেও যাঁদের মধ্যে উপযুক্ত গুণ ও সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যা না থাকত তাঁদের দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হত মধ্যম ও অধম। যাঁরা টিউশানি করে পেট চালাতেন তাদের বলা হত শিক্ষাকার। আঙ্কার বা আন্কার শ্রেণীর গায়ক তাঁরা যাঁরা দস্তুতমতো গান করতে পারেন কিন্তু শিক্ষাদানে সমর্থ নন।
যাঁরা শীঘ্র পুলকসঞ্চার করতে পারতেন তাদের বলা হত রসিক, শ্রোতাদের যারা খুশি করতে পারেন তাঁরা ছিলেন রঞ্জক। যাঁরা সব রাগ নিয়মানুসারে গাইতে পারতেন এবং রাগের সেন্টিমেন্ট বজায় রাখতে পারতেন তাঁদের বলা হত ভাবক। লক্ষ করার বিষয় দুটি। ফারসিতে গ্রন্থ লেখা হয়েছে বটে কিন্তু নামগুলি দেওয়া হয়েছে সংস্কৃতয়। আর যদিও উপর্যুক্ত গুণাবলীর সঙ্গে বিদ্যার সমন্বয় গন্ধর্ব ভিন্ন কারও কাছেই প্রত্যাশা করা যায় না, মিয়া তানসেন কিন্তু ফকিরুল্লার তালিকাতেও সর্বোচ্চে।
শাহজাহানের সময় ধ্রুপদের পাশাপাশি খেয়ালের পুনরুত্থান হয়। শেখ বহাউদ্দিন বরনাওয়ার বিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে ‘রাগ দর্পণ’-এ। তিনি পঁচিশ বছর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান ও ফকিরদের সঙ্গ করেন। দক্ষিণে গিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গীতের রীতিনীতি শিখেছিলেন সেই সঙ্গে বাদ্য শিক্ষাও। পঞ্চাশ বয়সে যখনই তিনি দেশে ফিরলেন তখন তাঁর মতো জ্ঞানীগুণী গায়ক কেউ ছিল না।
লেখক বলেছেন গীত ধ্রুপদ ও খেয়ালের রচনা তাঁর বিখ্যাত এবং তিনি সমান পারদর্শিতার সঙ্গে এ সবই গাইতেন। জৈনপুর অঞ্চলের প্রচলিত চুটকলা গাওয়া কঠিন বলা হয় কিন্তু এসব রচনাতেও তাঁর দক্ষতা ছিল। শেখ নাসিরুদ্দিন ধ্রুপদ খেয়াল চুটকলা ও তরানায় সমান পারদর্শী ছিলেন এবং গায়ন পদ্ধতিতে সুলতান হুসেন শর্কীর মতো ক্ষমতা দেখিয়ে গেছেন।
লাল খাঁ কলাবস্তু প্রধানত ধ্রুপদী ছিলেন, এঁর শিক্ষা হয় তানসেনের ছেলে বিলাস খাঁর কাছে এবং পরে বিলাস খাঁর কন্যাকে বিবাহ করেন, এঁর খেতাব ছিল গুণসমুদ্র খাঁ। বিলাস খাঁর অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে নাম করেন মিসির ঢাড়ী, গুজরাতি কলাবস্ত বাখৎ খাঁ।
গুণ খাঁ কলাবস্তুকে শাহজাহানের ছেলে শুজা সম্রাটকে অনুরোধ করে নিজের কাছে অর্থাৎ বিহার বাংলা সুবায় নিয়ে যান। মার্গ ও দেশি সঙ্গীতে এঁর সমান দক্ষতা ছিল। রাজারাম ও তার পৌত্র ও বিহারের অন্তর্গত খড়গপুরের শাসনকর্তা ঈদল সিংকে জ্ঞানে আমীর খুসরো বা সুলতান শকীর সমতুল্য বলা হয়েছে। এর খেয়াল ও তরানার রচনা বড়ই সুন্দর এবং গলাও বড় মিষ্টি। এঁর তুলনা নেই বলেছেন ফকিরুল্লা।
সবচেয়ে নামী গায়ক ছিলেন লাল খাঁর ছেলে খুশৃহাল খাঁ। কলাবদ্ভদের মধ্যে ঔরঙ্গজেবের সময় এঁর সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না। সম্রাটের কাছে ইনি আদর ও প্রতিষ্ঠা বহুকাল ধরে পেয়েছিলেন। এঁদের ছাড়া আরও দশ বিশজন প্রসিদ্ধ ধ্রুপদ ও খেয়াল গায়ক এবং বীণকার, মৃদঙ্গ এবং সূর্না (শানাই) বাজিয়েদের উল্লেখ এই বইয়েতে করা হয়েছে।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের প্রথম ভাগে কলাবত্তদের অবস্থা ভালই ছিল। ফকিরউল্লাহ ঔরঙ্গজেবের রাজত্বে ‘রাগ দর্পণ’ রচনা করেন বটে কিন্তু তিনি শাহজাহানের আমলের লোক। শাহজাহানের নিমক খেয়ে, পরে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে হাত মেলাতে তাঁর বাধেনি।
রাজা যশোবন্ত সিংকে ঔরঙ্গজেবের গতিরোধ করতে যখন মালবে পাঠানো হয় তখন আরও পাঁচজনের মতো উনি রণস্থলেই ঔরঙ্গজেবের পক্ষ নেন এবং দেড়হাজারি মনসবের সঙ্গে সাইফ খাঁ উপাধি পান। শুজাকে যুদ্ধে হারানোর কৃতিত্বও ফকিরউল্লাহ এবং ইক্রম খাঁর। দারা শিকোহর হত্যাকাণ্ড নিষ্পন্ন করার ভারও দেওয়া হয় ফকিরউল্লাকে।
ঔরঙ্গজেবের সময় তিনি পরপর কাশ্মীর, বিহার ও ইলাহাবাদের সুবেদার নিযুক্ত হন। ‘‘রাগ দর্পণ’-এর রচনা শেষ হয় ১৬৬৬ সালে। ১৬৬৮ সাল থেকে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গীতের প্রতি বিরূপ মনোভাবের প্রকাশ সবাই লক্ষ করেন। ওই বছরেই তিনি খুশহাল থাঁ, বিশ্রাম খাঁ, রসবীণ প্রমুখ প্রধান কলাবত্তদের ওপর হুকুম জারি করেন যে, তাঁরা দরবারে আসতে পারেন কিন্তু গানবাজনা করা চলবে না। ক্রমে সঙ্গীত একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া হয় বটে কিন্তু আশ্রিত সঙ্গীতজ্ঞদের বিতাড়িত করা হয়নি।
১৬৬৮ সালের ২১ অক্টোবর খুগ্হাল খাঁ এবং অন্যান্য গুণীদের তিন হাজার টাকা এবং চল্লিশটি পোশাক খেলাৎ দেওয়া হয়। ১৬৭১ সালে বিশ্রাম খাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর ছেলে ভূপৎ খাঁ ও খুশহাল থাকে পরিচ্ছদ উপহার দেওয়া হয়। মোগল আমলে এ ধরনের খুশি হয়ে গাইয়ে বাজিয়েদের দানখয়রাত করার বহু গল্প আছে যা মানুচ্চি ও বার্নিয়ের লিখে গেছেন।
আব্রাহম ইরালি তাঁর ‘Great Mughls’ পুস্তকে বাট্টার শাসনকর্তার কথা লিখেছেন যিনি মিয়া তানসেনের গান শুনে সেকালে নগদ এক কোটি টাকা বখশিস করেছিলেন। জাহাঙ্গির মহম্মদ নয়ি নামক এক বাঁশি বাজিয়েকে দাঁড়িপাল্লায় টাকা দিয়ে ওজন করিয়েছিলেন। ওজনে ৬৩০০ টাকা| ওঠে, সেই সঙ্গে একটি হাতি তাকে দেওয়া হয় সম্ভবত টাকার থলিগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ধ্রুপদী ও খেয়ালিয়া জগন্নাথকে শাহজাহান তার ওজনের পরিমাণ মোহর দান করেন। আকবরের খান ই খানান আবদর রহিম রামদাস নামের এক গায়ককে এক লাখ টাকা বখশিস দেন।
গোলকণ্ডার সিংহাসনচ্যুত সুলতান যখন দাক্ষিণাত্যে দৌলতাবাদে ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দী [তখন তিনি] কোনও এক গায়কের গান শুনে আফসোস করেছিলেন ‘হায়! আজ যদি আমার রাজ্য থাকত তো এই মানুষটাকে আমি লাখ টাকা বখশিস করতাম।’ ঔরঙ্গজেবও তখন দাক্ষিণাত্যে। তাঁর কানে এ কথা পৌঁছবামাত্র উনি লাখ টাকা সুলতান আবুল হাসানকে দেওয়ার হুকুম দেন।
এই অস্বাভাবিক দানশীলতার নিদর্শন তাও গানের জন্য, ঔরঙ্গজেবের জীবনে বড় একটা পাওয়া যায় না। এ হেন কোরানের দোহাই দেওয়া সঙ্গীতবিরোধী বাদশাকে গ্রন্থ উৎসর্গ করেন ফকিরুল্লাহ এবং অনুরোধ করেছিলেন সম্রাট যেন খুৎবা পড়ে গ্রন্থটির প্রচার তিনি নিজে করেন। এ পুস্তক হাতে পেয়ে বাদশাহ কী করেছিলেন তা জানা যায় না। জানা যেত অবশ্য যদি ফকিরুল্লাহর অনুরোধ ঔরঙ্গজের রাখতেন।
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে গানবাজনা বড়ই বেহাল হয়ে পড়েছিল, আন্দাজ করা যায়। যদিও বাদশা কোরান হদিসের দোহাই দিয়ে প্রকাশ্যে গানবাজনার আসর তুলে দেন, আমার ধারণা কারণ সম্ভবত ধর্মবহির্ভূতও ছিল এবং তার সঙ্গে আর পাঁচটা মুঘল রাজপুত্রদের মতো ওঁর কোরান পাঠ অস্ত্রশিক্ষার সঙ্গে বাল্যকালে কালোয়াতি গানের রেয়াজের প্রতি অনীহারও সম্পর্ক থাকতে পারে।
আমি অনেক কাল পূর্বে প্রোফেসার টি কে রায়চৌধুরী নামক এক আরবি ভাষার পণ্ডিতের এই বিষয়ের ওপর লেখা ছোট্ট একটি পুস্তিকা পড়েছিলাম। ইনি অক্সফোর্ডের অনরিস কাউজা [Honoris Caus] প্রাপ্ত আমাদের বন্ধু তপন রায়চৌধুরী নন। ওঁর বক্তব্য: আরবি ভাষায় এক এক কথার একাধিক মানে হয় এবং ওই ভাষায় যাঁরা সুপণ্ডিত নন তাঁরা অনেক সময় ভুল বা কদর্থ করেন।
ওঁর আরও বক্তব্য প্রফেটের হদিসে কয়েকটি পরিস্থিতির বর্ণনা আছে যেখানে সঙ্গীত অনুমোদনীয়। পুস্তিকাটি হারিয়ে গেছে নচেৎ তার বিশদ ব্যাখান এখানে দিতে পারতাম। এটি মনে আছে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত অবস্থায় ক্রীতদাসী যদি মনোরঞ্জনের জন্য গান করে বা বাদ্যযন্ত্র বাজায় তাতে পাপ হয় না।
যাই হোক, ঔরঙ্গজেবের সময় কিংবদন্তী আছে কলাবন্ত এবং রসিকরা ঘটা করে সঙ্গীতের এক জানাজা (শবযাত্রা) বার করেন ধুমধামের সঙ্গে। খবর শুনে বাদশাহ বলেছিলেন, ‘বলে দিও ওদের যে গোর দেওয়ার সময় গর্ত যেন যথেষ্ট গভীর হয়, যাতে আবার উঠে না পড়ে।’
মহম্মদ শাহ রঙ্গিলের (১৭১৯-১৭৪৮) রাজত্ব শুরু হবার অনেক আগে এঁরা দিল্লি ছেড়ে আশপাশের তালুকে আশ্রয় নেন। যথা মিরটের কাছে অন্বেটা, সাহারানপুরের কাছে কিরানা, আগ্রার কাছে সেকান্দ্রা, জয়পুর এবং গোয়ালিয়র, যার থেকে বিভিন্ন ঘরানার উৎপত্তি হয়েছে।
[ মুঘল যুগের সঙ্গীত – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]
আরও পড়ুন: