সহসওয়ান ও পাতিয়ালা নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : সহসওয়ানকে ঘরানা বলা যায় কি না এ নিয়ে আমার পরিচিত দু-একজনের কিছু বক্তব্য আছে, এবং তাঁরা বিদ্বান এবং পুরনো তালিমের গায়ক। এঁদের বক্তব্যর সঙ্গে আমার মতামত বেশ কিছুটা মেলে, যে কারণে আমি সহসওয়ানকে ঘরানা না বলে খানদান বলব। বাহাদুর হুসেন খাঁ এনায়েৎ হুসেনের প্রথম শুরু। তাঁর রচিত তরানা একাধিক আমার দুনম্বর গুরু মুত্তাক হুসেন খাঁর মুখে শোনবার সৌভাগ্য হয়েছে, বেশ কিছু তার মধ্যে মধ্যলয়ের রচনা। তবে তাঁর গায়কি কী প্রকার ছিল জানা যায় না। তিনি কী প্রকারের তালিম দিয়েছিলেন তা আমি তাঁর শিষ্য এনায়েত্ হুসেনের জামাই নিসার হুসেন খাঁর মুখে শুনে ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’-তে লিখেছি। যাঁদের হাতের কাছে এ বই নেই তাঁদের জন্য সংক্ষেপে আবার জানাচ্ছি।
![সহসওয়ান ও পাতিয়ালা ঘরানা - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [ Kumar Prasad Mukherji ]](http://musicgurukulonline.com/wp-content/uploads/2022/01/কুমারপ্রসাদ-মুখোপাধ্যায়-Kumar-Prasad-Mukherji-226x300.jpg)
এনায়ে হসেন খাঁর সা রে গা মা পা ধা নি সা র পর শুরু হয় পালটার রেয়াজ। তার পর তাঁর ওস্তাদ দেন গৌড় সারঙ্গের মত রাগের পালটা। রামপুরের পিলে তালাও অঞ্চল থেকে ওঁদের কিছু আত্মীয়স্বজন এনায়েতের গান শুনতে চাইলে বাহাদুর হুসেন খাঁ দুদিনের তালিমে বেহাগ গাইয়ে দিয়েছিলেন গৌড় সারঙ্গের পালটা ঈষৎ অদলবদল করে। নিসার হুসেন খাঁর বক্তব্য ছিল ‘এক সুর সাধো তো সব সুর সাধো’। এ কথা তাঁদেরই মনে ধরবে যাঁরা পালটার গায়কি সাধেন এবং গান। নিসার হুসেন খাঁ প্রচণ্ড রেয়াজি গায়ক ছিলেন তা তাঁর সার্গম, বিদ্যুদ্গতি সপাট তান ও তরানা শুনেই বোঝা যায়।
আচার্য গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী তালিম নিয়েছিলেন ধ্রুপদের রাধিকা গোস্বামীর কাছে, খেয়ালের তালিম পান উস্তাদ বদল খাঁ এবং উত্তাদ এনায়েত্ হুসেন খাঁর হাতে। ওঁরই দৌলতে এনায়েত্ হুসেন খাঁর কিছু বন্দিশ কলকাতায় ওঁর শিষ্যরা চালু করেন। এনায়েত্ হুসেন খাঁর বেশ কিছু রচনা অসাধারণ কিন্তু গায়কি তাঁর কি প্রকার ছিল? মোটামুটি আন্দাজ পাওয়া যায় উনি গোয়ালিয়রই গাইতেন এবং ওঁর শ্বশুর ছিলেন ওস্তাদ হদদু খাঁ স্বয়ং।
মুস্তাক হুসেন খাঁর প্রথম তালিম ওস্তাদ হায়দর খাঁ, অর্থাৎ নিসার হুসেন খাঁর পিতামহর কাছে। ওঁর প্রথম স্ত্রীও হায়দর খাঁর কন্যা। এই সুবাদে উনি নিসার হুসেনের পিসেমশায়। ওঁর চার বিবির মধ্যে আর একজন ওঁর গুরু এনায়েত্ হুসেন খাঁর মেয়ে, অতএব নিসার হুসেন আর এক সম্পর্কে ওঁর ভায়রাভাই। অতএব মুতাক হুসেন খাঁর গায়কি যে গোয়ালিয়র হবে তাতে আশ্চর্য কিছু নেই।

অন্য দিকে ওঁর আপন মামা আগ্রা অতরৌলির ওস্তাদ পুত্তন খাঁ যাঁর বিড়ার অঙ্গের বহলাওয়া বিখ্যাত ছিল। মিড় ও ভারী দানার তানের সাহায্যে স্বরসমূহকে ওলটপালট করার নাম বিড়ার অঙ্গ। কিন্তু ফ্রেজ গুলির মধ্যে organic interrelationship থাকবে অর্থাৎ অঙ্গাঙ্গীভাবে সেগুলি জড়িত। এ অঙ্গ শুনেছি পুত্তন খাঁর ভাগ্নে মুস্তাক হুসেন খাঁ ছাড়া গোয়ালিয়রের কৃষ্ণরাও শঙ্কর পণ্ডিত ও আগ্রার বিলায়েৎ হুসেন খাঁ এবং খাদিম হুসেন খাঁর কাছে।
পুত্তন খাঁর পাশাপাশি তাঁর মাসতুতো ভাই মেহবুব খাঁও (দরস পিয়া) প্রথম দিকে মুতাক হুসেনকে তালিম দেন। অতএব ওঁর গানে আগ্রারও ছিটেফোঁটা পাওয়া যায়। উনি অওছার করে বিলম্বিত গাইতেন, বন্দিশের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শন ওঁর গায়কির একটি বৈশিষ্ট্য, বোলবাট অল্প করতেন, বহলাওয়া ও গোয়ালিয়রি ঢঙে শুদ্ধ আকারে তিন সপ্তকের লরজদার ভারী তান এবং সপাট তানের জন্য উনি বিখ্যাত ছিলেন।

ভাতখণ্ডেজি ধূর্জটিপ্রসাদকে বলেন হিন্দুস্থানে বন্দিশের চার আনা মুত্তাক হুসেনের ভাঁড়ারে আছে। আর ওঁর তানকর্তবের প্রশংসাসূচক উল্লেখ করেছেন ‘স্মৃতির অতলে’-তে অমিয়নাথ সান্যাল, বক্রোক্তি করেছেন দিলীপকুমার রায় ‘ভ্রাম্যমাণের দিনপঞ্জিকা’য়। আমার সমগ্র অভিজ্ঞতায় আমি একবার ওঁর ইমনের বিস্তার আধঘণ্টা শুনেছিলাম ওঁর অওছারে। নচেৎ গোয়ালিয়রের ঐতিহ্যে ফলাও করে বিস্তারের স্থান নেই।

মুশতাক হুসেন খাঁর পর এই ঘরানার সবচেয়ে বিখ্যাত নাম নিসার হুসেন খাঁ। ইনি গোয়ালিয়রের সঙ্গে আগ্রার বোলতান, বরাবর লয়ে ছন্দবহুল তান এবং লয়কারী মেশান। এজন্য দায়ী আমার তিন নম্বর গুরু আতা হুসেন খাঁ যার সঙ্গ বরোদায় নিসার হুসেন খাঁ বহুদিন ঘনিষ্ঠভাবে পেয়েছিলেন।
আমি ‘চর্চা’ সিরিজে আতা হুসেন খাঁর দরবারীর তানের পাশে নিসার হুসেন খাঁর রাগ পঞ্চমের ছোট খেয়ালে বোলতান এবং তানের নমুনা পেশ করেছিলাম। দুজনের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য দেখে উপস্থিত একাধিক সমঝদার শ্রোতা অবাক হয়ে যান। এ ছাড়াও যদি সেসময়ে বরোদায় নিসার হুসেন খাঁর উপর উদ্ভাদ ফৈয়াজ খাঁর স্বরপ্রয়োগ ও ছন্দের প্রভাবও কিছু পড়ে থাকে তো আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তবে তরানা গাইবার কায়দা ওঁর নিজস্ব।
![ওস্তাদ আখতার হুসেন খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Ustad Akhtar Hussain Khan, Patiala Gharana ]](http://musicgurukulonline.com/wp-content/uploads/2022/01/Ustad-Akhtar-Hussain-Khan-Patiala-Gharana-300x300.jpg)
খুবই মিল আছে মুস্তাক হুসেন খাঁ সাহেবের সঙ্গে কিন্তু নিসার হুসেন খাঁর তরানা গাইবার কায়দার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য ছিল এবং তৈরিও অনেক বেশি। নিসার হুসেন খাঁর পিতা ফিদা হুসেন খাঁ অবশ্য মুতাক হুসেন খাঁর কার্বন কপি ছিলেন তবে গলা আরও সুরেলা ছিল।
নিসার হুসেন খাঁর পুত্র সরফরাজ হুসেন এবং জামাই হাফিজ আহমদ খাঁ নিসার হুসেনের গায়কি বিশ্বস্তভাবেই অনুসরণ করেছেন। এঁদের দুজনের মধ্যে হাফিজ আহমদের গলায় গভীরতা পাওয়া যায় যদিও তারসপ্তকের পর্দার স্বরপ্রয়োগে falsetto-র ব্যবহার উনি করেন। এই প্রজন্মের গায়কদের মধ্যে হফিজের গানই সুললিত কণ্ঠের জন্য সবচেয়ে সুশ্রাব্য।

মুস্তাক হুসেন খাঁর একুশটি সন্তানদের মধ্যে একটি জীবিত, জামাই সাদিক আলি যাঁ শ্বশুরের গায়কি গাইতে পারেন মোটামুটি। এঁর গানেও শ্রুতিমাধুর্য আছে। মুত্তাক হুসেন খাঁ সাহেবের জ্যেষ্ঠ সন্তান ইশতিয়াক হুসেন খাঁ অনেকদিন গত হয়েছেন, তাঁর কাছে খাঁ সাহেবের তালিম এবং গায়কি প্রায় সবটাই পাওয়া যেত। ইনি কলকাতার সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে কিছুকাল ছিলেন, কিন্তু এঁর উপস্থিতির সদ্ব্যবহার করা হয়নি।
এ যুগে এই ঘরানার গায়ক রাশিদ খাঁ সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করেছেন। বাল্যকাল থেকেই এঁর মধ্যে অসাধারণত্বর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল তবে নিসার হুসেন খাঁ সাহেবের ছেলে এবং জামাইয়ের তুলনায় এঁর তালিম কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে যা ইনি স্বীয় প্রতিভার দ্বারা পূরণ করবার চেষ্টা করছেন।
রাশিদ খাঁর গলার এবং স্বরপ্রয়োগের মধ্যে আবেগ আছে যা সচরাচর এঁর ঘরানার অন্য উস্তাদদের মধ্যে পাইনি। এঁর গায়কির মধ্যে একটা বড় অংশ ওঁর উদ্ভাদ নিসার হুসেন খাঁ জুড়ে আছেন, তবে ঘরানার গতিশীলতার নিদর্শনই এই যে ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের গায়করা কিছু-না-কিছু অবদান রেখে যান। এঁর বিস্তারে কিরানার প্রভাব দেখা যায়। এতে আমি দোষের কিছু দেখি না কারণ সঙ্গীতের ইতিহাসে কোনও প্রতিভাবান গায়কই অপরিসর গণ্ডির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করে রাখতে চান না আর এই বয়সে রাশিদ খাঁর একটি নিজের মনোমতো স্টাইলের সন্ধানে বের হবার চেষ্টাও কিছু বিচিত্র নয়।
![ভাই জোড়া - ওস্তাদ আমানত আলী খান ও বড় ফাতেহ আলী খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Brother Duo - Ustad Amanat Ali Khan & Bade Fateh Ali Khan, Patiala Gharana ]](http://musicgurukulonline.com/wp-content/uploads/2022/01/Ustad-Amanat-Ali-Khan-Ustad-Fateh-Ali-Khan-Duo-300x180.jpg)
তবে বর্তমানে রাশিদ খাঁর গায়কি এবং তাঁর গুরুর গায়কির মধ্যে যথেষ্ট প্রভেদ দেখা যাচ্ছে যতটা প্রভেদ মুতাক হুসেন বা ফিদা হুসেন খাঁর সঙ্গে যৌবনে নিসার হুসেন খাঁর ছিল। কিন্তু হিসেবমতো এই দাঁড়াচ্ছে যে এক শৈলী এই চার প্রজন্ম বিশ্বক্তভাবে অনুসরণ করেননি যা ঘরানার প্রচলিত সংজ্ঞার অন্তর্গত। রাশিদ খাঁ এবং এনায়েৎ হুসেন খাঁর শাগিরদ মুতাক হুসেন খাঁর মধ্যে পার্থক্য বিশাল বললে যথেষ্ট বলা হবে না। এই কারণে সহসওয়ানকে ঘরানা না বলে খানদান বললে প্রকৃত সমঝদার মহলে অনেক বেশি গ্রাহ্য হবে।
পাতিয়ালা ঘরানা সম্পর্কে সর্বাগ্রে পাঠককে অনুরোধ করব ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী’র প্রাসঙ্গিক পরিচ্ছেদটি পড়তে। এতে আমি দেখিয়েছি কী ভাবে আলি বখশ খাঁ এবং ফতে আলি খাঁরা (আলিয়াফত্তুর) গোয়ালিয়র ঘরানার তালিম পান। ফতে আলি খাঁর কাছে কালে খাঁ তালিম পেয়েছিলেন এবং বারো বছর বয়স পর্যন্ত কালে খাঁর কাছে বড়ে গোলাম আলি খাঁ। ইনি অনেকেরই মতে এই ঘরানার শ্রেষ্ঠ উস্তাদ এবং তাঁর শৈলীর বিশ্লেষণ সংক্ষেপে এখানে করতে হবে। তার আগে তাঁর গুরু কালে খাঁ সম্পর্কে অমিয়নাথ সান্যালের ‘স্মৃতির অতলে’ পুস্তকটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের পড়া দরকার।
![ওস্তাদ বড় ফাতেহ আলী খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Ustad Bade Fateh Ali Khan, Patiala Gharana ]](http://musicgurukulonline.com/wp-content/uploads/2022/01/Ustad-Bade-Fateh-Ali-Khan-4-199x300.jpg)
“এ পর্যন্ত নানা গুণীর মুখে নানা রকমের খেয়াল শুনে ধারণা হয়েছে ধ্রুপদ গানের আনুগত্য স্বীকার করে আর বিধিনিষেধের গণ্ডিবদ্ধ হয়েই সাধারণভাবে খেয়াল গানের রূপ গড়ে উঠেছে। কিন্তু এমনও সব খেয়াল গানের রূপ দেখেছি—এগুলি আপনার নিয়মে গড়ে উঠেছে। আপন ভঙ্গিমায় আপন সম্ভ্রমে আর ইচ্ছামত জমজমা গিটকিরী তান দুনি চৌদুনির সাজে চলতে ফিরতে থেকেই আপন প্রাণের পরিচয় দেয়, আপন সুষমা পরিস্ফুট করে।
… খেয়াল গানের এই স্বচ্ছন্দ স্বতন্ত্র রূপের চরম পরিচয় ঘটেছে কালে খাঁ সাহেবের বিলমপদ আস্থায়ী শুনে। আরও মনে হয়েছে স্থপতি শিল্পের পাশ্চাত্য সমালোচকরা যাকে ‘বারোক’ স্টাইলের রচনা বলেন, বস্তুত সেই ধরনের রচনা আর বিস্তৃতি ছিল খাঁ সাহেবের গানের মধ্যে।…পরের খেয়ালে গান করা তো চাকরি করার সামিল। মাত্র এই কথাটি মনে করলে কালে খাঁ সাহেব, মৌজুদ্দিন আর আবদুল করিম খাঁকে ছাড়া আর কাউকে মনে করতে পারি না।”
জবাবে আমি লিখেছিলাম আমার বইয়েতে “মনে হওয়া উচিত ছিল বড়ে গোলাম আলি খাঁকে। তবে ‘বারোক’ এবং ‘রোকোকো’—যাকে ইংরেজিতে ফিলিগ্রি ওয়ার্ক বলে তার চূড়ান্ত। আবার মনে হয় তাও বোধ হয় নয়। কারণ বারোক শিল্প ও স্থাপত্যের জন্ম হয়েছিল classicism-এর প্রতিবাদে, যে কথা কালে খাঁ বা গোলাম আলি খাঁর শৈলী সম্পর্কে বলা যায় না কারণ এঁরা গানের স্টাইলে গোয়ালিয়রের সাঙ্গীতিক উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করেননি। এ ছাড়া বারোক আর্কিটেকচারে পরিমাণজ্ঞান সমতা ও পরিপ্রেক্ষিতকে
(perspective) অবজ্ঞা করা হয়নি যে কথা বুকে হাত দিয়ে গোলাম আলি খাঁর গান সম্পর্কে বলতে বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের গানে স্থাপত্যশিল্পের যাকে আর্কিটেকটনিক কোয়ালিটি তা পাইনি। ফৈয়াজ খাঁর গানে পেয়েছি। আমি ওঁর গানে পেয়েছি আকাশে রঙ-বেরঙের খেলা, আতসবাজি, হাউই রকেটের মেলা; তবে
![ওস্তাদ বড় গোলাম আলী খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Ustad Bade Ghulam Ali Khan, Patiala Gharana ]](http://musicgurukulonline.com/wp-content/uploads/2022/01/Ustad-Bade-Ghulam-Ali-Khan-23-184x300.jpg)
বড়ে গোলাম আলি খাঁ কলাকার ছিলেন। তাঁর পূর্বসূরীদের পাণ্ডিত্যর অহঙ্কার ওঁর ছিল পাণ্ডিত্য এবং বন্দিশের সংগ্রহ নিয়ে মাথাও ঘামাননি। জোর দিতেন রেওয়াজের ওপর, দক্ষতা ও খেলানোর ওপর। এই কারণে উনি প্রথমে মধ্যলয়ে ঝুমরা একতালে খেয়াল ধরে সন্তর্পণে বন্দিশ গাওয়া সেরে নিতেন এবং আস্থায়ী অন্তরা ভরবার কায়দা নিতান্তই বন্দিশের নায়কি অঙ্গই গাইতেন, গায়কি নয়।
এর পর মিড়যুক্ত বহলাওয়া করে সোজা ও তানে আমি মনে গোয়ালিয়রের। শুধু তাই নয়, আমি গোলাম আলি খাঁর এবং কৃষ্ণরাও শঙ্কর পণ্ডিতের গানের টেপ পাশাপাশি বাজিয়ে শুনিয়ে দেব কী সাংঘাতিক মিল ওঁদের বহলাওয়া তানের বড়ে শুনেছি, তিনিও গান বলতে বুঝতেন তান, আর রেডিওতে সেই কর্কশ কণ্ঠের তেতরা তান তিনসপ্তক জুড়ে তারাপদ চক্রবর্তী বলেছিলেন, “সদাশয় করে আমাদের বিড়াল কুকুরের ঝগড়া শোনাচ্ছেন কি হেতু?”
সলামৎ ও নজাকৎ আলিকে বাদ দিলে আমাদের নেই, শৃঙ্গার করার রেওয়াজও ছিল না, গোয়ালিয়রী বাট ও লয়কারীও নেই, সার্গম ও তানের খেলা প্রচুর তবে বড়ে গোলাম আলি খাঁর তানকারি প্রধানত দু প্রকারের। এক, গোয়ালিয়র প্যাটার্নের একহারা ও সপাট তান তিনসপ্তক জুড়ে। পালটার ওপর ভিত্তি করে তৈরি কণ্ঠে গমক বরাবর লয়ের দুনি এবং চৌদুনি তানের মোকাবিলা ওঁর পূর্বে পরে কেউ করেছেন বলে আমার হয় না।
ঘরানার গায়করা টেস্ট ইনিংস খেলায় করেন না, শ্রীকান্ত, সেহবাগ ও জয়সূর্যর মতো ওয়ান আতসবাজির ভক্ত। মুনব্বর খাঁ আমার বন্ধু আমার পাল্লায় পড়ে আমার বাড়িতে আমার সঙ্গে নোম্ তোম্ আলাপও করত এবং আসরে মুখ গম্ভীর দেখলেই সুরের বি আর দেওধর খেয়ালে সিলসিলার অভাব বলে এটিকে অভিহিত করেছেন যদিও তিনি বড়ে গোলাম আলি খাঁর বিরাট ভক্ত ছিলেন।
[ সহসওয়ান ও পাতিয়ালা ঘরানা – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়]
আরও পড়ুন: