সঙ্গীত সাধক আবদুল করিম খাঁ সাহেব সমগ্র জীবনে সাধনায় পরম ব্রহ্মকেই যে আরাধনা করিয়া গিয়াছেন তাঁহার মৃত্যু মুহূর্তের অভিনব ঘটনা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ব্রহ্মজ্ঞানী যীশুখৃস্ট এবং বিবেকানন্দের জীবনের শেষ মুহূর্তের অনুরূপ ঘটনার কথা আমরা জানি যাহা অবিশ্বাস্য হইলেও সত্য।
আবদুল করিম খাঁ
দিল্লীর নিকটস্থ সাহারানপুর জেলায় কিরানা নামক গ্রামে এক সঙ্গীতজ্ঞ পরিবারে এই সাধক জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। পিতা কালে খাঁ সাহেব ও ক্ষুণ্ণতাত আবদুল্লাহ খা সাহেবের নিকট তিনি সঙ্গীত শিক্ষা করিয়াছিলেন। খাঁ সাহেব ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাই মাত্র ৬ বৎসর বয়সেই আসরে গান গাহিয়া শ্রোতাবৃন্দকে মুগ্ধ করেন এবং ১৫ বৎসর বয়সে বরোদার রাজসভাগায়ক রূপে নিযুক্ত হন।
বরোদায় বিছুকাল থাকিবার পর ১৯০২ খৃস্টাব্দে পুনায় চলিয়া যান এবং ১৯১৬ সালে আর্যসঙ্গীত বিদ্যালয় নামক একটি সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াছিলেন। নানা সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহ করিয়া উক্ত প্রতিষ্ঠান গরীব সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের ব্যয় নির্বাহ করিতেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি বোম্বাই-এর উক্ত বিদ্যালয়ের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কিন্তু নানা কারণে মাত্র তিন বৎসরের মধ্যেই বিদ্যালয়টি বন্ধ হইয়া যায়। এর পর তিনি মিরাজে ফিরিয়া যান এবং জীবনের বাকী দিনগুলি সেইখানেই অতিবাহিত করিয়াছিলেন।
খাঁ সাহেব প্রবর্তিত ঘরণার নাম কিরানা ঘরানা। খাঁ সাহেব অত্যন্ত সুরেলা কন্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাঁহার সুমিষ্ট আলাপ পদ্ধতি এবং স্বরবিন্যাস ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। গায়কীর গুণে ও সুরসৃষ্টির মাধুর্যে সব রাগই তাঁহার কন্ঠে মূর্ত হইয়া উঠিত। মীড় ও কণ প্রয়োগে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তিনি খেয়াল ও ঠুংরী গানের প্রচার প্রসারের নি:স্বার্থ ভাবে চেষ্টা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সাফল্যের ফলশ্রুতি স্বরূপ পরবর্তীকালে আমরা পাই হীরাবাঈ, বরদেকার, সওয়াই গান্ধর্ব, সুরেশবাবু মানে, রোশনারা বেগম ইত্যাদি সঙ্গীত শিল্পীদের।
তিনি কোন দিনই স্বাস্থ্যবান ছিলেন না; কিন্তু তাঁর মন ছিল উদার ও মধুর। তাই তিনি অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মাদ্রাজ ও মিরাজে গানের অনুষ্ঠান শেষ করিয়া পণ্ডিচেরীর এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে গান গাইবার জন্য যাত্রা করেন-পথে হঠাৎ শরীর অসুস্থ হওয়াতে সিঙ্গপোয়াম কোলম স্টেশনে নামিয়া পড়েন।
সাধক করিম খাঁ সাহেব তাঁহার জীবনের শেষ দিন সমাগত বুঝিতে পারিয়া শিষ্যদের তানপুরায় সুর বাঁধিতে অনুরোধ কেরন। সুর বাঁধা হইতেই তিনি তানপুরাটি হাতে লইয়া খোদার উদ্দেশ্যে দরবারী কানাড়ার আলাপ করিতে করিতে সারা জীবনের সঞ্চিত সকল সুর পরমার্থের পায়ে অঞ্জলি দিয়া চিরদিনের মত নীরব হইয়া যান। সেই দুঃখময় দিনটি ছিল ১৯৩৭ সালের ২৭ অক্টেবর। পরে শিষ্যবৃন্দ শোকাকুল চিত্তে মিরাজে খাজাভিরা সাহেবের দরগায় তাঁহার নশ্বর দেহ সমাধিস্থ করেন।
আরও দেখুনঃ
1 thought on “আবদুল করিম খাঁ । শিল্পী জীবনী”