কথা ও সুর – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

কথা ও সুর বিষয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন :  রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে মনে পড়ছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ধূর্জটিপ্রসাদকে বলছেন, ‘বুড়ো এমনই দর বেঁধে দিয়ে গেল যে এরপর ইট উড বি ডিফিকাল্ট ফর বেঙ্গলিজ টু রাইট ব্যাড পোয়টি। দুজনই একাধারে ঘোরতর সাহেব এবং মনেপ্রাণে ঘোরতর বাঙালি। জবাব এল, ‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দা বেঙ্গলিজ, সুধীন, আমরা সব পারি।’

কথা ও সুর - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [ Kumar Prasad Mukherji ]
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [ Kumar Prasad Mukherji ]

 

রবীন্দ্রনাথ না জন্মালে কথা ও সুর নিয়ে এত আলোচনার প্রয়োজন আমরা বোধ করতাম না। পেট্টা শহর দেখে জনৈক কবির হাত থেকে একটি অসাধারণ কবিতা এবং একটিই মাত্র কবিতা বেরিয়েছিল ‘A red rose city half as old as time.’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আড়াই হাজার গানের মধ্যে যদি অর্ধেকও কথা ও সুরের ওই প্রকার অসাধারণ সমন্বয় দিতে পারে যার যে কোনও রচনার পাশে জার্মান কবি হাইনের লিডার ম্লান হয়ে যায়, তা হলে সে জিনিয়াস সম্পর্কে আমার মতো একপেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গ শীতের অনুরাগী কলাকারের কি বলবার থাকে?

রবীন্দ্রনাথও বলতেন ওঁর সব কিছু হারিয়ে গেলে ওঁর বিশ্বাস ওঁর গান বেঁচে থাকবে। বেশির ভাগ গায়ক-গায়িকা সম্পর্কে আমার মতো লোকের একমাত্র অনুযোগ যে তাঁরা যদি তাঁদের গায়কির স্টাইলাইজ্ড্ একঘেয়েমি কাটিয়ে আসরে সুর ও তাল বদলে বদলে গান গাইবার সময়ে নির্বাচনক্ষমতার পরিচয় দিতেন তা হলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যথার্থ কদর হত।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কথা ও সুরের সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর। দিলীপকুমার রায়, কথা ও সুরের মধ্যে কে স্বামী কে স্ত্রী এ নিয়ে পত্রালাপে প্রচণ্ড তর্ক জুড়ে দিয়েছিলেন আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে তানই বা কেন নেওয়া হবে না ইচ্ছামতো ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষমেশ একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ওঁর অনবদ্য ভাষায় ও ভঙ্গিতে এমনই একটি চিঠি লেখেন যে তা হাতে পেয়ে দিলীপকুমার যদি দ্বিতীয়বার সন্ন্যাস নিতেন তো আমরা কেউ আশ্চর্য হতাম না। এই চিঠিটি নিজে হাতে কপি করে ধূর্জটিপ্রসাদকে রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়েছিলেন।

দিলীপকুমার রায় [ Dilip Kumar Roy ]
দিলীপকুমার রায় [ Dilip Kumar Roy ]

 

আমাদের আলোচ্য বিষয় হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। প্রাচীনকালে প্রবন্ধগীতের ভাষা ছিল সংস্কৃত, ধ্রুপদ রচিত হয়েছে সংস্কৃত ও দেশি বা মধ্যদেশি ভাষায়। ঔরঙ্গজেবের সময় রচিত ফকিরুল্লাহর ‘রাগদর্পণ’এ লেখা আছে দেশি ভাষায় অনুষ্ঠিত ধ্রুপদ সময়ানুসারে বা স্থানানুসারে ‘খরোড়া’ ভাষায় গাওয়া হয়।

রাজ্যেশ্বর মিত্র খরোড়ার অর্থ করেছেন খড়ীবোলি বা সৎ উর্দু। উর্দু ভাষায় যে ধ্রুপদ রচিত হত এই প্রথম জানা গেল। খেয়াল প্রধানত বৃজ ভাষায়, সেইসঙ্গে সদারঙ্গ অদারঙ্গের সময় কিছু রাজস্থানি ও পঞ্জাবিতে। ঠুংরি পূর্বী অর্থাৎ কাশী মির্জাপুর জৌনপুর ওই অঞ্চলের দেহাতি বোল সহকারে গাওয়া হত এবং এখনও হয়। টপ্পা নিছক পঞ্জাবি ভাষায়। এটা আশ্চর্য কিছু নয় যদি লোকগীতি থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উদ্ভব হয়েছে এটা মেনে নিতে আমাদের

কোনও অসুবিধে না থাকে। আশ্চর্য এইটুকুই যে পাঠান ও মুঘল আমলে দরবারের ভাষা ছিল ফারসি ও হারেমের ভাষা ছিল চুঘতাই তুর্কি, কিন্তু দরবারি পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও সাধারণী ভাষায় রচিত গীতকে অবজ্ঞা করা হয়নি। এর থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে উচ্চাঙ্গের মার্গ-দেশি সঙ্গীত জনসাধারণের রুচি বহির্ভূত ছিল না এবং নিছক দরবারের মধ্যে আবদ্ধও ছিল না। আর ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে ইংরেজদের মতো পাঠান বা মুঘলরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেননি। এঁরা সত্যই কবির ভাষায় এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছিলেন।

শোনা গল্প। আমাদের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি কবে অক্সফোর্ডে নীরদ চৌধুরী মশায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। হিন্দুত্ব সম্পর্কে কথা পাড়ায় নীরদবাবু জিজ্ঞেস করেন মন্ত্রীমহোদয়ের সংস্কৃত জ্ঞান কি প্রকারের? উনি সংস্কৃত জানেন না শুনে উনি এক কথায় ওই প্রকারের আলোচনাকে বরখাস্ত করে দিলেন। যে মানুষটা সংস্কৃত পড়েনি, জানে না, তার সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে নীরদবাবুর মতো মানুষ আর কি আলোচনা করবেন? গল্পটি সত্যি যদি নাও হয় তো ভাল এবং শিক্ষামূলক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore with Students ]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [ Rabindranath Tagore with Students ]

 

ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ প্রাসঙ্গিক না হলেও বছর আষ্টেক আগে যা লিখেছিলাম ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’-তে তা আর একবার হিন্দু মুসলমান সব ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসের ছাত্রদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরা বরাবরই প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছেন ভারতবর্ষ বহু জাতি, বহুবিধ ভাষা, অভ্যাস ও ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির একটি জীবন্ত প্রদর্শনশালা এবং তৎকালীন সদাশয় ইংরেজ সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় তারা একত্র হয়েছে বটে তবে তাদের মধ্যে কোনও ঐক্য নেই। ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় তাঁর The Fundamental Unity of India নামক গ্রন্থে ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্যর তত্ত্বটি প্রথম তুলে ধরেন।

ভিনসেন্ট স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকরাও দেখাদেখি স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্নতার মধ্যে ঐক্য (ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি) এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন [য] যা আজকাল রাজনীতির জগতে ভারতবর্ষ খণ্ডাখণ্ডের সম্মুখীন হয়ে নেতাদের ধরতাই বুলি হয়েছে। কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মুসলমানদের দান এবং হিন্দু মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মিলন সম্পর্কে তাঁরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে মনে হয় না। অজন্তার পর আমাদের চিত্রকলার ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত।

আলাউদ্দিন খিলজি [ Alauddin Khalji ]
আলাউদ্দিন খিলজি [ Alauddin Khalji ]

 

কাংড়া রাজপুত ও মুঘল পেন্টিংকে কারুশিল্পই (craft) বলা উচিত কারণ আমাদের পটুয়াদের মতো সারা পরিবার ছবি আঁকায় লেগে থাকতেন। এ ভারতীয় হলেও কার্যকৌশল ও ভঙ্গিমার দিক থেকে পারস্যের মিনিয়েচার পেন্টিং-এর প্রভাব তার ওপর সুস্পষ্ট। উত্তর ভারতে নিছক হিন্দু ভাস্কর্য ও স্থাপত্য যৎসামান্যই অবশিষ্ট আছে। কারণ পাঠান মুঘল থেকে নাদির শাহ পর্যন্ত সকলেরই রাগ ছিল পৌত্তলিকতার ওপর এবং সেগুলোকে সর্বাগ্রে ভাঙা হত।

স্থাপত্য শিল্পে হিন্দু ও মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয়ের উদাহরণ প্রচুর। আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে আড়াই দিন কা ঝোপড়া দেখলে বোঝা যায় কিভাবে বাদশাহর হুকুমে মন্দিরকে আড়াই দিনে মসজিদ বানানো হয়েছিল। কুতবমিনারের পাশে আলাই দরওয়াজা দেখলে আরও বোঝা যায় কিভাবে মন্দিরের কারুকার্যবহুল থাম উপড়ে এনে ব্যবহার

করা হয়েছে। কোরানে আল্লার সৃষ্ট কোনও প্রাণী, উদ্ভিদের ছবি বা মূর্তির ব্যবহার মানা, কারণ তা খোদার ওপর খোদকারির পর্যায়ে পড়ে। এই কারণে জ্যামিতিক লাইন ড্রয়িং ও Arabesque এরই ব্যবহার পাঠান ও গোড়ার দিকের মোগল স্থাপত্যের নমুনায় পাই।

যাঁরা কুতবমিনার ও সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধি দর্শন করেছেন তাঁরা এর অর্থ সহজে বুঝবেন। কিন্তু হিন্দুদের মন্দিরের পাথর উপড়ে এনে ব্যবহার করায় এ সংস্কার বাদশাহরা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং খোলাখুলিই হিন্দু কারিগরকে দিয়ে প্রাসাদ ও মরার গায়ে ফুল লতাপাতা খোদাই করতে শুরু করলেন, যার পরাকাষ্ঠা আগ্রার ফতেপুর সিক্রিতে।

Ustad Bade Ghulam Ali Khan 23
হিন্দু ও মুসলমানের সংস্কৃতির সমন্বয়ের উদাহরণ ওস্তাদ বড় গোলাম আলী খানের মতো ধর্মপ্রাণ মুসলিম গায়ক গেয়েছেন “হরি ওম তৎসৎ”।

 

জাহাঙ্গীর আরও এক কদম এগিয়ে শ্বশুরের কবরের ওপর শতেক ডিক্যান্টার ও পানপাত্র খোদাই করে দিলেন। এই এতমাদউদ্দৌলার মধ্যে নূরজাহানের হাতে বোনা একটি চমৎকার লেসের নক্শার ওপর ভিত্তি করে একটি ডোমের ভেতরের অংশটির কারুকার্য করা হয়েছে। এর থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে বিদেশি মুসলমান যখন ভারতীয় হয়ে গেল তখন বিলাসব্যসন বা সৌন্দর্যপ্রীতির ব্যাপারে কোরানের অনুশাসন বড় একটা মেনে চলত না। এক ঔরঙ্গজেব ছাড়া, যাঁর দাক্ষিণাত্যে বিবি কা মরার ভেতরে কবর দেখলে দরিদ্র মুসলমানও লজ্জা পায়।

হিন্দু মুসলমানের নিরুপদ্রব সামাজিক সহাবস্থানের সবচেয়ে বড় নিদর্শন উর্দু ভাষার জন্ম। আমাদের সময়ে যে ভাষা উত্তর ভারতে চালু ছিল তার নাম হিন্দুস্থানি, এ ভাষার বাপ মা উর্দু ও হিন্দি গ্রামেগঞ্জে হিন্দু মুসলমান সবাই দেহাতি ভাষায় কথা বলত এবং পালাপার্বণে হিন্দু মুসলমান একত্র হতেন। কবির লড়াই, পালাগান, যাত্রা, নটস্কি, মুশায়রা, কবিসম্মেলন— বাল্যকালে সর্বত্রই হিন্দু মুসলমানকে ভাগ নিতে দেখেছি এবং শুনেছি।

উত্তরপ্রদেশে কাপড়চোপড়েও কোনও প্রভেদ ছিল না। আর খাওয়া দাওয়া? মধ্য এশিয়া থেকে মুঘলরা এসেছিল শল্যপক মাংস আর ফল খেতে খেতে। এখন অবশ্য ইরান, সৌদি আরবে আমরা গুঁড়ো মশলা রপ্তানি করি তাতে তাদের কুইজিনেরও কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। অ্যালজিরিয়া মরক্কোতে তাদের নেটিভ খাদ্য আস্বাদন করে কিছু উল্লসিত হইনি যদিও মনে আশা ছিল ফরাসিদের রাজত্বের প্রভাব কিছুটা নিশ্চয়ই পড়ে থাকবে। এর প্রধান কারণ মশলার অভাব। তথাকথিত মোগলাই খানা মোঙ্গলদের পিতৃপুরুষের খানা নয়। এ ভারতের হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত দান।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

বিরিয়ানি জীবনে অনেক জায়গায় খেয়েছি, সর্বোৎকৃষ্ট বিরিয়ানি খেয়েছি বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের জীবিতাবস্থায় তাঁর বাড়িতে। লখনউয়ের ভোজনরসিকরা বলতেন বিরিয়ানি বারোয়ারি থানার জন্য, খায় দিল্লির লোকে, লখনউয়ের পুলাও খায় অবধের খাদ্যরসিকে। বিরিয়ানিতে মশলা বেশি পড়ে, পুলাও সে তুলনায় অনেক সাধাসিধে কিন্তু তার স্বাদ অপূর্ব। পুলাওয়ের সঙ্গে খাওয়া হত কোরমা।

শুনেছি সেকালে অর্থাৎ পুরাতন লখনউয়ের নবাব তালুকদাররা যে মুর্গির কোরমা খেতেন তাকে নিয়মিত কেসরের গুলি খাওয়ানো হত। গো-মাংস আমার জানাশুনো ভদ্র মুসলমানদের খেতে দেখিনি তবে শীরমালের অর্থাৎ দুধে ময়দায় তৈরি রোগনি রুটির জন্য রামপুরের নবাবের বাবুর্চিখানায় যে গরুর দুধ আসত তাকে শুনেছি নিয়মিত গোলাপের পাপড়ি খাওয়ানো হত।

নবাব রেজা আলি খাঁ-র দুই জামাইয়ের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। ছোট সুদর্শন মেহতা কলকাতায় শ ওয়ালেস কোম্পানিতে বড় কাজ করতেন, বড় জামাই সৈয়দ নুরুল হাসান পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর, প্রোফেসর ডি পি-র অর্থাৎ ধূর্জটিপ্রসাদের সাকরেদ স্থানীয় ছিলেন। এঁদের কৃপায় রামপুরের বাবুর্চিদের হাতে প্রস্তুত নারগিসি, শামী, শিক ও কাকোরি কাবাব, চিকেন হাণ্ডী ও যখনি, বাকরখানি এবং রুমালি রুটির সঙ্গে খাওয়ার স্মৃতি এখনও আমার দুচোখ জলে ভরিয়ে দেয়। সর্বোৎকৃষ্ট লখনউয়ের খানা পাওয়া যেত শুধু মুসলমানদের নয় বনেদী কায়স্থদের দস্তরখানে।

উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ [ Ustad Abdul Karim Khan, 11 November 1872 – 27 October 1937, Founder of the Kirana gharana of classical music ]
উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ [ Ustad Abdul Karim Khan, 11 November 1872 – 27 October 1937, Founder of the Kirana gharana of classical music ]

 

খাওয়াদাওয়ার কথাবার্তা শুরু হলে আমার আবার মুখের ও কলমের লাগাম থাকে না, অতএব সে প্রসঙ্গ আপাতত এখানেই থাক। সবচেয়ে বেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একীকরণ হয়েছিল সঙ্গীতে। হিন্দু মুসলমানরা ভাবাবেশের আবেগে বৃজভাষায় হোরি ধামার আর করিম রহিমের স্তুতি করে আনন্দ পেয়েছেন। গোয়ালিয়রের হদ্দু খাঁ বেছে বেছে ব্রাহ্মণ সাকরেদ তৈরি করেছেন কারণ তাদের দিমাক নাকি আলা দরজে কা।

আবদুল করিম খাঁ তাজউদ্দিনও সিরধির সাঁইবাবাকে ভজন শোনাতেন ‘হরিকে ভেদ না পায়ো রামা, কুদরৎ তোরি রঙ্গিবিরঙ্গী’ আর ধ্রুপদের সাহিত্য তো প্রধানত হিন্দু দেবদেবীদের স্তুতিতেই রচিত। এ এমন একটা জগৎ যেখানে ভাস্করবুয়া কট্টর হিন্দু হয়েও ওস্তাদের জন্য নাক টিপে গোস্ত রান্না করে খাওয়াচ্ছেন, খুর্দার জহুর খাঁ রামদাস তখলুস বা উপনাম গ্রহণ করে খেয়ালের বন্দিশ বানাচ্ছেন। কাবুলি পাঠান স্বপ্নে কৃষ্ণদর্শন করে আফগানিস্থান থেকে মথুরায় এসে রসখান নাম দিয়ে বহু গান রচনা করে গেয়েছেন ও শিখিয়েছেন। একটা মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। মনে রাখবেন এ একটি কাবুলির রচনা।

রাগ ললিত। তিন তাল।

ঠাডোরি বনবারী,

নিত উঠ হমসো ঝগড় করত হৈ,

মানে না কাউকি দুহাই।

যাঁউ তোপে বলিহারী,

আন মিলে রসখানেকি প্রীতম, নন্দনন্দন মোরে প্যারে চিতবনসে হার গয়ি বুজনারী।।

এ সবই রচিত বৃজভাষায় যার ব্যাপ্তি ছিল দিল্লি থেকে মথুরা বৃন্দাবন আগ্রা হয়ে গোয়ালিয়র পর্যন্ত। যাঁরা এই গ্রাম্য ভাষায় রচিত নিম্নমানের কাব্যগীতি শুনে নাক সেঁটকান তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে লোকগীতির ভিত্তির ওপরই এসব রচনার বুনিয়াদ এবং যেহেতু এগুলি ব্রজভূমির সঙ্গীত, এতে শ্রীকৃষ্ণর বাললীলা, রাধিকার অভিসার, সাস ননদের ভীতি, নায়িকাভেদ এসবের পিছনে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক যথার্থতা বিদ্যমান এবং সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বৈষ্ণব সাহিত্যে এর ছড়াছড়ি।

Ustad Faiyaz Khan (1886-1950) - Great Master of Agra Gharana
Ustad Faiyaz Khan (1886-1950) – Great Master of Agra Gharana

 

আমাদের কীর্তনের বিষয়ও ওই একই। উপরন্তু ধ্রুপদের মতো এ নিবিড়ভাবে নিবন্ধ নয়, সেইজন্য স্টাইলের খাতিরে এমন একটা ভাষার প্রয়োজন ছিল যাতে অন্যান্য গ্রাম্য ভাষার মতো যুক্তাক্ষর ন্যূনতম এবং স্বরবর্ণ দীর্ঘায়িত। সংস্কৃত বাংলা বা শুদ্ধ হিন্দির মতো মার্জিত সোফিস্টিকেটেড ভাষায় রচিত গান নিয়ে যথেচ্ছ খেলা করা যায় না, বোল বাট তেহাই

তো নয়ই। জয়জয়ন্তীতে মোরে মন্দর নামক বিখ্যাত ফৈয়াজ খাঁ-র রচনায় রেকর্ডে তান করে উনিই ‘কিন সোতন বিরমায়ে, বিরমায়ে, বিরমায়ে’ বলে তেহাই নিয়েছেন। বেখাপ্পা শোনায়নি। ওই বন্দিশেরই অনুকরণে দীপালি তালুকদারের (নাগ) ‘মেঘ মেদুর বরষায়’ নামক গানে যদি উনি ফুল ছড়ায়ে ‘কাদে ব, কাঁদে ব, কাঁদে বনভূমি’ তেহাই নিতেন তো আসরে হট্টগোল পড়ে যেত।

বাংলা ভাষায় রাগাশ্রয়ী বাংলা গান হতে পারে, খেয়াল করে গাওয়া মুশকিল। এই কারণেই ঠুংরিও জন্মেছে পূরবে এবং রচিত হয়েছে কাশী মির্জাপুর জৌনপুর অঞ্চলের গ্রাম্য পূর্বী ভাষায়। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ভৈরবীতে ‘লাগত করেজুয়ামে চোট নিয়ে বোল বানানো যায় কিন্তু সোফিস্টিকরণ করে ‘লগি জিগরমে চোট নিয়ে গলা খেলানো শক্ত। ‘ওরে সুজন নাইয়া’র মতো করেজুয়ার দীর্ঘ আকার গলা খেলানোয় সাহায্য করে।

রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ

 

খেয়াল ঠুংরিতে ভাষার মূল্য কি প্রকারের? ১৯৮৮-র অক্টোবরে শিশিরমঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির আয়োজিত ‘হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে কথার স্থান’ শীর্ষক একটি আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম না। যেসব বিদগ্ধ ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন তাঁরা যথাক্রমে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, রাজ্যেশ্বর মিত্র, অজয় সিংহ রায়, দীপালি নাগ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র, অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, মানস চক্রবর্তী, অজয় চক্রবর্তী, নিমাইচাঁদ বড়াল, অরুণ ভাদুড়ী, অরুণ বসু ও মশকুর আলি খাঁ। এঁদের মতামত একটি পুস্তিকাকারে বেরিয়েছে, সেইসঙ্গে মালবিকা কানেরও ছোট একটি প্রবন্ধ।

ধ্রুপদ রচয়িতারা শুধু শৈলী নয় কাব্যগুণের দিকেও নজর দিতেন এবং নিবদ্ধ সঙ্গীতে উচ্চমানের কাব্যের প্রয়োজন এ নিয়ে মনে হয় না কোনও মতদ্বৈধ হয়েছিল বা আছে। যাঁরা খেয়াল ও ঠুংরিতে কথার স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেন তাঁদেরই দেখছি এই আলোচনায় পাল্লা ভারী ছিল। এঁদের মধ্যে শুধু জ্ঞানবাবু এবং তাঁদের শিষ্যরা নয়, সুর ও কথার সাম্যভাব, শুদ্ধ বাণী, শুদ্ধ উচ্চারণ ইত্যাদির প্রয়োজন সবাই অনুভব করেছেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এ আমরাও সবাই করি। একথায় এ বক্তব্য যাকে বলে জজে মানে। কিন্তু উচ্চমানের কাব্যগীতির প্রয়োজন খেয়ালে ও ঠুংরিতে এই কারণে যে কথা সুরের সমানই গুরুত্বপূর্ণ এ নিয়ে আমার মনে একটি ধন্দ আছে। একমাত্র অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় দেখছি মনে করেন। খেয়াল বা ঠুংরিতে কথার স্থান গৌণ। তাঁর বক্তব্য,

যখন গানগুলি শুনি তখন কথায় আমরা কতটা আকৃষ্ট হই, কাব্যের স্বাদ কি আমরা গ্রহণ করি? সুরেই আমাদের একাত্মতা, গান গানের সৌন্দর্যেই অভিভূত করে, কথার ভাবে নয় … লাগী লগন পতি সখি সন— হংসধ্বনির এ গানটি কী ভাব বহন করে, আমরা সেদিকে ফিরেও তাকাই না। কারণ, তার আগেই আমাদের চমক লাগিয়ে দেয় তার সুর।… সুরের টানা আঁচড় বা সূক্ষ্ম মোচড় রাগেরই এক এক অভিব্যক্তি, কথা সেখানে নামমাত্র।

মীড় গমক প্রভৃতি অলঙ্কারে কথাও যুক্ত হয়, কিন্তু কোনও তাৎপর্য নিয়ে নয়—সেখানে তা ধ্বনিব্যঞ্জনার কারকে হয়ে দাঁড়ায়। বাঁট-বোলতানে অর্থের অন্যথা ঘটে এবং ঘটে ব’লেই তা শব্দঝঙ্কারের এক অসামান্য অনুভূতি সৃষ্ট করতে পারে।… উচ্চাঙ্গ সংগীতে আমাদের মানসিক প্রস্তুতি ভিন্ন। যাই হোক, উচ্চাঙ্গ সংগীতে কথা আছে এবং থাকবেও, কিন্তু গৌণভাবে, যেমনভাবে আমরা এযাবৎ গ্রহণ করেছি।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

সেভাবে। চোখের সামনে থাকবে রাগ শিল্পকলা, কথা থাকবে আড়ালে। একমাত্র শব্দঝঙ্কারই তার প্রত্যক্ষ অবদান। কথা কখনও কখনও সুরকে আড়াল করে ফেলে নয়, কথার বিশিষ্ট ব্যঞ্জনায় প্রকাশভঙ্গির গুণে সম্ভব, তবে আড়াল যেন ক্ষণিকের হয়, হলে রাগের ক্ষতি।’ কথা সুর নিয়ে বড় বড় লোকেরা মতামত দিয়েছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ থেকে করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, দিলীপকুমার, ধূর্জটিপ্রসাদ প্রমুখ। তাঁদের কথায় আসবার আগে আমার কিছু চিন্তা মনে জাগছে।

নন্দনতত্ত্বের বিখ্যাত পণ্ডিত আনন্দ কুমারস্বামী তাঁর Figures of speech, figures thought পুস্তকে লিখছেন চিন্তা মনে আসে ভাষার রূপ ধরে। ভাষার দুটি উপাদান— ইমেজ, ভাবমূর্তি দৃশ্যরূপ এবং সিম্বল বা প্রতীক। সবুজ বললে কারও চোখের সামনে সবুজ শাড়ি দেখা দেয়। কারও সামনে বিস্তৃত গড়ের মাঠ, কেউ মনশ্চক্ষে দেখেন অরণ্যানী। হল ইমেজ। সিম্বল হল রে গা ধা নি–যা চোখের সামনে কোনও দৃশ্যরূপ খাড়া করে না।

প্রথমটিকে কুমারস্বামী সিমেট্রিকাল বলেছেন অর্থাৎ কথার সঙ্গে মূর্তির সংযোগ আছে, দ্বিতীয়টি অ্যাসিমেট্রিকাল অর্থাৎ রে মা পা এই স্বরগুলি সিম্বল মাত্র, থেকে আমাদের মনে কোনও দৃশ্য বা মূর্তি ভেসে ওঠে না। এর থেকে উনি ওঁর প্রতিপাদ্য বিষয়ে পৌঁছেছেন যে রূপ (form) এবং বিষয়বস্তুর (content) মধ্যে কোনও শ্রেণীবিভাগ নেই। বিষয় বদলালে রূপও বদলাবে। সিদ্ধান্তর সঙ্গে আমার আপাতত পেশ করার বিষয়ের সম্পর্ক নেই।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষার গান নেওয়া যাক। সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণ ধারা’ শুনলে মনে পড়ে লখনউয়ে আলকাতরার মতো গভীর বর্ষামুখর রাতে আমি সাইকেলে ফৈয়াজ খাঁ-র গান শুনে কাকভেজা হয়ে ফিরছি। পাড়াতুতো ভাইপো অভিজিতের মনে পড়ে গরম গরম বেগুনি ফুলুরি সহকারে তেলমুড়ি খাওয়া, বাইরে অঝোরে বৃষ্টি।

তার বাবা পুরনো কালের লোক, সেই স্বর্ণযুগের, যখন সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে ভুনি খিচুড়ির সঙ্গে বর্ষার রাতে গলদা চিংড়ির কালিয়া রান্না হত এবং সে দৃশ্যরূপ তাঁর মানসপটে ভেসে ওঠা কিছু অযৌক্তিক নয়। অতএব ইউনিভার্সাল ইমেজ বলে কিছু নেই। কথা যে ইমেজের জন্ম দেয় তা নিতান্তই ব্যক্তিগত, সাবজেক্টিভ।

রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ

তা হলে মনে করুন “ঘটা ঘন ঘোর, গরজত বরসত মেহা” বললে যদি এমন কোনও ইমেজ চোখের সামনে ভেসে ওঠে যা মহলারের স্বরপ্রয়োগের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের সঙ্গে বিরোধ বাধায় তা হলে তো বিপদ। এর সঙ্গে উচ্চ বা নিম্নমানের কাব্যের কোনও সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক সুরের সঙ্গে কথার এবং কথার সঙ্গে ইমেজের।

২. কাব্যে কথার বাহুল্য কম বলেই তার ভাবের ভার বহন করার শক্তি বেশি, যেমন রবীন্দ্রনাথের দুটি মাত্র লাইন। প্রয়োজন নেই আর লেখবার।

ফুলগুলি যেন কথা,

পাতাগুলি যেন চারি দিকে তার পৃঞ্জিত নীরবতা। [‘লেখন’]।

কথা কমে এলে ভাবের গুরুত্ব বাড়ে। এই জন্যই গদ্যের তুলনায় কাব্যের ভাবপ্রকাশের সীমানা আরও বিস্তৃত। যখন ভাব বড় হয়ে উঠছে, তখন মন চায় কথা কমুক। যখন ভাব গভীর হয় তখন মানুষ মৌনতা অবলম্বন করে। অল্প শোকে কাতর, গভীর শোকে পাথর। বলিউডের ‘স্যাড সং’-এর ডিরেক্টর এ কথা না মানলেও সব ভাবই গভীর হয়ে উঠলে কথার উপস্থিতি অস্বীকার করে। এ বক্তব্য যদি সত্য হ’ত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে কথার মূল্য কী প্রকার?

৩. সঙ্গীতের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে ভাষা সাহিত্যনির্ভর নয়। আবহমানকাল ধরে সাহিত্য অন্যান্য সব আর্টের ওপর প্রভুত্ব করে এসেছে। ছবি আঁকা হয়েছে বুদ্ধের জন্মবৃত্তান্ত ও জীবনী নিয়ে অজন্তায়, কাংড়া ও রাজপুত পেন্টিং তাকিয়ে থেকেছে কৃষ্ণলীলার দিকে, গ্রীক ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্প তাদের নিজস্ব পুরাণের ওপর ঘোরতর নির্ভরশীল ছিল।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

তাই তাদের জগদ্বিখ্যাত মূর্তি ভেনাসের, অ্যাপোলোর জিউস, ডায়ানা, অ্যাফ্রোদিতি, এথিনা, হেরা অর্থাৎ জুনোর মন্দির ও মূর্তি, ফ্রিজে পার্সিউসের কীর্তি, হিপ্পোডামিয়ার সেন্টার কর্তৃক অপহরণ, মেডুসার মস্তক ইত্যাদি ইত্যাদি। রেনেসাঁস পেন্টিং-এ বাইবেল বর্ণিত চরিত্র ও দৃশ্যের ছড়াছড়ি। সঙ্গীতও চিরকালই সাহিত্যনির্ভর। কিন্তু বিমূর্ত সঙ্গীত অর্থাৎ যন্ত্রসঙ্গীত কিংবা ধ্রুপদী আলাপ যাকে আমরা Pure music বলতে পারি শুনলেই বোঝা যাবে যে তার ফ্রেজ আছে, সিনট্যাক্স আছে, বাক্য রচনার ক্ষমতা আছে।

প্রয়োজন শুধু স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের রি রে না না তোম যা হল হরি ওম অনন্ত নারায়ণের অপভ্রংশ। এতে আমার সাহিত্যের ভাষার কোনও প্রয়োজন হচ্ছে না। তরানাতেও নয়। নিবন্ধ সঙ্গীতে যখন কথা আসছে তখনই গায়ককে সাবধান হতে হচ্ছে, পাছে ভুল জায়গায় ঝোঁক না পড়ে, বোল বাটের সময় কথা গুলিয়ে গিয়ে শ্রোতার হাসির খোরাক না জোগায়।

সুরের ধর্ম কি? রাগের গভীরে ঢুকলে, তার রাগাঙ্গের স্বরসমূহের সঙ্গে পরিচয় থাকলে প্রতিটি স্বর, আমি গায়ক হিসেবে উপলব্ধি করেছি, প্রতিটি স্বরই বলে দেবে এর পর কী স্বর আসছে। সে তখন নিজেই নিজের স্রষ্টা। এটাই হল সঙ্গীতের নিজস্ব ভাষা, এটাই তার স্বরূপ। এখানে অযথা কথার বাহুল্য দিয়ে স্বরের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করার কি প্রয়োজন?Indian Classical Music Drawing 2

৪. শেষ যখন আবদুল করিম কলকাতায় এসেছিলেন, অল বেঙ্গলের কর্মকর্তা ভূপেন ঘোষের বাড়িতে ওঁর আসর বসেছিল। সকলের অনুরোধে উনি ‘যমুনা কি তীর’ ওঁর বিখ্যাত ভৈরবী ঠুংরি দিয়ে শেষ করেন। গেয়েছিলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক, শ্রোতারা সম্মোহিত হয়ে শুনেছিল। একজন ওরই মধ্যে আকাট প্রশ্ন করেছিল ‘খাঁ সাহেব আপনি অন্তরা গাইলেন না??

আবদুল করিম বললেন ‘খেয়াল ছিল না বাবু সাহেব, তা সব শুনে কি অন্তরার অভাবটাই আপনি বোধ করলেন? আপকো লগা কৈসা?’ শুধু ‘যমুনা কি তীর’ নিয়ে উনি ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে দিলেন। উপস্থিত শ্রোতাদের বাহ্যজ্ঞান ছিল। না। ওই একজন ছাড়া অন্তরার অভাব কাউকে পীড়া দেয়নি।

বনফুলের সেই গল্পটাই মনে করুন না কেন? এক ভদ্রলোক শহরের এক বিখ্যাত কালোয়াতি গানের আসরে প্রথম গেছেন। বাড়ি ফিরেছেন ক্লান্ত হয়ে। গিন্নি জিজ্ঞেস করছেন ‘কি রকম শুনলে বড় ওস্তাদের গান?’ ভদ্রলোকের চক্ষু নির্মীলিত, কোনও জবাব নেই। আবার

প্রশ্ন ‘হ্যাগা কি শুনলে আড়াই ঘণ্টা ধরে, বলই না?’ গভীর নিশ্বাস ফেলে ভদ্রলোক জবাব দিলেন ‘বুঁদেরিয়া,’ বলে পাশবালিশ আঁকড়ে আবার চক্ষু বুজলেন। ‘করিম নাম তেরো’ অদারঙ্গের বিখ্যাত মিঞা মহলারের গান, অস্থায়ী অন্তরার ভাষায় বর্ষার নামগন্ধ নেই। কিন্তু তাতে কি কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়েছে?

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

আমীর খাঁ যদি ‘করিম না তেরো’র পরিবর্তের ‘আমীর নাম মেরো’ বলে গাইতেন তা হলেও মিঞা মহলার মিঞা মহলারই থাকত। আমি অমিয়বাবুর সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত যে বিলম্বিত খেয়ালে অন্তত গায়ক কথার উপস্থিতির প্রতি মনোযোগ দেন না, দেন স্বরসমূহের ব্যঞ্জনার দিকে, কথা তখন গৌণ, কথার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণর ব্যবহার মুখ্য। কথার ভাব তখন গায়ককে স্পর্শ করে না শ্রোতাদেরও নয়। রচনার কাব্যগুণ উচ্চমানের কি না সে নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না।

এবার দ্রুত খেয়াল দেখা যাক। এখানে বন্দিশ একটু আঁটোসাঁটো হওয়ার প্রয়োজন আছে। কিন্তু যখন ছায়ানটে এনায়েত্ হসেন খাঁ-র বিখ্যাত ‘ঝনন ঝনন’ গাওয়া হচ্ছে তখন আমি অন্তত মনশ্চক্ষে পূজা করনকো নিকসি ঘর সোঁ’ সুন্দরী নারী ছম ছম করে নূপুর বাজিয়ে চলছে এ দৃশ্য দেখতে পাই না। সচেতনভাবে যখন কথাগুলি বলছি তখনও নয়।

গাইবার সময় ঝ ন ন ন ন না বা, রেগ গ ম ম প প-র সঙ্গে সঙ্গে অনুপ্রাসের মজা পাচ্ছি। শ্রোতারাও পাচ্ছেন। এ না হলে ফৈয়াজ বী-র কণ্ঠে ‘ঝন ঝন পায়েল জাগে মোরে সাস ননদিয়া, ঔর দেওরনিয়া, ঔর জেঠনিয়া’ নিম্নমানের কাব্য হলেও সেকালে আসর মাতিয়ে রাখত না।

ভাল বন্দিশ আমি বলব তাকে যা রাগের মূল স্বরসমূহ বা ফ্রেজগুলিকে হাইলাইট করে শব্দের মাধ্যমে এবং সে শব্দসমূহের চয়ন যেন লাগসই হয়, ওই ফ্রেজের অভিব্যক্তির অন্তরায় না হয়। এ জন্য কথার অযথা বাহুল্য বর্জন করা উচিত। শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকরের বহু বন্দিশ অতি উচ্চমানের কিন্তু বেশ কয়েকটিতে কথার বাহুল্য আছে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

রবীন্দ্রনাথের মতো একাধারে অসামান্য শক্তিশালী কাব্যপ্রতিভার অধিকারী ও গায়ক হলে তবেই হরগৌরীর মিলন সম্ভব, নচেৎ নয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আর্যগাথা’র সমালোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৩০১-এর অগ্রহায়ণে। গানে কথার অপেক্ষা সুরেরই প্রাধান্য। সুর খুলিয়া লইলে অনেক সময়ে গানের কথা অত্যন্ত শ্রীহীন এবং অর্থশূন্য হইয়া পড়ে এবং সেইরূপই হওয়া উচিত।

কারণ, সঙ্গীতের দ্বারা যখন আমরা ভাব ব্যক্ত করিতে চাহি তখন কথাকে উপলক্ষ্য মাত্র করাই আবশ্যক; কথার দ্বারাই যদি সকল কথা বলা হইয়া যায় তবে সঙ্গীত সেখানে খর্ব হইয়া পড়ে। কথার দ্বারা আমরা যাহা ব্যক্ত করিয়া থাকি তাহা বহুলপরিমাণে সুস্পষ্ট সুপরিস্ফুট—কিন্তু আমাদের মনে অনেক সময় এমন সকল ভাবের উদয় হয় যাহা নাম রূপে নির্দেশ বা বর্ণনায় প্রকাশ করিতে পারি না, যাহা কথার অতীত, যাহা অহৈতুক —

সেই সকল ভাব, অন্তরাত্মার সেই সমস্ত আবেগ, উদ্বেগগুলি সঙ্গীতেই বিশুদ্ধ রূপে ব্যক্ত হইতে পারে। হিন্দুস্থানী গানে কথা এতই যৎসামান্য যে, তাহাতে আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না… হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ সুরপ্রবাহকে বিচিত্র শব্দ সংঘর্ষ এবং বাধার দ্বারা উচ্ছ্বসিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়া তোলে, অর্থগৌরব বা কাব্যসৌন্দর্যের দ্বারা তাহাকে অতিক্রম করিতে চেষ্টা করে না। ১২৮৮ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন “আমাদের ভাবপ্রকাশের দুটি উপকরণ আছে—’কথা ও সুর’।

কথাও যতখানি ভাব প্রকাশ করে, সুরও প্রায় ততখানি ভাব প্রকাশ করে। অতএব ভাবপ্রকাশের অঙ্গের মধ্যে কথা ও সুর উভয়কেই পাশাপাশি ধরা যাইতে পারে। সুরের ভাষা ও কথার ভাষা উভয় ভাষায় মিশিয়া আমাদের ভাবের ভাষা নির্মাণ করে।” (সংগীতচিন্তা, পৃ. ১৮)।

এ সেই কথা ও সুরের দাম্পত্য মিলন। এবারে পড়ুন ১৩১৯-এ অর্থাৎ একত্রিশ বছর পরে কবিগুরুর বক্তব্য।

রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ

 

দ্বিতীয়বার বিলাতে যাইবার পূর্বদিন সায়াহে বেথুন সোসাইটির আমন্ত্রণে মেডিকাল কলেজ হলে আমি প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলাম… যন্ত্রসঙ্গীতের কথা ছাড়িয়া দিয়া আমি গেয় সংগীত সম্বন্ধে ইহাই বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, গানের কথাকেই গানের সুরের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়া তোলা এই শ্রেণীর সংগীতের মুখ্য উদ্দেশ্য।

… কিন্তু, যে মতটিকে তখন এত স্পর্ধার সঙ্গে ব্যক্ত করিয়াছিলাম সে মতটি যে সত্য নয়, সে কথা আজ স্বীকার করিব। গীতিকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র।

গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে? বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেখানেই গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেইখানেই গানের প্রভাব। বাক্য যাহা বলিতে পারে না। গান তাহাই বলে। এইজন্য গানের কথাগুলিতে কথার উপদ্রব যতই কম থাকে ততই ভালো।

হিন্দুস্থানী গানের কথা সাধারণত এতই অকিঞ্চিৎকর যে তাহাদিগকে অতিক্রম করিয়া সুর আপনার আবেদন অনায়াসে প্রচার করিতে পারে। এইরূপে রাগিণী যেখানে শুদ্ধমাত্র স্বররূপেই আমাদের চিত্তকে অপরূপ ভাবে জাগ্রত করিতে পারে সেইখানেই সংগীতের উৎকর্ষ। কিন্তু, বাংলাদেশে বহুকাল হইতে কথারই আধিপত্য এত বেশি যে, এখানে বিশুদ্ধ সংগীত নিজের স্বাধীন অধিকারটি লাভ করিতে পারে নাই। (সংগীতচিন্তা পৃ. ২২)।

অলমতি বিস্তরেণ। খুবই বড় মাপের ইন্টেলেকচুয়াল ইন্টেগ্রিটি থাকলে মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করে মত পালটাতে পারে। রাজার জাতের এক সঙ্গীতজ্ঞ উইনফ্রেড মেলার্সের বক্তব্য এবার শুনুনIndian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

The great middlebrow public is apt to distrust what one might call the contemporary aesthetic because it is more interested in ideas about music than in music itself; where the contemporary aesthetic essential implies that while music is certainly language (a mean of communication) the language of sounds is distinct from language of words, and if you could translate music into words the music would not be necessary. (Music and Society).

এ বক্তব্য থেকে যুক্তিযুক্তভাবেই বলা যায় রাগের সেন্টিমেন্ট যদি কথার মাধ্যমে শ্রোতার কানে পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা করা যায় তো সংঘর্ষের সম্ভাবনা প্রবল। অপেরার লিব্রেটো, রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের গীত বা মহারাষ্ট্রের নাট্যসঙ্গীত সম্পর্কে প্রশ্ন এখানে তোলা অবান্তর কারণ তা নাটক থিয়েটারের গান এবং একাধারে দৃশ্য ও সাহিত্যনির্ভর।

আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক। প্রত্যেক রাগের নিজস্ব পার্সন্যালিটি আছে। যেমন ভৈরোঁ গম্ভীর শান্ত সমাহিত প্রায় সেই একই পর্দা রামকেলি রাগের, তার গতি ও চরিত্রের মধ্যে সে গাম্ভীর্য নেই। কালিংড়া ও ভৈরোঁর পর্দা একই কিন্তু তার চরিত্র অনেক বেশি চঞ্চল, হালকা, ফুরফুরে। রবীন্দ্রনাথের ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে তে এই চরিত্রটি ধরা পড়েছে। কিন্তু কজন গীতিকার এ কর্ম করতে পারেন?Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

পুরনো বন্দিশের ভাষাকে নস্যাৎ করার পূর্বে একটা কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করি। ব্রজভাষা শহরে ভাষা নয়, গ্রাম্য ভাষা। রচয়িতাও অশিক্ষিত কিন্তু বহু রচনার মধ্যে এমন সরল প্রাণস্পর্শী আবেদন পাওয়া যায় যে সে স্বচ্ছন্দে উৎকৃষ্ট কাব্যের পর্যায়ে উঠতে পারে। গৌড় মহলারে একটি খেয়ালের রচয়িতা বলছেন মান না করিও গোরি, তুমহারে কারণ আও হৈ মেহা’।

‘সুন্দরী আর মান কোরো না, চেয়ে দেখ তোমার জন্যই আকাশে দল বেঁধে মেঘ এসেছে। আমার এক খ্যাতনামা সাহিত্যিক বন্ধুর মতে এই লোডশেডিং-এর যুগেও আধুনিক গীতিকারদের হাত থেকে এরকম একটা লাইন বের হবে না।

ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলীতে উনি উল্লেখ করেছেন একটি গানের, ‘কারি কারি কমরিয়া গুরুজি মোকো মোল দে’ অর্থাৎ ‘কালো কালো কম্বল, গুরুজি, আমাকে কিনে দে, রামজপনের মালা এনে দে আর জল পান করবার তুম্বী। ঐ ফর্দে উদ্ধৃত ফরমাশি জিনিসগুলিতে যে সুগভীর বৈরাগ্যের ব্যঞ্জনা আছে পরজ রাগিণীই তা ব্যক্ত করবার ভার নিয়েছে।” [ সুর ও সঙ্গতি : ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী ৩-এর ৬০ পৃষ্ঠা এবং ‘সংগীতচিন্তা’-র ১ম সংস্করণের পৃ. ৮৬-দ্রষ্টব্য]

অন্যত্র ‘রাধিকা’ বলছেন,

‘লইরে মোরি শ্যাম এঁদোরিয়া

কৈসে ধরু মেরে সিরপর গগরিয়া

ইথে মথুরা উথে গোকুল নগরী

বীচে মিলে মোহে নন্দকে নঙ্গরিয়া।। এক দিকে রইল মথুরা, আর এক দিকে গোকুল নগরী, মাঝখানে মিলল আমার সঙ্গে নন্দের নন্দন। কিন্তু করি কি সে যে আমার মাথার বিড়ে নিয়ে গেল, আমি জল ভরতে যাই কি করে। কথা আর সুরের ফাঁকে ফাঁকে এই খবরটা ধরা পড়ল যে বিড়ের শোকটা ছলনা। গোপিনীর কর্তব্যের বিড়ে গেছে হারিয়ে সে সাধ করেই ধরা পড়েছে মথুরা আর বৃন্দাবনের মাঝখানটিতে। এও তো খাঁটি সাহিত্য, আর এর সহচরী পূরবী তো খাঁটি সঙ্গীত—দুইয়ের একাত্মতা তো মনে নিবিড় করে বাজছে।’

(সংগীতচিন্তা পৃ. ৮৫)।

[ কথা ও সুর – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]

আরও পড়ুন:

আগ্রা ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

Leave a Comment