কিরানা ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

কিরানা ঘরানার গায়কি নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : আমার প্রথম গুরু মালবিকা কাননের বাবা ডা. রবীন্দ্রলাল রায় তাঁর ‘রাগনির্ণয়’-এর ভূমিকাতে লিখছেন ফৈয়াজ খাঁ এবং কিরানার রজব আলি খাঁ ওঁকে বলেছিলেন, “ইয়ে আবদুল করিম কিয়া কর রহা হৈ? খেয়ালে এই রকম বিস্তৃত রাগালাপ কি হয়? যদি রাগবিস্তার করতেই হয় তো আগে ধ্রুপদের নোম্ তোম্ আলাপ করে খেয়াল গাইলেই হয়।” খেয়ালে আলাপ বা বিস্তার নেই এই ছিল গোয়ালিয়রীদের এবং সে কালের কলাবাদের ধারণা। জোর সে জোর দশ পনেরো মিনিটের অওহার করে রাগের চৌহদ্দিটা জরিপ করে দিতে পারে খেয়ালিয়ারা। আলাপ হল ধ্রুপদীদের ডিপার্টমেন্ট।

কিরানা ঘরানার গায়কি - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় - উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ [ Ustad Abdul Karim Khan, 11 November 1872 – 27 October 1937, Founder of the Kirana gharana of classical music ]
উস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ [ Ustad Abdul Karim Khan, 11 November 1872 – 27 October 1937, Founder of the Kirana gharana of classical music ]

আবদুল করিম খাঁ এসে খেয়ালের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ধ্রুপদী আলাপকে সরাসরি তুলে নিয়ে বোল সহযোগে সুরের বিস্তার করে। এটি খেয়ালের বিবর্তনের একটি মস্ত বড় মাইল স্টোন। এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনের যোগাযোগ আছে। নাগপুরে তাজউদ্দিন বাবা ওঁকে বলেছিলেন “তু সুরমে ডুব যা আবদুল করিম, আজসে তু গওইয়োঁকা সর্দার হ্যায়।” দিলীপকুমার রায়কে করিম খাঁ বলেছিলেন সা লাগাবার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রভুর কৃপাপ্রসাদ প্রার্থনা করি। মৃত্যু আসন্ন জেনে উনি ডাক্তার ডাকতে বলেননি। তানপুরা বাঁধতে বলেছিলেন।

গোয়ালিয়রের সঙ্গে কিরানার সম্পর্ক দু দিক দিয়ে। কিরানা ঘরানার জনক বলা হয় বন্দে আলি খাঁ ধ্রুপদী ও বীণকারকে। উনি গোয়ালিয়রের ওস্তাদ হদ্দু খাঁর জামাই। কিন্তু বর্তমানকালে কিরানা খেয়ালের প্রবর্তক বলতে আমরা বুঝি আবদুল করিম খাঁকে। এঁর ওপর হদু খাঁর আফিমথোর আধপাগল পুত্র রহমৎ খাঁর কি প্রকার প্রভাব পড়েছিল সে বোঝা যাবে দুজনেরই গাওয়া ভৈরবীর ‘যমুনা কি তীর’ রেকর্ড শুনলে। পণ্ডিত দিলীপচন্দ্র বেদী বলতেন “আবদুল করিম রহমৎ খাঁর স্বরপ্রয়োগ নকল করে বটে মগর এক ভি উনকা তান আবদুল করিম কা গলেসে নহী নিকলা। উয়ো নিকালাথা ভাস্কর বুয়ানে, সুন সুনকে।”

কিরানা ঘরানার দুটি ধারা আছে। একটি আবদুল করিমের, অন্যটি আবদুল বহিদ খাঁর। এ দুটি শাখার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও মূল নীতি একই প্রকারের। প্রথমেই আসে স্বর প্রয়োগের কথা। এঁরা আগ্রা জয়পুর পাতিয়ালার মতো খোলা আওয়াজে আকার বেশি লাগান না। আ বা হ বর্ণের প্রয়োগ পছন্দ করেন, যাতে গোল আওয়াজ লাগে।

দ্বিতীয়ত, ওঁদের খেয়াল ঢিলে বাঁধুনির, বন্দিশ কন্ ভরে ভরে লয়বদ্ধ গান এঁরা গান না। তাল এঁদের অতি বিলম্বিত ঝুমরায় চারটে তেরেকটে পেরিয়ে শমে আসতে অন্যান্য ঘরানার গায়কদের অর্ধেক জীবন কেটে যাবে। একতালের মাত্রা বারোর পরিবর্তে আটচল্লিশ, ঠেকা খানাপুরিতে ভর্তি তা না হলে তবলচি ঘুমিয়ে পড়বে। তাল নিয়ে ঠোকাঠুকি লড়ন্ত, তেহাই ইত্যাদি কিরানা ঘরানার গায়কদের অকল্পনীয়।

এ ঘরানার ‘মটো’: সুর গয়া তো সির গয়া, তাল গয়া তো বাল গয়া।

অর্থাৎ বেতালা হলে এমন কিছু একটা আসে যায় না, একটা চুল ছেঁড়া যাওয়ার মতো কিন্তু বেসুরো হওয়া আস্ত মাথাটা কাটা যাওয়ার সমান। এঁরা রাগবিস্তারের চেয়ে স্বরবিস্তারেরই প্রাধান্য দেন, বিশেষ করে আবদুল বহিদ খাঁর গায়কির অনুসরণকারীরা। এঁদের গানে গোয়ালিয়রের লম্বা ধ্রুপদী মিড়ের অভাব, এঁরা ছোট ছোট মিড় নেন এবং গলার কাজে মুড়কি বাদ যায় না। গোয়ালিয়র পাতিয়ালা বা জয়পুরের বহলাওয়া এঁদের শৈলীতে ন্যূনতম।

আন্দুল ওয়াহিদ খান [ ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ সাহেবের ভাই ]

বহলাওয়ার পর আসে বোলবাট, বোলতান এবং লয়কারী। খেয়ালে আলাপ ও তানের মধ্যে যে বিরাট ফাঁকটি বহিদ খাঁর শাখায় এবং আজকাল কলকাতার সুন্নি শাগিরদদের মধ্যে দেখছি এটা আবদুল করিম খাঁর প্রথম দিককার গানে ছিল না।

গোয়ালিয়র আগ্রার মতো উনি সোৎসাহে বোলবাট লয়কারী এবং তবলার সঙ্গে লড়াই করতেন না কিন্তু ছন্দকে উনি অস্বীকার করেননি। ওঁর রেকর্ডে বোলতানও আছে। সওয়াই গন্ধর্ব মরাঠি আর মরাঠারা তালের ছন্দ নিয়ে লয়ের সঙ্গে খেলা পছন্দ করে। তাঁর একাধিক রেকর্ডে বোলতান ও ছন্দবহুল তানের নমুনা আছে। আবদুল করিম খাঁ গোয়ালিয়রী একহারা ও সপাট তান পছন্দ করতেন এবং খুব ভাল গমকতানের নমুনাও রেকর্ডে আছে।

আমাদের মতো পুরনো লোকদের কপাল মন্দের ভাল। এই দুর্ভিক্ষের বাজারেও ভীমসেন জোশির মতো একজন গায়ক আশির কাছাকাছি পৌঁছেও এখনও গাইছেন। কিরানা ঘরানা যে দুজনের হাতে পড়ে পুনর্জীবন লাভ করেছে তাঁরা ভীমসেন জোশি এবং উস্তাদ আমীর খাঁ। ভীমসেনের গায়কি কিরানা ঘরানার অন্যান্য গায়ক-গায়িকাদের

তুলনায় অনেক বেশি লয়বদ্ধ। ওঁর গানে বহুলাওয়া আছে, বোলতান এবং ছন্দবহুল তানে কিছুটা আগ্রার প্রভাব দেখা যায়, এক-আধটা তানও মাঝে মাঝে নেন জয়পুরী ঢঙে।

বন্দিশের বোল নিয়ে এঁর পুকার ও তদুপরি ওঁর গলার তাসীর বা প্রভাব গুণ এখনও শুধু আসর জমিয়ে রাখে না, কাউকে আসর ছেড়ে উঠে যাবার মওকাও দিচ্ছে না। আবদুল বহিদ খার দৌলতে কিরানা ঘরানার গায়কি আর একটি মোড় নিল যার ফল পরবর্তীকালে ভাল এবং মন্দ দুইই হয়েছে। এঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য মিরখণ্ডের বিস্তার। মিরখণ্ড বা শাস্ত্রে বর্ণিত খণ্ডমেরুর প্রথম উল্লেখ পাচ্ছি শাঈদেবের বইয়েতে যেখানে সপ্ত শুদ্ধ স্বরের পারমিউটেশন করে উনি ৫০৪০ স্বরসমূহের কম্বিনেশন গুনিয়ে দিয়েছেন।

Vidushi Prabha Atre, an Indian classical vocalist from the Kirana gharana.
Vidushi Prabha Atre, an Indian classical vocalist from the Kirana gharana.

 

পরবর্তীকালে ধ্রুপদীয়া থেকে সারেঙ্গি বাজিয়েরা সবাই সকাল সন্ধায় প্রাথমিক শিক্ষার রেয়াজের অন্তর্গত এই মিরখণ্ড করত গলা বা হাত তৈরি করার উদ্দেশ্যে। সা রে গা মা, মা গা রে সা রে গা মা সা রে মা গা সা, গা রে মা সা, গা মা রে সা ইত্যাদি—এ বস্তু রেয়াজের জিনিস, গাইবার বা বাজাবার নয়। এর ওপর ভিত্তি করে আবদুল বহিদ খাঁকে হায়দার বখ্শ তাঁর গায়কি তৈরি করে দেন যার বিস্তার কোনও সময়ে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা অবধি চলত।

বলা বাহুল্য, আনাড়ী গায়কের হাতে পড়লে রাগের আদ্যশ্রাদ্ধ হতে বাধ্য কিন্তু এই গায়কির উস্তাদ ছিলেন, আবদুল বহিদ খাঁ এবং তাঁর মানসশিষ্য আমীর খা। এই গায়কির গুণ বহিদ খাঁর চেয়েও তাঁর শিষ্যা করিম খাঁর কন্যা হীরাবাঈ বরোদেকর এবং আমীর খাঁর গায়কিতে পাওয়া যায়, তা হল শান্তির আস্বাদ এবং সুরের গভীরতা। এর দোষ একঘেয়েমি। এ ছাড়া এ গায়কিতে অনেক কিছুই নেই যা আবদুল করিমের গানে ছিল।

গোয়ালিয়রের বহলাওয়া নেই, বোলবার্ট নেই, বোলতান ও ছন্দবহুল তান নেই যা ভীমসেনের গানে আছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই যে-অন্তর্নিহিত সুপ্ত লয় এবং ছন্দর প্রতি অনুরাগ আছে, তার অনুপস্থিতিতে শ্রোতার কানে এ গায়কি বড় উদ্ভাদের হাতে না পড়লে বৈচিত্র্যহীন হয়ে যায়।

ইন্দোরে উস্তাদ নাসিরুদ্দিন খাঁ অর্থাৎ মৈনুদ্দিন এবং আমিনুদ্দিন খাঁ ডাগরের পিতার ধ্রুপদী আলাপ প্রথম আমীর খাঁকে বিস্তারের মেজাজে নিয়ে যায়, যার পরিণতি ওঁর আবদুল বহিদ খাঁর গায়কি গ্রহণ করার মধ্যে পাওয়া যায়।

ওস্তাদ আমির খান, কিরানার শিষ্য ছিলেন যিনি নিজের ইন্দোর ঘরানা সৃষ্টি করেন [ Ustad Amir Khan, Founder of Indore Gharana ]
ওস্তাদ আমির খান, কিরানার শিষ্য ছিলেন যিনি নিজের ইন্দোর ঘরানা সৃষ্টি করেন [ Ustad Amir Khan, Founder of Indore Gharana ]

আমীর খাঁর গলা এবং স্বরপ্রয়োগের গভীরতা, ধ্রুপদী মেজাজ, high tone of seriousness এবং aesthetic sense এই গায়কিকে কলকাতায় এবং মুম্বাইয়ে জনপ্রিয় করেছিল। ওঁর নিজস্ব দান ওঁর তান ও সার্গমের জটিল এবং unpredictable নক্শা, উল্লম্ফন এবং অবলা যাকে আমরা ছুট বলি। এর কিছু সরল উদাহরণ আমার বইতে দিয়েছি।

উনি স্পিডের চক্করে কখনও পড়েননি, ওঁর তানের স্বরসমূহের প্রয়োগে Surprise-এর element অসম্ভব। এর অনুকরণ ওঁর নিজের ভাষায় ‘খতরে সে খালি নহী’। তান ও সার্গমে বেশি ছুটের প্রয়োগ করলে শুধু রাগভ্রষ্ট নয়, স্বরচ্যুত হওয়ার আশঙ্কাও পদে পদে। রাগ ভাব কায়েম হলে উস্তাদের গলায় মিরখণ্ড ও ছুটের তান মানিয়ে যায়। রোজ রোজ আমীর খাঁর মতো উদ্ভাদ জন্মগ্রহণ করেন না। নকলনবিশের সংখ্যা অগুনতি এ-অঞ্চলে।

আমীর খাঁ অনেক সময়ে অন্তরা গাইতেন না। দেখাদেখি বেশ কয়েকটি বঙ্গসন্তান অন্তরা গাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল এককালে। প্রশ্ন করায় এদেরই একজন বলেছিল, “আমীর খাঁ তো অন্তরা গান না, তা কি তিনি গাইয়ে নন?” উত্তরে মনে আছে বলেছিলাম, “তার মানে অন্তরা না গেয়ে গানটাকে স্কন্ধকাটা করে দিলেই বাছা তুমি আমীর খাঁ হয়ে যাবে?

Ustad Amir Khan Saab
Ustad Amir Khan Saab

 

এই যে সৌরভ গাঙ্গুলি অনসাইড শট নিত না বা একসময়ে নিতে পারত না, তা হলে তো পুরো বেঙ্গল টিমের প্লেয়ারদের অনসাইড স্ট্রোকস বর্জন করা উচিত। আর জেনে রেখো আমাদের দেশে শ্রাদ্ধ আর নিয়মভঙ্গ একসঙ্গে হয় না।’ উপস্থিত আর একজন বলল, “ক্রিকেটের উপমাই যখন দিচ্ছেন, এ গায়কি হল গাভাস্করের ইনিংস, ধীরে ধীরে পাহাড়ের মতো তৈরি হয় এর ইমারত।”

জবাবে বললাম, “ভুল করছ গাভাস্করের হাতে সব রকম স্ট্রোকস ছিল, তোমাদের গায়কির মুণ্ডু আছে আর ঠ্যাঙ্ আছে, ধড় মিসিং, বরঞ্চ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে তুলনা করা যায়, তার হাতে ছিল ফার্স্ট গিয়ার আর টপ্ গিয়ার, এগারো ঘণ্টায় ওপন করে দুশ রান অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গ্যারি সোবার্সের সঙ্গে যুগ্ম রেকর্ড, এক ওভারের ছটা বলে ছটা ছয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বিস্তার তার পর জেগে উঠে ঝড়ের মতো তান ও সার্গম।”

[ কিরানা ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment