গোয়ালিয়র ঘরানার গায়কি নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : সর্বাগ্রে ঘরানা নিয়ে যাঁরা ঝগড়া কাজিয়া করেন তাঁদের জানাতে চাই যে সব ঘরানারই খেয়ালের মূল তত্ত্ব একই, যেমন সব ধর্মের মূলতত্ত্ব বা ফান্ডামেন্টাল্সে প্রভেদ অত্যল্প। এই কারণে আমি মৌলবাদী বা ফান্ডামেন্টালিস্ট কথার অর্থ খুঁজে পাই না, কারণ তাঁরাই তো সব খুনোখুনির মূলে। ঘরানার প্রভেদ শব্দতত্ত্বে, স্বরপ্রয়োগের স্টাইলে, গলার আওয়াজ লাগানোর কায়দায়।
হয়তো কোনও কোনও ঘরানায় খেয়ালের বিশেষ কোনও অঙ্গর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, কোথাও দু-একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে। কিরানা হয়তো সুর ও স্বরবিস্তারের ওপর নজর বেশি দিয়েছে, আগ্রা ঘরানা বোল বাট লয়কারীর দিকে, পাতিয়ালা ও জয়পুর গায়কিতে তানের গুরুত্ব হয়তো বেশি। কিন্তু মূল কথা। ও মূল নীতি একই।
রেজা আলি খাঁ বা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যায় এঁরা পাতিয়ালা ঘরানার। বড়ে গোলাম আলি খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর প্রসূন এবং মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বরক্ষেপণ চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেছি। শরাফৎ হুসেনের বসার মিনিট খানেকের মধ্যে কোনও সন্দেহ থাকত না ইনি আগ্রা ঘরানার।
আজ কোনও সেতারির প্রথম স্বরের ঝঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় তিনি রবিশঙ্কর না বিলায়েৎ খাঁর স্টাইলের অনুবর্তী। কিন্তু মূল অঙ্গগুলির মধ্যে কোনও উচ্চারিত প্রভেদের নিদর্শন পাওয়া যায় না। বড় বড় গাইয়ে বাজিয়েদের ব্যক্তিত্ব চিন্তাভাবনা এবং স্বর প্রয়োগের দরুন, এককথায় স্টাইলই ঘরানার জন্ম দিয়েছে। ঘরানা এবং খানদানের মধ্যে পার্থক্য এইখানেই।
বহুকাল ধরে খেয়ালের অষ্টাঙ্গের কথা শুনে আসছি। সে আটটি অঙ্গ কী তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমায় কোনও ওস্তাদ দিতে পারেননি। গোয়ালিয়রের বৃদ্ধ গায়ক শরৎচন্দ্র আরোলকর মৃত্যুর কিছুকাল আগে কলকাতায় সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমিতে আসেন এবং তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাজে তাঁর শতাধিক বন্দিশ ও গায়কি রেকর্ড করি।
শরৎচন্দ্র আরোলকরের বয়স তখন আশি। ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আমি অষ্টাঙ্গ সম্পর্কে প্রশ্ন করি যা এতকাল শুনে এসেছি গোয়ালিয়রের গায়কিতে পাওয়া যায়! উনি আমায় মিড় সুত ধুরন মুরণ কম্পন আন্দোলন ইত্যাদির ফিরিস্তি শুনিয়ে দিলেন। খাদিম হুসেন খাঁও দাবি করতেন ওই প্রকার আঠারোটি অঙ্গ আগ্রার গায়কিতে আছে। সেও দেখলাম ওই প্রকারের টুলস্ অফ দা ট্রেড’, মিস্ত্রির অওজার, ছুতোরের বাটালি করাত র্যাদা ইসক্রুপ, নাট বোলটু যা গায়কের অঙ্গ, খেয়ালের নয়।
ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাজে প্রায় হাজার ঘণ্টার রেকর্ডিং ও সাক্ষাৎকার বিভিন্ন ঘরানার গায়কদের সঙ্গে করার পর গবেষণা ও বিশ্লেষণের ফলে দেখছি:
Table of Contents
খেয়ালের অষ্টাঙ্গ হতে পারে এই প্রকার : ১. বন্দিশ নায়কি ২. বন্দিশ গায়কি ৩. বিস্তার ৪. বহুলাওয়া ৫. বোলবাট ৬. বোলতান ৭ লয়কারী এবং ৮. তান। সার্গমকে নবম অঙ্গ বলা যেতে পারে।
আমার জীবনে আমি গোয়ালিয়রের যেসব গায়কদের শুনেছি তাঁরা হলেন রাজাভইয়া পুছওয়ালে এবং তাঁর ছেলে বালা সাহেব কৃষ্ণরাও শঙ্কর পণ্ডিত, তাঁর ছেলে লক্ষ্মণরাও, গজানন রাও জোশি এবং তাঁর শিষ্য উল্লাস কশলকর, শরৎচন্দ্র আরোলকর এবং তাঁর শিষ্য শরৎ সাঠে, যশবন্ত রাও। রামকৃষ্ণ বুয়াওয়াজের রেকর্ড ও রেডিওয় গান শুনেছি, সামনে বসে শোনা হয়নি।
এ ছাড়া গোয়ালিয়রের মরাঠি শিষ্যদের মধ্যে শুনেছি বিনায়করাও পটবর্ধন, নারায়ণ রাও ব্যাস এবং ডি ভি পলুস্করকে। এঁদের ওপর নাট্যসঙ্গীতের প্রভাব পড়ায় এঁদের গায়কি কিঞ্চিৎ পৃথক রূপ ধারণ করেছে। আমার শোনা ভিন্ন ঘরানার উস্তাদ যাঁরা নব্বুই পার্সেন্ট গোয়ালিয়র গাইতেন তাঁরা হলেন আমার দু নম্বর গুরু সহস্ত্তয়ান ঘরানার মুশতাক হুসেন খাঁ এবং পাতিয়ালা ঘরানার বড়ে গোলাম আলি খাঁ।
গোয়ালিয়রকে ভিত্তি করে আগ্রা মিলিয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর এবং নিসার হুসেন খাঁ। দিব্যকণ্ঠের অধিকারী পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ বিষ্ণু দিনম্বরের শিষ্য হলেও গোয়ালিয়র গাইতেন না, ঈশ্বরদত্ত গায়কি গাইতেন। শুনে রাজ্যেশ্বর মিত্রর নাটুকে কান্না কান্না শোনাত।
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধ গোয়ালিয়র গেয়েছেন রাজাভইয়া, গজানন বুয়া, শরৎচন্দ্র আরোলকর, শরৎ সাঠে, ও ইদানীং এর মধ্যে উল্লাস কশলকর। রামকৃষ্ণ বুয়া ওয়াজেকে যখন শুনেছি তখন উনি বৃদ্ধ এবং তান দুর্বল হয়ে গেছে। একসময়ে তিনি অজগরবৃত্তি অবলম্বন করে উত্তর ভারত ভ্রমণে বের হন।
গোয়ালিয়র পৌঁছে রামকৃষ্ণ বুয়া আতিথ্য গ্রহণ করেন কৃষ্ণরাও শঙ্কর পণ্ডিতের। ওঁর গান শুনে উনি বলেছিলেন তুমি শঙ্কর কাকার গায়কি থেকে অনেক হটে এসেছ, বালকৃষ্ণ অর্থাৎ রাজাভইয়া এখনও তাঁর গায়কিই গাইছেন। অতএব আমাদের বিশ্লেষণের ভিত্তি হবে উপযুক্ত পাঁচ-ছ জনের শৈলীর এবং রাজাভইয়ার পুত্র বালা সাহেবের সঙ্গে কথোপকথনের ওপর। ইনি বেশ কিছুকাল আশি পেরিয়ে গেছেন।
বন্দিশ গায়কির অর্থ যেভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরা অনুসারে যুগবাহিত বন্দিশের রূপ পাওয়া গেছে ঠিক সেইভাবে গাওয়া। গায়কি অঙ্গ সেই বন্দিশকে নিয়ে নিজের কল্পনানুসারে চরণগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে পেশ করা। অর্থাৎ এই প্রাচীনতম গায়কির প্রথম শর্ত হল গান হবে বন্দিশভিত্তিক।
শরৎচন্দ্র আরোলকরের বক্তব্য অষ্টদিশা থেকে বন্দিশকে দেখতে হবে। এ অষ্টদিশার ব্যাখ্যা উনি আমায় দেননি তবে এর থেকে আন্দাজ করা যায় গোয়ালিয়র গায়কিতে বন্দিশের মাহাত্ম্য। এও বোঝা যায় গুরুর কাছে শেখা বন্দিশ গেয়ে নেওয়ার পর তাকে কল্পনার সাহায্যে নানাভ বর্তাতে হবে গায়ককে।
ড. প্রদীপকুমার ঘোষের মতে সঙ্গীতের ইতিহাসে তিন প্রকার খেয়াল পাওয়া যায়। জৌনপুর উদ্ভূত চুটকলা, যা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কব্বালি অঙ্গের খেয়াল এবং কলাবত্তদের খেয়াল যা ধ্রুপদী ঐতিহ্যে পরিপুষ্ট। এই কারণে বিলম্বিত খেয়ালে বিস্তার আসে অথবা খেয়ালের আগে অওছার, যাতে রাগের চৌহদ্দিটা মোটামুটি জরিপ করে দেওয়া হয়।
আমার শোনা গোয়ালিয়রের প্রাচীন গায়করা বিস্তার করতেন না, বহলাওয়া করতেন হল লরজদার তানের সঙ্গে ধ্রুপদী লম্বা মিড়ের মিশ্রণ। যাঁরা গোয়ালিয়রের গায়কির সঙ্গে পরিচিত নন তাঁরা বর্তমানে কলকাতাবাসী সুগায়ক উল্লাস কশলকর যখন গোয়ালিয়র অঙ্গে গান, (জয়পুরী অঙ্গে নয়) তার মধ্যে বহলাওয়া প্রচুর পাবেন। নচেৎ বড় গোলাম আলি খাঁর টেপের গোড়ার দিকে অর্থাৎ মধ্য বিলম্বিত অংশে বহলাওয়ার ছড়াছড়ি।
অওছার করতে শুনেছি মুশতাক হুসেন খাঁকে যা উনি দশ পনেরো মিনিটে রাগের অ্যানাটমিটি দেখিয়ে সেরে নিতেন। বিনায়ক রাও পটবর্ধনও অওছার করতেন। আমার কাছে ওঁর একটি ভূপালীর টেপ আছে যাতে উনি মিনিট কুড়ি ওম্ অনন্ত হরি উচ্চারণ করে অওছার করেছেন। যে অর্থে আজকাল আমরা কিরানা ঘরানার কল্যাণে বিস্তার বুঝি তা গোয়ালিয়রের খেয়ালে কখনই ছিল না।
পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র আরোলকর, শরৎ শাঠে, ডি ভি পলুস্কর এমন কি উল্লাস কশলকরের কাছেও বিস্তার শুনেছি তবে সে বিস্তারের সঙ্গে ধ্রুপদী বিস্তার বা কিরানার স্বরবিস্তারের পার্থক্য আছে। ওঁদের বিস্তার বা বহলাওয়ায় রাগাঙ্গকে তুলে ধরা বা হাইলাইট করা হয়। প্রত্যেক রাগেরই কিছু মুখ্য এবং গৌণ রাগাঙ্গবাচক স্বরসমূহ আছে যাকে আমি ফ্রেজ বলব। এগুলিকে বিস্তার বা বহলাওয়ায় প্রাধান্য দিলেই রাগ জীবন্ত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে একাধিক ফ্রেজ আছে যা একে অন্যের পরিপূরক। যথা বেহাগে নিসারে নি সারে সানি এবং গপ গপ মগ।
আরোহণে বেহাগে যদি গান্ধারে ন্যাস নিয়ে রেখাবের কণ্ লাগানো হয় তো গোয়ালিয়রের রাগাঙ্গ উন্মোচনে নিষাদেও ন্যাস নিয়ে ধৈবতের কণ্ লাগবে। ধৈবৎ ছুঁয়ে নিষাদ পঞ্চমের অবরোহণে মিড়ের জোড়া হবে রেখার ছুঁড়ে গান্ধার থেকে ষড়জের মিড়। এখানে নতুনত্বের স্কোপ নেই। বেহাগে গমপগমগ-র পরিবর্তে কেউ যদি নতুনত্ব করব বলে বিহঙ্গড়ার মতো গমপগসা করেন তাহলে রাগরূপ কিঞ্চিৎ বিকৃত হবে। এই মূলনীতি প্রাচীন ঘরানাগুলি অর্থাৎ গোয়ালিয়র ও আগ্রা কখনও পরিত্যাগ করেনি। জয়পুর ও পাতিয়ালা এমন কী কিরানাও নয়।
গোয়ালিয়র গায়কিতে বহলাওয়া থেকে তানে চলে যাওয়ার প্রথা আছে বিলম্বিত খেয়ালে আর সে তান লরজদার ভারী তান হবে। যেহেতু সে কালে স্ত্রীলোকদের এখতিয়ারে খেয়াল বড় একটা পড়ত না সে কারণে এই মরদদের গায়কিতে প্রচুর পুরুষোচিত গমকতান নেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
অন্যত্র এ কাহিনীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি লিখেছি কিন্তু এটি আমার গোয়ালিয়রের বুজুর্গদের কাছে শোনা প্রিয় গল্প, কসম খাওয়া সত্ত্বেও আর একবার পাঠকদের শোনাবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। একদিন হদ্দু হসু খাঁ দুই ভাই দরবারে গাইছেন, মিয়া মহলার। তখন নানা প্রকার তানের বর্ণনা ছিল ‘কড়ক বিজলী তান’, ‘নাঙ্গা তলোয়ার তান’, ‘হাথি চিংঘাড় তান’, ইত্যাদি। হসু খাঁ গাইতে গাইতে এই ভয়ানক হাথি চিংঘাড় তান নিলেন যা শুনলে নাকি হাতি পিলখানা থেকে বেরিয়ে আসে।
বড়ে মহম্মদ খাঁ সে আসরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পর্যন্ত সে তান শুনে বিস্মিত হয়ে ‘সুভান আল্লা, সুভান আল্লা!’ বলে চিৎকার করে উঠলেন, তারপর আবার শুনতে চাইলেন ওই তান। হসু খাঁ পেট থেকে গমক সহকারে সেই ভয়ানক তান নিতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেলেন। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এল। নথন পীর বখ্শ পাশেই বসে ছিলেন। নিজের শাল দিয়ে নাতির মুখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন ‘বেটা মরনা হি হ্যায় তো তান পুরি করকে মরো।’
আল্লাদিয়া খাঁ সাহেব তাঁর স্মৃতিচারণ করতেন নাতি আজিজুদ্দিনের কাছে এবং সৌভাগ্যবশত আজিজুদ্দিনের লেখা সেই ঠাকুরদার আত্মজীবনী সম্প্রতি অম্লান দাশগুপ্ত ও উর্মিলা ভির্দিকর ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এতে আল্লাদিয়া খাঁ সাহেব তাঁর যুবা বয়সের গল্প বলছেন।
একদিন আল্লাদিয়া খাঁ সাহেব একদিন বড়ে মুবারক আলি খাঁ সাহেবের বাড়ি গেছেন। গিয়ে দেখেন ঘগগে খুদা বখ্শ, ধ্রুপদী বহরাম খাঁ, মহম্মদ আলি খাঁ, খয়রাত আলি খাঁরা সবাই বসে, মুবারক আলি চারপাইয়ের ওপর, অন্যরা পাশেই আর একটি খাটিয়ায়, ছেলেছোকরারা অনতিদূরে দরীর ওপর বসলেন। বহরাম খাঁ সবাইয়ের পেছনে লাগতেন, সাধারণত ওঁর টোপি বদল ভাই ঘগ্গে খুদা বখ্শের পেছনেই সবচেয়ে বেশি।
এদিন উনি মুবারক আলিকে নিয়ে পড়লেন খেয়ালিয়াদের গান নিয়ে হাসিঠাট্টা, “ওই মেরি ইয়ে লগি, উই মেরি উও লগি,” এই তো খেয়ালের কথা আর গান। মুবারক আলি ক্ষেপে গিয়ে নমাজের ভঙ্গিতে হাঁটু গেড়ে এমনই সাংঘাতিক এক গমক তান নিলেন যে চারপাই ভেঙে পড়ল, দড়ির জালে আটকা পড়া খাঁ সাহেবকে উদ্ধার করার পর মুবারক আলি রহমান থাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, “এসব গমক তান নিতে গেলে ধ্রুপদীদের মুখে রক্ত উঠে আসবে।”
আর একদিন। হায়দর বখ্শের বাড়িতে হদ্দু খাঁ গাইছেন। সবাই খুব তারিফ করছে। একটা জটিল ফিকরা নিতে সবাই সমস্বরে কেয়াবাৎ কেয়াবাৎ করে উঠল। উপস্থিত তানরস খাঁ ও মুবারক আলি খাঁর দিকে তাকিয়ে হৃদু খাঁ বলে উঠলেন, “চার ঘড়ে রসকে ভরে, চোর তাকে লে না সকে।”
তানরস ও মুবারক আলি দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে জানতে চাইলেন, এর মানে কি? হৃদু খাঁ বললেন, “যো মুঝে কহনা থা হম্নে কহ দিয়া। জবাব দেনা হো তো সাথ বয়েঠকে গাও।” স্মরণ করতেও রোমাঞ্চ হয় তানরস খাঁ বড়ে মুবারক আলি খাঁ এবং হদ্দু খাঁ একত্র গাইছেন।
আল্লাদিয়া খাঁ বলছেন সে যেন জংলি মুর্গার লড়াই। যখন তানরস খাঁ তান নিচ্ছেন তখন মনে হচ্ছে এর জবাব নেই। মুবারক আলি যখন মুখ খুলছেন তখন মনে হচ্ছে আল্লাদিয়া খাঁকে উনি অপরূপ এক নতুন দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। আর তাঁর তান কী অসম্ভব জটিল অথচ ওজনদার এবং তার সৌন্দর্য বর্ণনা করা যায় না। এই দঙ্গল চলল ঘণ্টাখানেক, কেউ হার মানল না।
অবশেষে হায়দর বখ্শ উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বললেন, “খুদাকে ওয়াস্তে অব্ খতম করো, বহুৎ হো গয়া। আভ খানা ঠাণ্ডা হো রহা হৈ।” ভয় ছিল এ আসর হদ্দু খাঁর ওই উক্তির পর মারদাঙ্গায় পরিণত হবে, শেষ হল কোলাকুলি হাসি মস্করায়।
গোয়ালিয়রের বিলম্বিত খেয়ালের তান বেশির ভাগই একহারা এবং লয় থেকে একটু তফাতে চলে। দ্রুত খেয়ালে লয়কে অবজ্ঞা করা হয় না, কিন্তু প্রতি তানেরই শেষ হয় অবরোহণে সপাট তানে। এটি একটি গোয়ালিয়রের মুদ্রাদোষ। এক হারা এবং সপাট তানে অনেক সময়েই রাগরূপ বিকৃত হয়। তবে মুশতাক হুসেন খাঁকে আমি একহারা তানে বেহাগে গ ম প ধ নিসা, প নি সা রে গা ইত্যাদি লাগাতে দেখেছি, বেমানান হয়নি।
মুশতাক হুসেন খাঁ সাহেব বলতেন রাগ জম যানেকে বাদ ইয়ে খপ্ খাতা অর্থাৎ মানিয়ে যায়। গোয়ালিয়রের বিলম্বিত অংশে বোলবাটের প্রাধান্য আছে এবং তার নিয়ম হচ্ছে পুরো আস্থায়ী বা অন্তরার কথাগুলি বলে বাটোয়ারা করতে হবে। অর্থহীন বা উলটোপালটা কথা জবড়জংভাবে সাজালে চলবে না। বড় খেয়ালে লয় মধ্য বিলম্বিত, ক্রিকেটের পরিভাষায় স্লো মিডিয়াম। যে লয়ে এই সেদিন পর্যন্ত বড়ে গোলাম আলি খাঁ গেয়ে গেছেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে উপযুক্ত অষ্টাঙ্গের মধ্যে গোয়ালিয়রে বিস্তার ন্যূনতম, বহলাওয়া বোলবার্ট লয়কারী তান সবই আছে, বোলতান অনেক পরে কেউ কেউ করেছেন যা প্রাচীন গায়কিতে ছিল না। এটি আগ্রা ঘরানার দান। সার্গম গোয়ালিয়রে পূর্বে এবং পরে কেউ করেননি, একমাত্র মহারাষ্ট্রে পটবর্ধন এবং নারায়ণ রাও ব্যাস ছাড়া।
এই গায়কিতে বিশেষ উল্লেখ্য টপ্পা অঙ্গের ভারী তান, যে প্রকার ইমনের ‘বনরে বলইয়ার’ মুখড়ায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া গোয়ালিয়রের টপ্ খেয়াল এককালে প্রসিদ্ধ ছিল। এও রপ্তানি করেছে লখনউ। যদিও টপ্পা বা ডগা নামক লোকগীতি কয়েকশো বছর ধরে চলে আসছে, খেয়ালে এই অঙ্গর আবির্ভাব হয়েছিল ওই লখনউয়ের গোলাম রসুল খাঁর পুত্র গোলাম নবীর জন্য যিনি শোরি মিঞা নামে প্রসিদ্ধ এবং পঞ্জাবের এই লোকগীতিকে জাতে তোলার কৃতিত্বের অধিকারী।
[ গোয়ালিয়র ঘরানার গায়কি – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]
আরও পড়ুন: