বর্তমান খেয়ালের জন্মকথা নিয়ে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : মহম্মদ শাহর সময় কলাবস্তু নটুয়া ও নাচনেওয়ালিদের বোলবোলাও এতটাই বাড়ল যে বাদশাহ্ আমোদপ্রমোদ গানবাজনা ছাড়া বড় একটা কিছু বুঝতেন না। সময়ও দিতে পারতেন না। তার ফলে নাদির শাহর ফৌজের চেয়ে অনেক বেশি সৈন্যবল নিয়েও তাঁকে ঠেকাতে পারলেন না।
দিল্লি শহরে যখন কৎলে আম্ অর্থাৎ বারোয়ারি মুগুচ্ছেদ চলল তখন বাদশাহ্ হাঁটু গেড়ে দাঁতে কুটো দিয়ে নব্বই লাখ টাকা, প্রচুর হীরে জহরত ও ময়ূর তথং সেলামি দিলেন এবং সসম্মানে নাদির শাহকে বিদায় করে আবার গানবাজনার বৈঠকে ফিরে গেলেন। এরই সময় নিয়ামৎ খাঁ ও ফিরোজ খাঁ (সদারঙ্গ ও অদারঙ্গ) দরবার আলো করেছিলেন। এঁরা ঔরঙ্গজেবের পুত্র আজম শাহর কাছে সংস্কৃত ও ব্রজভাষার ব্যাকরণ শেখেন এবং খেয়ালের তালিম নেন কবাল বচ্চাতত্ত্বারের কাছে।
এ ছাড়া নটুয়াদের কাছে নৃত্যের বোল, ছন্দ, পথাবজ সঙ্গত্ কৌশল শিখে ওই ছন্দভেদের সঙ্গে রবাবের সাথসঙ্গত আয়ত্ত করে চৌখস প্রতিভাবান গায়কে পরিণত হন। গায়ক মাত্রেই জানেন কী পরিমাণ ধ্রুপদ-ভাঙা খেয়ালের রচয়িতা এই দুই ভাই। শাহ্ আজমের পুত্র বেদার বখতের বিবাহে রচনা ‘সুঘর বনাবন আও গাও সব মিল বেদার বখং প্রিয় প্যারা’, প্রথমে ধ্রুপদ ও পরে তাকে খেয়ালের রূপ দিয়েছিলেন। সদারঙ্গ। এই বিয়ে হয়েছিল ১৬৮৬ সালে। এঁদের দেখাদেখি মনরঙ্গ, হররঙ্গ, সুখরঙ্গ, সবরঙ্গ, দীনরঙ্গ, কৌড়িরঙ্গ, পয়সারঙ্গ সব রচয়িতাই এই রঙ্গের রঙিন তখলুস বা উপনাম ধারণ করে শয়ে শয়ে বন্দিশ রচনা করে গেছেন যা আমরা আজও গাইছি।
নিয়ামৎ খাঁ সম্রাটের বড়ই প্রিয়পাত্র ছিলেন। একদিন জলসায় ওঁর গান এবং ওঁর একাধিক রচনা মহম্মদ শাহ্ রঙ্গিলের স্তুতিতে শুনে অভিভূত হয়ে বাদশাহ্ সেইখানেই এলান (ঘোষণা করলেন যে নিয়ামৎ খাঁর যথোচিত সম্মান করতে হলে নিদেনপক্ষে ওঁকে একটা সুবার গভর্নর করা উচিত। গুজরাতের শাসনকর্তার পদ খালি অতএব আজ থেকে উনি গুজরাতের গভর্নর। অবিলম্বে উনি আহমদাবাদের পথে রওনা হবেন।
বলা বাহুল্য, উজিরে আজম, অর্থাৎ প্রাইম মিনিস্টারের পুরো ব্যাপারটা একেবারেই মনঃপূত হল না। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষের দিকে যুদ্ধবিগ্রহ, পদে পদে বিদ্রোহ লেগেই থাকত আর গুজরাট অত্যন্ত ঝামেলার জায়গা, সেখানের ভার সামলাবে এই গানের উস্তাদ? মুখে আর কী বলবেন, যো হুকুম সরকার জাতীয় কথা বলে মেনে নিয়ে মনে মনে ফন্দি আঁটতে শুরু করলেন।
নিয়ামৎ খাঁকে পরের দিন পরামর্শ দিলেন। ড়াহুড়ো করে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই, আর গান-বাজনার মাহল বা বাতাবরণ ওইসব অসভ্য জায়গায় নেই, ভাল কিছু শাগীদ, বাদ্যযন্ত্র তানপুরা এ সব অর্ডার দিয়ে নিয়ে যান, তাতে দু-চার দিনের বিলম্ব হলে কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। দুদিন যায়, চারদিন যায়, দিন সাতেকের মাথায় বাদশাহ্ খোঁজ করলেন নিয়ামৎ খাঁ রওনা হয়েছেন কি? এখনও হননি শুনে বৃজিরে আজমকে তলব করলেন।
উজির প্রস্তুতই ছিলেন, তিনবার কুর্নিশ করে অত্যন্ত চিন্তিত মুখে বললেন, জাহাপনা, উনি ভারতের সেরা ওস্তাদ, গুণী ও কলাবত্ত, ওঁর বাসনা গুজরাতে গিয়ে দিল্লির তহজীব, দিল্লির জবান, বাদশাহর প্রিয় সঙ্গীতের সম্যক প্রচার যদি হয় তো ওই অসভ্য প্রদেশের লোকগুলো আপনা আপনিই বশীভূত হয়ে যাবে।
যে কলাকারের গান শুনে জঙ্গলের শের পর্যন্ত পোষা কুত্তা বনে যায় তাঁর পক্ষে গুজরাতি সর্দারদের বশ করা আর এমন কী ব্যাপার। সেই উদ্দেশ্যে নিয়ামৎ খাঁ দেড় হাজার তানপুরা, পথাবজ, তবলা ইত্যাদির অর্ডার দিয়েছেন। তৈরি হতে মাস খানেক লাগবে। তার পর উনি রওয়ানা হবেন।
তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি নেই কারণ শাহেনশাহর যে প্রিয় সঙ্গীত তা শুনতে না পেলে হুজুরের তবিয়ও তো নাসাজ হতে পারে, অতএব আরও মাসখানেক নিয়ামৎ খাও হুজুরের সেবা করতে পারবেন। আমোদ আহ্লাদ গানবাজনা যতই বাদশার প্রিয় হোক হাজার হোক্ মুঘলের বাচ্চা তো, মহম্মদ শাহর বুজিরের ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হল না। ফরমান প্রত্যাহার করা হল, বুজিরে আজমও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।
Table of Contents
বর্তমান খেয়ালের যে রূপ তার বয়স আমার মতে তিনশো সাড়ে তিনশো বছরের বেশি নয়। সদারঙ্গ অদারঙ্গের খেয়ালের রচনার সঙ্গে আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত কিন্তু দিল্লি ঘরানার গায়কি কী ছিল তার কোনও আন্দাজ পাওয়া যায় না। চাঁদ খাঁ, ওসমান খাঁ, নাসির ও হিলাল খাঁর গায়কির সঙ্গে দিল্লির শেষ বড় উস্তাদ তানরস খাঁ বা তাঁর ভাগ্নে শত্ৰু খাঁর গানের সঙ্গে পুরনো কালের সমঝদাররা কোনও মিল পাননি। অতএব এরই পাশাপাশি একটি ধারা যাকে ইংরেজিতে প্যারালাল স্ট্রিম বলে তার অনুসন্ধান করতে হবে। এর উৎপত্তি লখনউ শহরে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ায় গোলাম রসুল খাঁ নামে এক বিরাট উস্তাদ লখনউয়ের নবাব আসফউদ্দৌলার দরবারি গায়ক ছিলেন। এ সেই বিখ্যাত নবাব যাঁর নাম করে গরিব দুঃখীরা বলত “যিনকো না দে মৌলা, উসকো দেয় আসফউদ্দৌলা।’ এঁর জামাই শককুর খাঁ ও ভাই মখখন খাঁ কবাল বচ্চে নামে প্রসিদ্ধ। মখন খাঁ ও তাঁর পুত্র নথন পীর বখ্শই গোয়ালিয়রে নিয়ে যান এই কব্বাল বচ্চের গায়কিকে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন ঘরানার সূত্রপাত।
শকর খাঁ ও মখন খাঁ ভাই হলেও এঁদের মধ্যে রেষারেষি ছিল। শক্কর খাঁর অকালমৃত্যুর পর মখন খাঁ গোয়ালিয়রে এসে আশ্রয় নেন এবং মহারাজের সুনজরে পড়েন। মন খাঁর ছেলে নথ্রন পীর বখ্শের বা তাঁর ছেলে কাদির বখ্শের সঙ্গে নাতিদের অর্থাৎ হদ্দু, হসু ও নথুথু খাঁর গায়কি মেলে না। এটা বোঝা যায় কাদির বখ্শের শিষ্য বরোদা রাজসভার গায়ক ফয়েজ মহম্মদ ও নথন পীর বংশের শাগীদদের পুত্র আগ্রার গোলাম আব্বাস খাঁর গায়কি থেকে।
ফয়েজ মহম্মদের শিষ্য ভাস্কর বুয়া ও গোলাম আব্বাস খাঁর শিষ্য ও নাতি আগ্রার ফৈয়াজ খাঁ। একমাত্র পণ্ডিত দিলীপচন্দ্র বেদী এঁদের দুজনেরই কাছে শিখেছিলেন। তাঁর কথা থেকে আন্দাজ পাই যে-গায়কি আগ্রায় রপ্তানি করে গোয়ালিয়র তা ধ্রুপদ ভাঙা ভারী চালের খেয়াল এবং তাতে বন্দিশের অস্থায়ী অন্তরা ভরার কায়দার ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হত।
‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’তে আমি লিখেছি ওই সময়ে দ্রুত খেয়াল জন্মায়নি এবং কন্ মুড়কি খটকা ইত্যাদির অস্তিত্ব প্রায় ছিল না বললেই হয়। এ কথা ঠিক নয়। পরে গবেষণা করে দেখেছি কবাল বচ্চেদের দ্রুত খেয়াল তো ছিলই, উপরন্তু সদারঙ্গ অদারঙ্গের দ্রুতলয়ের খেয়াল গোয়ালিয়রে তখন পৌঁছে গেছে। শককর খাঁর নাতি বড়ে মুবারক আলি যেসব কব্বাল বচ্চেদের দ্রুত খেয়াল গাইতেন তার মধ্যে দু চারটির সন্ধান আমি পেয়েছি এবং গেয়েও থাকি। এর মধ্যে একটি শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকরের হিন্দুস্থান কোম্পানির প্রথম রেকর্ডে গাওয়া রাগ বাহারে ‘আয়ে দমনুবা লায়ে সোধে সুগন্ধ বিখ্যাত গান।
কেন নথ্থন পীর বখশের গায়কির সঙ্গে তাঁর নাতি হদ্দু ও হসু খাঁর গায়কি মেলে না, এর সন্ধান ‘কুদ্রত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’র সপ্তম পরিচ্ছেদে পাবেন। হদ্দু, হসু, নথুথু তিন ভাই ঠাকুরদার শেখানো গায়কি প্রচুর গমক ও তানকর্তবের সঙ্গে গেয়ে মহারাজা দৌলত ও তার ছেলে জয়াজিরাও সিন্ধিয়ার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। গালগল্প লিখক না মনস্থ করেছিলাম, কিন্তু ইতিহাসে বিশেষ করে সঙ্গীতের ইতিহাসে গল্পের মধ্যেই ঐতিহাসিক তথ্য ও গবেষণার মালমশলা নিহিত থাকে, তা না হলে চারণ কবিদের গান ও গল্পর ওপর ভর করে টড় সাহেবের সুবিখ্যাত রাজস্থানের ইতিহাস লেখা হত না।
উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁর বর্ণিত তাঁর শ্বশুরের শ্বশুর হদ্দু খাঁর দু সের দুধে আটচল্লিশটা জিলিপি ও শ আড়াই ডন-বৈঠকের পর সার্সি জানলা কাঁপিয়ে চার ঘণ্টা গমক তানের রেয়াজের কাহিনী থেকেই আমরা আন্দাজ পাই গোয়ালিয়র গায়কিতে কী প্রকার ভারী লরজদার তান ও গমক তানের প্রাধান্য ছিল যার কিছুটা শোনা গেছে মুস্তাক হুসেন খাঁ ও বড়ে গোলাম আলি খাঁর গায়কিতে এবং বর্তমান যুগের বিলম্বিত খেয়ালে যা দুষ্প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সে কথা যাক, শকর খাঁর বড় ছেলে বড়ে মহম্মদ খাঁ গোয়ালিয়র এসে সব গোলমাল করে দিলেন। এঁর তানের ফিরত্ ও ধ্রুপদ ও কব্বালির ঢঙে মেলানো খেয়াল শুনে হদ্দু, হসু ও নথুথু মুগ্ধ। মহারাজেরও খুব ভাল লেগেছিল, তা সোজাসুজি বড়ে মহম্মদ খাঁর শিষ্য করে দিলেই ল্যাটা চুকে যেত। সম্ভবত নথথন পীর বখ্শের পরামর্শে মহারাজা একটি অনৈতিক কার্য করে বসলেন। উনি সমানে দুটি বছর নিয়মিত মহম্মদ খাঁর আসর করলেন নিজের খাস দরবারে আর তিন ভাইকে বসাতেন পর্দার পেছন।
দু বছর ধরে প্রাণপণ খেটে ছেলেরা মহম্মদ খাঁর গায়কি মক্শো করে ফেলার পর তাদের আলাদা গানের আসরে ঘোষণা করলেন এরা বড়ে মহম্মদ খাঁর সুননি শাগীদ অর্থাৎ তালিম না পেয়েও এরা শুনে শুনে গান এবং গায়কি তুলেছে। এর নৈতিক দিকটা মহারাজার মনে উদয় হয়নি, তাঁর কাছে তাঁর দরবারের উদীয়মান প্রতিভাই ছিল তাঁর গর্বের বস্তু। মহম্মদ খাঁ আর কী করবেন। অগত্যা তিন ভাইয়ের গাণ্ডা বেঁধে দিয়ে কিয়ৎকাল পরে মহারাজা রেওয়ার আশ্রয়ে চলে গেলেন।
বাদশাহ আকবর তানসেনকে রেওয়ার মহারাজার কাছ থেকে আগ্রায় নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও মহারাজা সিন্ধিয়া মহম্মদ খাঁকে ভাঙিয়ে আনতে পারেননি। আমি জীবনে একবারই রেওয়ার মহারাজার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম ৬৮ সালে।
তখন শ ওয়ালেস কোম্পানির রেওয়া কোলফিল্ডস লিমিটেড বোর্ড অফ ডিরেকটরসে ছিলাম আর তার অ্যানুয়াল জেনারেল মিটিং রেওয়াতে হয়েছিল কারণ স্বয়ং মহারাজা সে কোম্পানির একটি বড় শেয়ার হোল্ডার। রেওয়ার সাদা বাঘ মনে আছে, আরও মনে আছে তেরো বছর বয়সের যুবরাজ ঘরে ঢুকলে অতিথি অভ্যাগতদের সটান চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে সম্মান জানানো। তার মধ্যে শ ওয়ালেসের চেয়ারম্যান টোনি হেওয়ার্ডও ছিলেন। খোঁজখবর করেও এককালীন মার্গ সঙ্গীতের পীঠস্থান রেওয়াতে কোনও উল্লেখযোগ্য গাইয়ে বাজিয়ের সন্ধান পাইনি।
যাঁরা ঘরানার ইতিহাস এবং ইতিহাসের গল্প পড়তে চান তাঁরা আমার অন্য বই দুটি পড়ুন। এ প্রবন্ধে আমি বিভিন্ন ঘরানার শৈলী ও সৃজনী শক্তির ইতিহাস, অর্থাৎ কার প্রভাব কোন ওস্তাদের ওপর পড়ে এবং বিভিন্ন খেয়ালের অঙ্গ কোন কোন ঘরানায় গোয়ালিয়র থেকে আসে কিভাবে তারই আলোচনা প্রধানত করতে চাই।
[ বর্তমান খেয়ালের জন্মকথা – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]
আরও পড়ুন:
2 thoughts on “বর্তমান খেয়ালের জন্মকথা – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়”