রাজা মানসিংহ তোমর । শিল্পী জীবনী

রাজা মানসিংহ তোমর সঙ্গীত জগতে একটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তানসেন যদি ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়ক হিসাবে বরণীয় হন তবে গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ সঙ্গীতপ্রেমিক চিন্তাশীল বিদগ্ধরসিক ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রচারক হিসাবে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় পুরুষ। তিনি তাঁর শাসনকালে, পূর্বকার সঙ্গীতের প্রায় ১৫০ বছরের অন্ধকারময় যুগকে স্বীয় প্রতিভা বলে দুর করিয়া ভারতীয় সঙ্গীতকে এক নতুন গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের দিকে লইয়া আসেন। গুর্জন কন্যা মৃগনয়নীকে বিবাহ করিয়া তিনি সঙ্গীতের উন্নতিসাধনকল্পে নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে নিয়োজিত করেন।

রাজা মানসিংহ তোমর

রাজা মানসিংহ তোমর

রাজা মানসিংহের সময় হইতেই ধ্রুপদ গান নবরূপে ও ধারাবাহিকভাবে বর্তমানকাল পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। মানসিংহ তোমর ও রাণী মৃগনয়নী রাজ্যের সঙ্গীতের যে পরিবেশ গড়িয়া তোলেন তাহাতে বহু সঙ্গীত শিল্পী, অনুরাগী ও শিক্ষার্থী উপকৃত তথা প্রতিপালিত হন এবং সঙ্গীত চর্চা ও শিক্ষা গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁহার আইন-ই আকবরী গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন যে, গোয়ালিয়র তৎকালে ধ্রুপদ সঙ্গীতের পীঠস্থান ছিল।

রাজা মানসিংহ তাঁহার রাজত্বকালে নায়ক বস, মাহমুদ ও ভানু এই তিনজন গুণীর সহায়তায় এক বিশেষ পদ্ধতির সর্বজনস্বীকৃত ধ্রুপদ গানের প্রচলন করেন। ধ্রুপদের বর্ণনা দিতে গিয়া ফকিরুল্লাহ যাহা বলিয়াছেন তাহা হইল প্রধানত এই গীতকে গঠন করেন গোয়ালিয়রের রাজা মান। এটি চারটি কলিতে নিবন্ধ”। তিনি যে সঙ্গীত সম্মেলন আহ্বান করেন তাহাতে আগত নায়ক বসন্ত, নায়ক ভানু, মাহমুদ কিরণ, লোহইঙ্ক প্রভৃতি গুনীদের সহযোগিতায় এই গীত রচনা করেন।

 

Google news
গুগল নিউজে আমাদের ফলো করুন

 

রচনাকাল

রাজা মানসিংহ ১৪৮৫-১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোয়ালিয়রে রাজত্ব করেন। বলা বাহুল্য যে, তাঁর দরবারে গায়ক ও সঙ্গীতজ্ঞাদের প্রভূত সমাদর ছিল। রাজা মানসিংহ ও রাণী মৃগনয়নী দুইজনেই স্বামী হরিদাসকে সঙ্গীতগুরু বলিয়া বরণ করিয়াছিলেন। তাঁর সভায় নায়ক, চরজু, নায়ক (ঘুন্দি), ভোরী প্রভৃতি তৎকালীন প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন।

 

 

অবদান

ভারতীয় সঙ্গীতের পুররুজ্জীবনে রাজা মানের অবদান কয়েকটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া রূপায়িত ।

(১) তিনি ভারতবর্ষের সমস্ত গুণী সঙ্গীত শিল্পী ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানাইয়া সেই যুগের সঙ্গীতের একটি সাধারণীকৃত রূপ উদ্ধাবনের চেষ্টা করিয়াছিলেন।

(২) যে সকল গুণীজন উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন তাহাদের সঙ্গীত বিষয়ক মতামত তিনি একটি গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেন। উক্ত গ্রন্থের নাম “মানে কতুহল”। এই গ্রন্থটি পরবর্তীকালে এত জনপ্রিয় হইয়াছিল যে দুই একটি ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়।

(৩) ভারতীয় সঙ্গীতের ক্রিয়াসিদ্ধ ও ঔপপত্তিক এই দুই ধারার নিরঞ্জন অনুশীলন ও সৃজনশীল চিন্তার ফলস্বরূপ তিনি ধ্রুপদ রীতির একটি সর্বজন স্বীকৃত রূপ দিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে, রাজা মানসিংহ-ই হইতেছেন ধ্রুপদ গানের সর্বপ্রথম স্রষ্টা। এ কথা যদি সম্পূর্ণ সত্য না হয়। তবু নিঃসংশয়ে বলা চলে যে তৎকালে প্রচলিত ধ্রুপদ গানে তিনি নিজস্ব প্রতিভা দ্বারা এমন একটি বৈশিষ্ট্য আনিয়াছিলেন যে পরবর্তীকালে আমরা তানসেনের মধ্যে সেই গানের পরিপূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করি।

(৪) সর্বসাধারণের শিক্ষার জন্য তিনি সর্বপ্রথম গোয়ালিয়রের রাজদরবার উদ্যোগে সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার সময় হইতেই রাজদরবার হইতেই উচ্চ কোটির গান সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হইতে থাকে এবং জনসাধারনের এই সঙ্গীত ও শিক্ষালাভের সুযোগ পায়।

(৫) ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে পণ্ডিত ভাবত তাঁর “অনুপসঙ্গীত রত্নাকর” গ্রন্থে ধ্রুপদ গানের যে বর্ণনা দেন তাহা হইতেই বোঝা যায় যে উক্ত সময়ের পূর্বেই ধ্রুপদ একটি নির্দিষ্ট আকৃতি ও রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। দেশীয় ভাষায় রচিত, রাগালাপযুক্ত, শৃঙ্গার ভাব ও অনুপ্রাস সহকারে নথিসম্বলিত, উদ্‌গ্রাহ, ধ্রুব আভোগ ইত্যাদি বর্ণ সহযোগে রচিত সঙ্গীত হইল ধ্রুপদ গানের লক্ষণাক্রান্ত। এই পরিপাটি সুসম্পূর্ণ ধ্রুপদ গীতি রাজা।

 

 

মানের সময়ে গ্রথিত হইয়াছিল বলিয়াই শতাধিক বৎসরের মধ্যে পণ্ডিত ভাবভট্ট এমন সুনিপুন বর্ণনা দিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। ক্যাপ্টেন উইলার্ড বলিয়াছেন, “রাজা মানের সময় হইতেই যে শুধু ধ্রুপদ প্রচলিত ছিল তা নয়, তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত পক্ষে ধ্রুপদ গানের জনক”। আবুল ফজল প্রণীত “আইন-ই-আকরবীতে” এই কথার স্বীকৃতি মেলে। বস্তুত, ভারতীয় সঙ্গীতের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ও তার বিবর্তনের ধারায় এই কারণে রাজা মানসিংহ চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।

 

আরও দেখুনঃ

1 thought on “রাজা মানসিংহ তোমর । শিল্পী জীবনী”

Leave a Comment