লোকগীতি ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন : জানি না কোন তথ্যের বুনিয়াদে উপর্যুক্ত রাগগুলির সৃষ্টির কৃতিত্ব সুলতান শর্কীকে দেওয়া হচ্ছে। আমার ধারণা সিন্ধু ও সিন্ধু ভৈরবী সিন্ধু প্রদেশের লোকগীতির দান, যেমন জৌনপুরী জৌনপুর অঞ্চলের। যদিও টেমপার্ড, স্কেলের সা রে গা মা পা ধা নি সা শুদ্ধ স্বরের বিলাবল ঠাটের মূর্ছনা বদলালে কাফি, ভৈরবী, ইমন, খাম্বাজের সঙ্গে জৌনপুরী বা শুদ্ধ রেখাবের আশাবরীর আবির্ভাব হয়।
হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের ভিত যে দেহাতি গান, লোকগীতি বা ফোক মিউজিক এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। সিন্ধু, সুরট, বিহারী, মূলতানী, পাহাড়ী, জৌনপুরী, গুর্জরী, রাজস্থানের মাণ্ডু, বঙ্গ াল, ভৈরব মাত্র এই কটা নাম থেকেই আন্দাজ করা যায় কী ভাবে লোকগীতি হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের গতিশীলতা ও বৃদ্ধির (dynamic growt জন্য দায়ী। হালকা গানের ক্ষেত্রে এ বক্তব্য আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। যথা কাশী মির্জাপুরের চৈতী, বর্ষায় কাজরী ও ঝুলা, পঞ্জাবের উটসওয়ারিদের টপ্পা। শেষোক্ত অঙ্গ গোয়ালিয়র গায়কির মধ্যে ঢুকে খেয়ালকে সমৃদ্ধ করেছে।
পাহাড়ি অঞ্চলে একটা ধুন খুব চলে। গ গ গ রে সা সা সা সা সা ধপ, ধ সা রে গ, গগ গগ রে সা। এ শুধু কুমায়ুন গাড়ওআল নয় হিমালয়ের বহু অঞ্চলে এ সুর শুনতে পাওয়া যায়। এই সেই আদি ও অকৃত্রিম পাহাড়ি ধুন সা রে গ প ধ সা যার থেকে মার্গীকরণের ফলে বের হয়েছে ভূপালী, দেশকার, শুদ্ধ কল্যাণ, জৈৎ কল্যাণ ইত্যাদি। আবার এই স্কেল থেকেই মূর্ছনা বদলে বদলে মালকোষ, দুর্গা, ধানি, মেঘ এমনকি মারবা (যদিও এটি ঔড়ব নয়) ইত্যাদি রাগের সৃষ্টি হয়েছে। হিমালয়ের ওপারেও চীনদেশে পেণ্টাটনিক (ঔড়ব) স্কেলের রাগ শোনা যায় সর্বত্র। হংকং-এ ট্যাক্সিতে উঠলেই বাজবে ভূপালী বা মালকোষ। চীনের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বহুকালের। হতে পারে বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গে ঔড়ব ঠাটও আমরা রপ্তানি করেছি চীনে।
আমার কাছে একটি বড়ে গোলাম আলি খাঁর টেপ আছে, সাক্ষাৎকার করেছেন রেডিওর ঠাকুর জয়দেব সিং ও আমার পুরাতন লখনউ-এর বন্ধু সীতাশরণ সিং। খাঁ সাহেব লোকগীতি থেকে কী ভাবে শাস্ত্রীয় রাগের উদ্ভব হয়েছে, গেয়ে দেখিয়েছেন মাক্, কাফি, বিলাবল, পাহাড়ী ও জয়জয়ন্তী। যখন উনি দেহাতি গান গাইছেন, গাইছেন গাঁওয়ারদের মতনই অল্পবিস্তর কম সুরে। তার পরই সেই ধুনগুলি কী ভাবে সফিস্টিকেটেড ফর্মে রাগ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা গেয়ে দেখাচ্ছেন।
এমনই গলার ও সুরের ওপর খাঁ সাহেবের দখল ছিল। একবার পাঁচ সাত মিনিট উনি আমাদের গান শুনয়েছিলেন, সব পর্দাই লাগছে তানও করছেন আধ পর্দা কম সুরে। ইচ্ছে করে বেসুরো গান সুরেলা লোক হয়তো এক আধ মিনিট চেষ্টা করে গাইতে পারে, কিন্তু অসাধারণ এ প্রকার ভার্চুয়োসিটির প্রদর্শনী আমি কারও মুখে শুনিনি।
লোকগীতিতে নানা প্রকার ধুন পাওয়া যায় এপার ওপার বাংলাদেশে। কিছুদিন আগে রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির একটি গণসঙ্গীতের ওয়ার্কশপ উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলাম। দেখলাম যাঁরা অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা সকলেই প্রতিভাবান, গলাও ভাল কিন্তু যে প্রকারের গান রচনা হচ্ছে তার সঙ্গে কোনও আত্মিক বা সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পেলাম না।
এক সময়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে বছর পনেরো ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলাম, এখনও তার আনুভূতিক মূল্য আমার কাছে অসাধারণ। কিন্তু আমাদের সঙ্গীতের সঙ্গে একই স্কেল হলেও তা সম্পূর্ণ বিধর্মী। কারণ আমাদের সঙ্গীতে মেলডি আছে, মীড় ও শ্রুতি আছে যা পাশ্চাত্য বা চৈনিক সঙ্গীতে নেই। আবার আমাদের সঙ্গীতে হার্মনি ও কাউন্টার পয়েন্ট নেই যা পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দান। অনেকে দিশি ও বিলিতি সঙ্গীত মেশাবার চেষ্টা করেছেন অর্কেস্ট্রেশনে, শুনলে মনে হয় যেন পাউরুটি দিয়ে শুক্তো খাচ্ছি কিংবা ইডলি দিয়ে ক্যাভিয়ার।
গণসঙ্গীতের রচনায় দেখলাম পাশ্চাত্য গণসঙ্গীতের অপটু অনুকরণের ছড়াছড়ি এবং তার সেন্টিমেন্ট আমার মতো লোকের পরিচিতির চৌহদ্দির বাইরে। বলা বাহুল্য এই ধরনের পরীক্ষণে দু’চারটে গান অবশ্যই উৎরে যাবে কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পাওয়া যাবে না। ঠিক এই জিনিসই দেখছি বলিউড ফিল্মের গান ও টি ভি-র বিজ্ঞাপনের মধ্যে। গণসঙ্গীত যাঁরা রচনা করছেন ও গাইছেন তাঁরা ধরে নিচ্ছি বামপন্থী।
যদি তাই হয় তো আমাদের শহুরে কানেই যদি ও বেখাপ্পা লাগে, গ্রামে গঞ্জের লোকদের তো পিলে চমকে যাবে। এটা নিশ্চয়ই বামপন্থীদের মূলনীতির দায়রার মধ্যে পড়ে না। অন্যদিকে লোকগীতি যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আকর হতে পারে তো আধুনিক গণসঙ্গীতের সঙ্গে তার ভাসুর ভাদ্দর বউএর সম্পর্ক কেন?
অবশ্য নিবারণ পণ্ডিতের মতো রচয়িতাকে বাদ দিয়েই বলছি, এঁরা পশ্চিমের থেকে পুবের দিকে মুখ ফিরিয়ে আমাদেরই গ্রামীণ ধর্মসঙ্গীত ও কর্মসঙ্গীতের দিকে নজর দিলে আমাদের ভাটিয়ালি, বাউল পূর্ববঙ্গে [বর্তমান বাংলাদেশ] সত্যপীর, মাণিকপীরের গান, মুর্শিদি, দরবেশের গান, কুচবেহারের ভাওয়াইয়া, মালদার গম্ভীরা ঝুমুর ঝাঁপান, মুসলমানদের জারি এবং আদিবাসীদের টুসুর মধ্যে বেশ কিছু মালমশালা পাবেন যদি উদ্ভাবনী শক্তি থাকে।
কর্মসঙ্গীতের মধ্যে পড়ে সারি (সারিবদ্ধ নৌকা চালকদের গান), নবান্নের গান, ছাত পেটানোর গান, ধানকাটার গান। সেও তো গণসঙ্গীত এবং একান্তই আমাদের নিজেদের মাটির গান, জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ বা রাশিয়ার মাল নয়।
সুকুমার রায়ের একটি গান মনে পড়ছে।
ওরে ও হরিরামের খুড়ো,
তুই মরবি রে মরবি বুড়ো,
সর্দিকাশি হলদি জ্বর
ভুগবি কত জলদি মর। লেখক বলেছেন ওই মরবিরে মরবি-র ওপর একটু জোর দিতে হবে। একটু জোরজার না করলে সহজে হরিরামের খুড়ো মরবে কেন? এটা দেখছি গণনাট্য সঙ্গীতের রচনাকাররা ভালভাবেই বুঝেছেন।
‘রক্তে রাঙা ফসল’ বা ‘পুড়ে যাবে শত্রুর শানিত ফলা। ছিঁড়ে ফেল দৃঢ় হাতে চক্রান্তের জাল। শৃঙ্খল ভাঙার পণ আমার। মেহনত আমার সম্বল। বন্দর নগর তৈয়ার ইতিহাস আমার উজ্জ্বল।’ অথবা ‘ভাঙে বাঁধা নিরাশার অন্ধকার শোষণের বন্ধন কারাগারে।
এসব লাইন আমার কলেজের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট দিনের হিন্দি উর্দু শায়রি ও চল্লিশ পঞ্চাশ দশকের রেভলিউশনারি বাংলা গান ও কবিতায় উচ্চারিত সেন্টিমেন্টালিটি মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। তখনকার ঐতিহাসিক পরিবেশে হয়তো সলিল চৌধুরীর মতো ক্ষমতাবান মানুষের প্রয়োজন ছিল আর ওঁর বেশ কিছু গান লোকগীতি নির্ভরও ছিল।
এখন এই genre-এর সাহিত্যিক সাঙ্গীতিক বা নান্দনিক আবেদনের আলোচনার মধ্যে নাও যদি যাই, এর আজ রাজনৈতিক তাৎপর্যই বা কি? আর এর সুর ও ভাষা যাদের শৃঙ্খল আর যাদের রক্ত তারাই যদি না নিতে পারে, এ ধরনের রচনার পিছনে উদ্দেশ্য কি? এই বাংলায় তো শ্রেণীসংগ্রাম এখন রূপকথার পর্যায়ে পড়ছে, আর বাংলার বাইরে class war তো এখন caste war। কট্টর দক্ষিণপন্থীরা যদি আর কিছু দিন ওপরতলায় বসবার সুযোগ পান তো ধর্মযুদ্ধের সংগ্রাম ছড়াতেও দেরি লাগবে না।
[ লোকগীতি ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়]
আরও পড়ুন: