হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয় – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয়,  কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর ‘খেয়াল’ নামক সুদীর্ঘ প্রবন্ধের উপসংহারে লিখেছেন : – সমাজতাত্ত্বিকের চক্ষে মূল্যায়ন বা ভ্যালু জাজমেন্ট অপ্রয়োজনীয়। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির ইতিহাসের প্রধান বক্তব্য হল জৈব-সামাজিক জীবনে একটি অবিরত ও অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া এবং বিবর্তনের ধারা কখনই একপথে চলে না; তা মৃত্যুহীন কিন্তু তার রূপ (form) এবং স্তর (level) পরিবর্তিত হয়। অতএব সমাজতাত্ত্বিক হয়ত অবক্ষয় কথাটি ব্যবহার করবেন ভারতীয় সঙ্গীতের উৎসাহী ছাত্র ও পুরাতন ধারার গায়ক ও শ্রোতা হিসেবে আমি এই অবক্ষয়ের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য। এ জন্য বর্তমান প্রজন্মের কলাকারদের কাছে আগে থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে রাখছি।

 

হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয় - কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [ Kumar Prasad Mukherji ]
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় [ Kumar Prasad Mukherji ]

ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁর ১৯৪২ সালে প্রকাশিত Modern Indian Culture এর শুরুতে বলেছেন : আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতি এমনই এক বস্তু যার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয় অভারতীয়রা আর আমরা ভারতীয়রা ভাসাভাসাভাবে একে অনুভব করি। মূলত হিন্দু দর্শনের দ্বারা এই সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়েছিল এবং এই সংস্কৃতির মূল তত্ত্ব আত্মা এবং ব্রহ্ম-এর মধ্যে যে সম্পর্ক তাকেই ইঙ্গিত করে।

মুসলমানরা চিরকাল বলে এসেছেন আল্লা সর্বশক্তিমান, তাঁর কৃপা ছাড়া কোনও উচ্চমার্গের ফল লাভ করা যায় না। বৌদ্ধধর্ম ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করলেও উন্নত চেতনা বা higherself এবং কর্মফলের মর্যাদা ও জন্মান্তরবাদের ওপর তার প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। এই তিনের সংমিশ্রণ এবং ভিন্নধর্মী শক্তিদ্বয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির জন্ম ঘটেছে। তাই ভারতীয় সংস্কৃতি না হিন্দু না বৌদ্ধ না ইসলামীয়।

এই তিনের সংমিশ্রণ বা একীকরণের ফলে আমাদের যে ঐতিহ্য তা তিনপ্রকারের—ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অর্থাৎ composite-cultural tradition যার মধ্যে সাহিত্য, চারুকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য, সঙ্গীত, দৈনন্দিন সামাজিক আচার ব্যবহার এমনকি খাওয়াদাওয়া পোশাক আশাকও পড়ে, যার কিছু কিছু উদাহরণ পূর্বেই দিয়েছি।

স্থাপত্যে আলাই দরওয়াজা, ফতেপুর সিক্রি, পোশাকে চোগা চাপকান, মোগলাই খাদ্যে ভারতীয় মশলার অপূর্ব প্রয়োগ, ভাষায় উর্দু ও হিন্দুস্থানি, ধ্রুপদী সঙ্গীতে দেবদেবীর পাশেই করিম রহিম, খেয়ালে বৃজভাষায় রচিত রাধাকৃষ্ণের লীলার পাশেই ‘আল্লা তু বড়ে সাঁই তুহি রাম রহিম’ জাতীয় রচনা এ হিন্দু বা মুসলমানের একার সম্পত্তি নয়। এ ভারতীয় সংস্কৃতির দান।

যাঁরা হিন্দুত্ব বা টু নেশন থিওরি কপচান, তাঁদের ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাস কেন, কোনও সংস্কৃতির সঙ্গেই পরিচিতি আছে বলে মনে হয় না। অনেকে এও মনে করেন, পাশ্চাত্য প্রভাব না পড়লে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রাথমিক স্তরেই থেকে যেত।

মুঘল যুগের সঙ্গীত [ Mughal Empire Music ]
মুঘল যুগের সঙ্গীত [ Mughal Empire Music ]

ইতিহাস-সচেতনতা যাঁদের আছে, তাঁরা একমত হবেন না, তাঁদের বক্তব্য পাশ্চাত্য বণিক সম্প্রদায়ের আগমনের পূর্বে স্বদেশি এবং অন্তর্গামী শক্তি ভারতীয় সমাজকে কমবেশি একটি জৈব সম্পূর্ণতা দান করেছিল। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের দায়িত্ব ছিল পরিবার পালন, চাষবাসকে কেন্দ্র করে জাতপাত বা caste system-এর পরিকাঠামোর মধ্যে অর্থনৈতিক স্বনির্ভর পঞ্চায়েতের নির্দেশ মেনে জীবনযাপন।

একদিকে ছিল কৃষিকর্ম, অন্যদিকে বণিকবৃত্তি সওদাগরি ও মহাজনী কারবার—এই নিয়ে সমাজ স্বচ্ছন্দ গতিতে খুব সহজভাবেই এগিয়ে চলেছিল। বাংলাদেশে বৌদ্ধ মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা সমাজের উঁচুস্তরের মানুষ বিশেষত ব্রাহ্মণদের পক্ষে অস্বস্তিকর হলেও অন্যদের রীতিনীতি আচার ব্যবহারের মধ্যে কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ে না।

ভারতীয় সমাজ তখন ছিল বদ্ধ সমাজ এবং স্বভাবত একইরকম বহুকাল এই স্ট্যাটিক অবস্থায় থাকার ফলে সামাজিক সংস্কৃতির ভিত্তি ছিল মানুষের শারীরিক নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজন, এবং সেই প্রয়োজনের পরিপূরণের পন্থাকে কেন্দ্র করেই রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়েছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান—এই তিনেরই সেকালে সামাজিক জীবনদর্শন গঠিত হয় এই স্থির বিশ্বাসের ওপর যে, মানুষের ব্যক্তিসত্তা পরম সত্যের অনুগত এবং পরম সত্তাতেই এটি লীন হয়ে যায়।

মুঘল যুগের সঙ্গীত [ Mughal Empire & Music ]
মুঘল যুগের সঙ্গীত [ Mughal Empire & Music ]

অতএব এই সমাজের ভিত্তি ছিল সুদৃঢ় ও সুস্পষ্ট নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের ওপর। যে সকল মূল্যবোধ স্বর্গীয় অনুভূতি জাগায়, সেগুলিকেই স্থায়ী মনে করা হত, তার মধ্যে সঙ্গীত ছিল উচ্চে। সমাজের নেতা তাঁদেরই মনে করা হত, যাঁদের আধ্যাত্মিক জীবন অন্যদের চেয়ে উন্নত ছিল এবং যাঁদের দ্বারা বিভিন্নভাবে সমাজ উপকৃত হত।

এই জীবনদর্শনকে ইউরোপীয়রা এককথায় মিস্টিকাল বলেছেন এবং ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে এই ছিল ভারতীয় জীবনদর্শন। আমাদের বাল্যকালেও পল্লীগ্রামে বিশেষত পাহাড়ি অঞ্চলে কুমায়ুন গাড়ওয়ালে এর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। ব্রিটিশ শাসনের দুশ বছরে যা হয়নি, স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে এই মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, এবং শুধু তা শহরে মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দায়ী কারা তা সহজেই অনুমেয়।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

আজ থেকে হাজার বছর আগে আরব বণিকরা যখন ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে ব্যবসায়ের প্রয়োজনে এসে পৌঁছলেন, তখন শ্রেষ্ঠী সম্প্রদায় ছিলেন জৈন ও বৌদ্ধরা। ব্রাহ্মণ সভ্যতা এবং বর্ণাশ্রম তৎকালীন নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের বেশ কিছু মানুষের পক্ষে অপার্থিব এবং চরমপন্থী বলে বিবেচিত হওয়াটা আশ্চর্য ছিল না।

এই কারণেই কীভাবে পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্ম এবং ইসলাম মিলেমিশে গেল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাই আমাদেরই বাংলায়। শাসকবৃন্দের হাতে নিচুজাতের দলে দলে

ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার আগে বৌদ্ধরা সহজেই মুসলমান ধর্মকে গ্রহণ করেন। বস্তুত বাংলায় ‘নেড়ে’ কথাটা মুসলমানদের ক্ষেত্রে আমদানি হয়েছে মস্তকমুণ্ডিত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের থেকে, যাদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থানের পর উচ্চবর্ণের হিন্দুরা খুব একটা সুনজরে দেখতেন না। জৈনদের জীবিকা উপার্জন ছিল মহাজনীবৃত্তি থেকে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ইসলাম ধর্মে সুদ নেওয়া মানা, এই কারণে বৌদ্ধদের মতো জৈনরা ইসলাম ধর্মের দিকে ঝোঁকেননি। মুসলমান শাসকবৃন্দের রাজ্য চলত এই জৈন মহাজনদের হুন্ডির জোরে এবং এঁরাই ছিলেন ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের মেরুদণ্ডস্বরূপ। রাজস্থানের এবং ভারতীয় ক্যাপিটালিস্টরা অধিকাংশই এই সম্প্রদায়ের মানুষ।

সঙ্গীতের ইতিহাস ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অন্তর্গত, অতএব মুসলমান সত্তদের নিয়ে আলোচনা করতে হয়। আরব বণিকরা যে কর্ম শুরু করেছিলেন, তা বরাবর কায়েম রাখলেন এই ইসলাম ধর্মাবলম্বী সত্তরা, যাঁদের মধ্যে একাধিক সুফি সন্ত উল্লেখযোগ্য। এঁরা কট্টর মুসলমান তো ছিলেনই না, আর কী হিন্দু কী বৌদ্ধ কী পাঠান—এঁদের শিষ্যেরা ছিলেন অগুনতি। কব্বালী বা সমবেত ধর্মসঙ্গীত এঁদের সময়ে বহুলপ্রচলিত ছিল।

এঁদের মধ্যে বিখ্যাত নাম লাহোরের শেখ ইসমাইল (১০০৫ খ্রিস্টাব্দ), নথর শাহ ত্রিচিনাপল্লীর (১০২০), মৈনুদ্দিন চিশতি আজমীরের (১১৯৫), সিন্ধের সৈয়দ জালালুদ্দিন (১২৪৩), বাংলার শেখ জালালুদ্দিন (১২৪৪), বিজাপুরের পীর মহাবীর (১৩৫০), কচ্ছর ইউসুফ সাহেব (১৩৫০) এবং কাশ্মীরের আলি হামদান (১৩৮৮)।

Indian Classical Music Drawing 2

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে এঁরা হিন্দু-মুসলমানকে একত্র করে যে ভক্তি ও প্রেমের বাণী প্রচার করেন, তা সর্বজনগ্রাহ্য হয়। মৈনুদ্দিন চিশতির ভক্তরা পরে আজমীরের হুসেনী ব্রাহ্মণ নামে খ্যাত হন। এঁরা রমজান ও শিবরাত্রির সময়ে উপবাস করতেন, ঈদ ও রামনবমীর উৎসবে দলে দলে যোগদান করতেন। পুরুষরা মুসলমানী পোশাক পরতেন, স্ত্রীরা সিঁদুর দিতেন সিঁথিতে।

এই মিঞা ঠাকুরদের তুলনা পাওয়া যায় গুজরাটের কাকা ও সামিদের মধ্যে এবং শেষোক্ত সম্প্রদায়ের বংশধররা খোজা নামে অভিহিত, যাঁরা তাঁদের নেতা আগা খাঁ-কে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর—এই ত্রিমূর্তির অবতার বলে মানেন। এই আগা খাঁ-কে মহামান্য সম্রাট পঞ্চম জর্জ একবার প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ইয়োর হাইনেস, শুনেছি আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা আপনাকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করে—এ কথা কি সত্যি?’ উত্তরে আগা খাঁ বলেন, ‘এ আর আশ্চর্য কি ইয়োর ম্যাজেস্টি, হিন্দুরা তো শুনেছি গোরুকেও পুজো করে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

সৈয়দ মুজতবা আলি ‘বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, হিন্দুধর্ম ভিন্নধর্মাবলম্বীকে আপন ধর্মে গ্রহণ করে না। কাজেই অন্য ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ঔৎসুক্য নেই। মুসলমান বিধর্মীকে মুসলমান করতে চায়। উভয়ের মিলন চিত্তা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কিংবা মুসলমান মৌলবী কেউ করেন না।

হিন্দু পণ্ডিত মুসলমানকে বলেন, ‘তুমি দূরে থাক।’ মুসলমান মৌলবী হিন্দুকে বলেন, ‘এসো তুমি মুসলমান হবে। তৃতীয় পন্থা যে থাকতে পারে সেটা কারও মনে উদয়

হয় না। হিন্দু হিন্দু থাকবে, মুসলমান মুসলমান থাকবে অথচ উভয়ের মধ্যে মিলন হবে, হৃদ্যতা হবে। এ মতের চিন্তা করেছিল জনগণ। এটাতে তাদের ছিল প্রয়োজন, তাই এলেন ধর্মের জগতে জননেতা, জনাবতার কবীর, দাদু, নানক। অতএব এরপর আমরা আসব মধ্যযুগের সম্ভ ও মিস্টিকদের সময়ে রামানন্দ, কবীর, দাদু, নানক, লালদাস, গরিবদাস, চরণদাস, লীলাদেবী, বাংলার চৈতন্যদেব প্রমুখ।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এঁদের বাণীর সঙ্গে সুফিদের ধর্মোপদেশের এবং আধ্যাত্মিক কার্যকলাপের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই, এইরকমই ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে নিঃসন্দেহে এঁরা প্রচুর উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন এবং ফলে এই ভক্তিমার্গর আন্দোলন উত্তর ভারতব্যাপী একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপ নেয়।

শুধু জনসাধারণের মধ্যে এ আন্দোলন নিবদ্ধ ছিল না, কিছু উচ্চশ্রেণীর সামস্তশ্রেণীর মানুষরাও আকৃষ্ট হন, তবে তাদের মধ্যে রাজা-মহারাজাদের উল্লেখ খুব একটা পাওয়া যায় না।

চৈতন্যদেবের ভক্তদের মধ্যে তৎকালীন পুরীর রাজা ছিলেন কিনা এ নিয়ে মতভেদ আছে, এবং মহাপ্রভু চৈতন্যদেব যে নীলাচলে স্বেচ্ছায় দেহ রাখেননি, পাণ্ডারা তাঁকে খুন করেছিল, এ নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। এর প্রধান কারণ রাজগুরুরা ছিলেন ব্রাহ্মণ আর মধ্যযুগের বেশিরভাগ সত্তরা ছিলেন অব্রাহ্মণ বা কবীর, দাদু এবং রজ্জবের মতো অহিন্দু। এঁরা মূর্তিপূজা ও জাতপাতের খোলাখুলি বিরোধিতা করেন, পর্দাপ্রথা তোলার জন্য এবং পুরুষ ও জেনানাদের মধ্যে ধর্মশিক্ষার ব্যাপারে কোনও পার্থক্য না রাখার পক্ষে আন্দোলন করেন।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এ কারণে ব্রাহ্মণ ও তাঁদের শিষ্য সম্প্রদায়ের চক্ষুশূল হবেন ভক্তিমার্গীরা, এতে আশ্চর্যের বিষয় কিছু নেই। এতদ্ভিন্ন মিস্টিকদের এই আন্দোলনকে ব্রহ্মবিদ্যা ও বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী এবং প্রধানত আবেগভিত্তিক বলা যেতে পারে।

অতএব সাধারণের কাছে বিশেষত নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে এ আন্দোলনের আবেগ সর্বতোভাবে গ্রাহ্য ও উচ্চবর্ণের মানুষের কাছে ঘোরতর অপ্রিয় হবে এও বুঝতে অসুবিধে হয় না। এর থেকে যুক্তিযুক্তভাবেই এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে, সাধারণ মানুষের আবেগভিত্তিক সৃজনীশক্তিকে এই আন্দোলন নতুন প্রেরণা জুগিয়েছিল।

হিতেশরঞ্জন সান্যাল ‘বাংলা কীর্তনের ইতিহাসে লিখেছেন ভক্তি সাধনার পথ সর্বজনীন। চতুর্দশ শতক হইতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভক্তি আন্দোলনের এই বাণী সাধারণে প্রচারিত হইয়াছে। ইহার সূত্র আছে। শ্রীমদ্ভাগবতে। ভাগবত পুরাণে চণ্ডালেরও ভক্তিলাভের অধিকার স্বীকৃত। ভক্তি আন্দোলনের নায়কগণ সারা ভারতবর্ষে একথা প্রচার করিয়াছেন।

ভক্তি সাধনায় আচার অনুষ্ঠানের কোনও প্রয়োজন নাই। হিন্দু সমাজের জাতিব্যবস্থায় উচ্চনীচ, শুচি অশুচির ভেদ প্রকট। ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসনে ধর্মাচরণের অধিকার জাতিভেদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভক্তিধর্মে সামাজিক ভেদ বিচার নাই। …এই কারণে সমাজের নিম্নতর পর্যায়ে ভক্তিধর্মের প্রসার হওয়া স্বাভাবিক। সাধারণভাবে এই কথা বলা যায়, তবে বাংলায় ভক্তিধর্মের দ্রুত বিস্তার হইবার বিশেষ কারণও আছে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে বাংলায় বৌদ্ধ, শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, তন্ত্রসাধনা এবং নাথপন্থী প্রভৃতি গুহা সাধনার বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় প্রচলিত ছিল। বিভিন্ন গুহ্য সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতি স্বতন্ত্র, কিন্তু দর্শন চিন্তার মূল প্রত্যয় সকলেরই প্রায় এক।… দেহকে অবলম্বন করিয়া সাধনা করিলে খণ্ড ব্যক্তিজীবনে ব্যষ্টি অতিক্রম করিয়া বিশ্বজনীন অথণ্ডে উপনীত হওয়া সম্ভব।

অখণ্ড বিশ্বজনীনতা বোধ জন্মিলে প্রাণবায়ু অচঞ্চল হয়। কালজ্ঞান ও জীবনমৃত্যুর ভেদ লোপ পায়। মনের এই অবস্থাই পরমজ্ঞান। তন্ত্রশাস্ত্রের মতে অখণ্ড বিশ্বজনীনতার বোধ আসে যৌন-যৌগিক সাধনার পথে।… বৌদ্ধতন্ত্র অনুসারে আত্মজ্ঞান বোধিচিত্তে অভিব্যক্ত হয়। বোধিচিত্ত হইতে নির্বাণ লাভ সম্ভব।

শাক্ততন্ত্রের মতে আত্মজ্ঞানের বিকাশ হয় পরমসামরস্যের উপলব্ধিতে। সামরস্য অখণ্ড, অনাবিল আনন্দময় কৈবল্যানন্দের অনুভূতিতে উত্তরণ, এই অনুভূতিই সিদ্ধি।… তন্ত্রসাধনার তত্ত্ব অনুসারে বৈষ্ণব সহজসাধকরা মনে করেন প্রত্যেক নর ও নারী স্বরূপতঃ কৃষ্ণ ও রাধা।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এই বাহারূপের চেতনা অতিক্রম করিতে হইবে। ইহার জন্য প্রয়োজন আরোপ সাধনা।… মানুষের মধ্যেই রাধাকৃষ্ণের নিত্য প্রেমলীলা অনুষ্ঠিত হইতেছে। এই উপলব্ধি জন্মিলে ঐহিক ও পারমার্থিক জগতের পার্থক্যজ্ঞান থাকে না। সাধক অখণ্ড আনন্দে স্থিত হন। প্রেমের স্বভাব আনন্দ, আনন্দেই মুক্তি।

চৈতন্যদেব এসে বাঙালিকে এই গুহ্য সাধনার য়ম্নিয়ম ও ঝুটঝামেলার হাত থেকে অব্যাহতি দিলেন। গোপন যৌগিক প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রেমভক্তি লাভ সম্ভব। হিতেশরঞ্জন লিখেছেন, ‘প্রেম দুরারোহ দুঃসাধ্যও নয়।

প্রকাশ্য সম্মেলক কীর্তনের নৃত্যগীতসঞ্জাত অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের উল্লেখ ও তজ্জনিত ভাবোন্মত্ততা হইতে প্রেমের অনুভব জন্মাইবে। অনাড়ম্বর আচার বিরহিত পথে এই সাধনা।’ ভালবাসা ও প্রেমের তত্ত্ব থেকে যে শিল্প সবচেয়ে লাভবান তা হল সঙ্গীত এবং তা শুধু বঙ্গে নয়। সুফিদের দান–হিন্দুস্থানি সঙ্গীতে বিশাল।

আগেই বলেছি ভারতীয় সঙ্গীতের ধারা দু’ভাগে বিভক্ত ছিল—মার্গ সঙ্গীত ও দেশি। দ্বিতীয়টিই বিশেষভাবে এই আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে। সাম্প্রদায়িক ভক্তির প্রতিষ্ঠিত রূপ হল নামগান। সব সম্প্রদায়ের লোকের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিয়মমাফিক যথাযথ প্রয়োগ আশা করা উচিত নয়।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

সঙ্গীত যখন প্রিয়জনের সন্ধানরত অতৃপ্ত আত্মার ভাষা এবং অপার্থিব সত্তার সঙ্গে সোজাসুজি সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে, তখন প্রচলিত প্রথা থেকে সরে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়। লোকগীতিকে যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উৎস বলে মানি তো এই ভক্তিমার্গের আন্দোলনকে সঙ্গীতের ইতিহাসে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।

এর সঙ্গে কবালী তথা খেয়ালের শুধু নয়, হোরি ধামারেরও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। হোলি ও ঝুলনের সুন্দর ছন্দের সাধারণ বোধ্য কাব্য, আঞ্চলিক সুর, শাস্ত্রীয় রাগের এবং লোকগীতির অপূর্ব সংমিশ্রণ এ সবই ধীরে ধীরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দায়রার মধ্যে এসে পড়ে এবং কালে উচ্চ মর্যাদা লাভ করে।

খেয়ালে যে ব্রজভাষায় শ্রীকৃষ্ণের বাললীলার বর্ণনা পদে পদে পাই তারও উপাদান সন্দেহাতীতভাবে জুগিয়েছে এই মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলন। প্রভাবিত হয়েছে মহারাষ্ট্রের অভঙ্গ এবং বাংলার কীর্তন যা কিছু পণ্ডিতের মতে প্রাথমিকভাবে ঝুমুরের গায়কিতে গাওয়া হত, পরবর্তীকালে অনেক বেশি উন্নত গায়কিতে বিভিন্ন তালে গাওয়া হয়। লক্ষণীয় বিষয়, ষোড়শ শতাব্দী অবধি ইউরোপীয় চার্চ মিউজিক আমাদের মতই একহারা linear music ছিল, সমবেত প্রার্থনা সঙ্গীত থেকে হার্মনির জন্ম হয় যা আমাদের নামগানে বা করবালীতে হয়নি।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ভারতীয় সঙ্গীতে বিশালতম অবদান মুসলমান শাসকতন্ত্রের, অর্থাৎ পাঠান ও মোগলদের সময়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইউরোপীয় সঙ্গীতেও আমূল পরিবর্তন আসে, তবে ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে একাধারে পার্থক্যের এবং সাদৃশ্যের মূল কারণ ইউরোপে রেনেসাঁস আর ভারতে ভক্তিমার্গের আন্দোলন যার চরিত্র আবেগভিত্তিক এবং যার মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক বিপ্লবের বীজ নিহিত ছিল।

উভয়ের মধ্যে মিল পাওয়া যায় তিনটি বিষয়ে, প্রথাবিরোধী ধারা, মানবতাবাদ ও পরবর্তীকালে সামন্ততন্ত্রর পৃষ্ঠপোষকতা। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলামীয় ধর্মতত্ত্বর একীকরণে যে ভক্তিমার্গর বৈশিষ্ট্য পাওয়া গিয়েছিল তা ধীরে ধীরে গোঁড়ামিতে পর্যবসিত হয়। ঠিক এইরকমই মুসলমান শাসকতন্ত্রের হাতে জনসাধারণের দান যে সাধারণী গীতি তা অলঙ্কারবহুল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রূপ নেয় দরবারের আবদ্ধ প্রকোষ্ঠে। প্রাচীন প্রবন্ধগীতির চেহারা বদলে দাঁড়াল ছয় এবং চার-তুকের ধ্রুপদে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

প্রথমে সংস্কৃত ও পরে খড়িবোলিতে। সাধারণ গীতি ও কব্বালীর মিশ্রণে জন্মাল খেয়াল তা আর জনসাধারণের সম্পত্তি রইল না। কীভাবে এ খেয়াল আমীর খুসরো ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে জৌনপুরে সুলতান শর্কীর সময়ে দরবারে আদৃত হল এবং মোগল যুগে শাহজাহানের সময় থেকে ধ্রুপদের পাশাপাশি খেয়াল কলাবন্ত মহলে নিজের স্থান করে নিল এ আলোচনা আমি আগের প্রবন্ধে করেছি।

খেয়ালের বোলবোলাও হল অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাদশাহ মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার আমলে এবং লখনউ-এ আসফউদ্দৌলার দরবারে। এখানেই জন্ম নিল আমাদের পরিচিত বর্তমান খেয়াল যা রপ্তানি করল লখনউ গোয়ালিয়রে। যে খেয়ালের জনসাধারণের সাধারণী গীত ও কবালী থেকে উৎপত্তি সে দরবারের প্রকোষ্ঠে সাধারণ শ্রোতার অন্তরালে চলে গেল এবং বিবিধ ঘরানার জন্ম দিল যার মধ্যে বিখ্যাত গোয়ালিয়র, আগ্রা, পাতিয়ালা, জয়পুর ও কিরানা।

গায়কি ও স্বরপ্রয়োগে পার্থক্য থাকলেও এসব ঘরানাগুলির মূলতত্ত্ব ও অঙ্গগুলি একই। সাধারণ শ্রোতাদের জন্য হাতের পাঁচ তোলা রইল ধর্মসঙ্গীতগুলি : ‘সোজ্ মর্সিয়া নট’ বাংলায় কীর্তন কবিগান ও পাঁচালি, মহারাষ্ট্রে অভঙ্গ ও ভজন এবং আঞ্চলিক লোকগীতিগুলি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পীভূত হওয়ার এটি প্রধান কারণ।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এরই সঙ্গে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল নানাপ্রকার গোঁড়ামি যা অবক্ষয়ের সূত্রপাতের প্রধান লক্ষণ। নিয়মকানুন বিহীন কোনও শিল্পকলার অস্তিত্ব সম্ভব নয় কিন্তু অতিনিয়ম তার গতিশীলতার অন্তরায়। এর ফল কী হল তা আমি ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’র উপসংহারে আলোচনা করেছি। উদ্ধৃতি দিচ্ছি ২২৫ পৃষ্ঠা থেকে।

যদি জাতপাত বা caste system উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের গতিবৃদ্ধির পথে প্রতিবন্ধক হয়েছিল তো আর একটি প্রতিবন্ধক ছিল ঘরানা। যাঁদের এ অধমের সঙ্গে পরিচয় আছে তারা ছোটমুখে এত বড় আশ্চর্য কথা শুনে বেবাক হবেন। কিন্তু আমি সঙ্গীতের দুনিয়াতে ঘোরাফেরা করলেও অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে নাচার। সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এ কথাও বলতে হবে যে ঘরানা না থাকলে মার্গসঙ্গীতের বিশুদ্ধতা ও তার বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যেত, ভিন্ন ভিন্ন গায়কি বা স্টাইলের সৃষ্টি হত না।

আমরা ভারতীয়রা নিয়ম-পদ্ধতি এবং system building-এ বিশ্বাস করি, শাস্ত্র না থাকলে পরম্পরা দিয়ে কাজ চালাই। আবার সে সব ঘেঁটে কেউ নতুন শাস্ত্র লেখবার চেষ্টা করলে মারমুখো হয়ে যাই, যে কারণে ভাতখণ্ডেজির বাপাত্ত না করে সে-কালের ঘরানাদার ওস্তাদরা পাঁচ বৃত নমাজ পড়তে দ্বিধা বোধ করতেন।

ঘরানাকে (Pre-industrial culture-এর) Guild system-এর সঙ্গে তুলনা করলে হয়ত অর্থনৈতিক ইতিহাসের ছাত্ররা কেউ কেউ আপত্তি করতে পারেন, কিন্তু আমি অনেক সাদৃশ্য পাই। ব্যবসায় শিল্পের আগের যুগের ইউরোপ ও ভারতের ‘গিল্ড সিস্টেমে’র জন্ম অর্থনৈতিক এবং তা কারু ও কুটির শিল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঘরানাতেও তাই গাণ্ডাবন্ধন আনুগত্য বা loyalty-র প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হত।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ওস্তাদ খাওয়া-পরার ভার নিতেন এবং প্রতিদানে শিষ্য জুতো ঝাড়া থেকে হুককা ভরা পর্যন্ত সব কাজ করে চাকরবাকরের খরচা বাঁচাত। তালিম ছিল স্বরসাধনা, পাল্টার রেয়াজ, বন্দেশ রাগরূপ ইত্যাদি। বন্দেশ ছিল সিন্দুকে তোলা অমূল্য ধন, কারণ তা পুরুষানুক্রমে সংগৃহীত ও তারই মধ্যে রাগরূপের চাবিকাঠি আছে। এ সব বংশপরম্পরায় মুখে মুখে এসেছে এবং শাগিরদের মধ্যে যৎসামান্য লেখাপড়া জানলেও কাগজ-কলমের ব্যবহার কালে ঘোরতর সন্দেহের চোখে দেখা হত।

এই কারণে বন্দেশের চেহারা ধাপে ধাপে কিছু কিছু পরিবর্তিত হত, আর তার বহু রচনার মানে উদ্ধার করতে এক প্ল্যানচেটের সাহায্য নেওয়া ছাড়া সবরকম চেষ্টা করেও ভাতখণ্ডেজি অনেক সময় অকৃতকার্য হয়েছেন।

রাগের চেহারাও তাই ঘরানা অনুসারে কিছু কিছু পৃথক হত। যথা বসন্তে পঞ্চম বর্জিত ছিল, আবার (কোমল ধৈবতের সঙ্গে) পঞ্চম লাগলে তাকে পরজ বসন্ত বলা হত। রাগ পঞ্চমে পঞ্চম বর্জিত, কোমল রেখাব লাগত আবার লাগতও না। নায়কি কানাড়ায় বেশির ভাগ ঘরানায় ধৈবতের প্রয়োগ নেই আবার রামপুরের পাওয়া একটি বন্দেশে আছে—যা অন্য ঘরানাদাররা নাও

মানতে পারেন। ভৈরবীতে তীব্র মধ্যম শুনেছি গহরজান প্রথম চালু করেন, কিন্তু কিরানায় তার আগেও প্রচলিত ছিল। তিলক কামোদে কোমল নিখাদ কেউ কেউ লাগান আবার ফৈয়াজ খাঁ আলতো করে কোমল গান্ধারও লাগাতেন।….

(একবার ওঁকে [ফৈয়াজ খাঁকে) প্রশ্ন করা হয়েছিল তিলক কামোদে কোমল গান্ধারের প্রয়োগ জায়েজ অর্থাৎ শাস্ত্রসম্মত কিনা, জবাবে উনি বলেন, ‘কভি নহি, হরগিজ নহী।” উনি যে লাগান এ প্রশ্ন উত্থাপনের উত্তরে উনি বলেন ‘কিয়া করে, বহুতো আহি যাতা, মজবুরি।)

ভাতখণ্ডেজি প্রসিদ্ধ ধ্রুপদীয়া জাকিরুদ্দিন, আল্লাবন্দে খাঁ, রাধিকা গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, ধামারী চন্দন চৌবে, খেয়ালিয়া মুতাক হুসেন, ফৈয়াজ খাঁ। প্রমুখকে নিয়ে সেমিনার করে রাগরূপ Standardise করার পূর্বে রাগসঙ্গীতের জগতে যেমন বৈচিত্র্য ছিল তেমন মাৎস্যন্যায়ের তুলনা ছিল না।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

….এতাবৎ যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে তার মধ্যে কিছু ঘোরপ্যাঁচ নেই এবং এ হল-সমাজতাত্ত্বিকের প্রাক্ ঊনবিংশ হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, যখন ওস্তাদী গান মাত্রেই ছিল দরবারের গান। ঊনবিংশ শতাব্দীর সত্তর আশির দশক থেকে শহরে পয়সাওয়ালা বেনিয়ান মুৎসুদ্দি বা ধনী সওদাগরের নজর গেল সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিকে। সে-যুগে শুধু পয়সা থাকলে প্রতিষ্ঠা হত না। সর্বপ্রথম মানদণ্ড ছিল জমিদারি, তালুক মুলুক আছে কিনা, কারণ, যাদের আছে তাদের জাত আলাদা।

দ্বিতীয়ত দোল, দুর্গোৎসবে বাইজির নাচ, ওস্তাদী গান, দানধ্যান, পালাপার্বণে কাঙালি ভোজন ইত্যাদি করাবার ক্ষমতা আছে কি না। তৃতীয়ত, বাঁধা মেয়েমানুষ কটি আছে এবং বাবু তাদের কী হালে রেখেছেন। যেহেতু সওদাগরপুত্তুররা অভিজাত বংশের ছিলেন না, এবং কার্যবশত শহরেই তাঁদের ডেরা কায়েম করতে হত, ধীরে ধীরে কালোয়াতী গানের এক নতুন পৃষ্ঠপোষক শ্রেণীর সৃষ্টি হল। শুধু কলকাতায় নয় বোম্বাইয়েও। এঁদের বৈঠকখানাতেই প্রথম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বন্ধু, চাটুকার এবং চামচারা ওস্তাদী গানবাজনার আস্বাদ পেল।…

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

এতকাল দেশি লোকসঙ্গীতপুষ্ট মার্গসঙ্গীত তার বলিষ্ঠতা হারিয়ে দরবারে আবদ্ধ হয়ে অলঙ্কার বাহুল্যের মধ্যে প্রস্তরীভূত হয়ে যাচ্ছিল। গোয়ালিয়র ও পাতিয়ালা গায়কির অহেতুক তান প্রবণতা এরই নিদর্শন। তানকর্তব অলঙ্কার মাত্র। রাগরূপ, বিস্তার, বন্দিশের রূপায়ণ, তালের মজা এগুলির পরে সবশেষে আসে তান।

মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হলেই প্রশ্ন ওঠে অলঙ্কারের। ধ্রুপদীদের অন্তস্তলভেদী গমক লড়ও আর তাল ঠোকাঠুকিও ধ্রুপদের সুশ্রাব্যতা ও জনপ্রিয়তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজ এর আস্বাদ পূর্বে পায়নি। এই প্রথম তাদের পরিচয় ঘটল কালোয়াতী গানের সঙ্গে।

বাদশাহ্ জালালুদ্দিন আকবর একদিন মিয়াঁ তানসেনের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘আপনার মত কলাকার হাজার বছরে একটি জন্মায়, এরকম গান ভূভারতে আর কেউ গাইতে পারে না আমার বিশ্বাস।’ উত্তরে তানসেন বললেন, ‘আলমপনা, আমার গুরু

স্বামী হরিদাস জীবিত থাকতে এ কথা বলবেন না, তাঁর গানের পাশে আমার গান তো তুচ্ছ।’ আকবর বললেন, ‘বটে! তাহলে তাঁর গান তো শুনতে হয়। অবিলম্বে তাঁকে জানাও আমি তাঁর গান শুনতে অতীব উৎসুক। কবে দরবারে তাঁর গান হবে তার ইন্তেজাম করা হোক।’ তানসেন বললেন, ‘জাঁহাপনা তো দীন দুনিয়ার মালিক, কিন্তু আপনার যিনি মালিক তাঁকে নিবেদন করেই তো আমার গুরু গান করেন, তিনি।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

তো দরবারে আসবেন না, গান তো দূরের কথা। তাঁকে শুনতে হলে যেতে হবে তাঁর কুটিরে, প্রত্যূষে যখন তিনি তাঁর সঙ্গীত কায়মনপ্রাণে ইষ্টদেবতাকে উৎসর্গ করেন। একটি বিখ্যাত মোগল পেন্টিংয়ে দেখা যায় স্বামী হরিদাস গান করছেন, কুটিরের বাইরে জোড়হস্তে দাঁড়িয়ে মিঞা তানসেন আর তাঁর পেছনে মোগল সম্রাট জালালুদ্দিন আকবর।

এ ঘটনার উত্থাপন করার উদ্দেশ্য শুধু ভারতীয় জীবনদর্শনের পুনরুল্লেখের জন্য। শুধু স্বামী হরিদাস কেন, প্রাচীনকালে কলাকারদের গভীর বিশ্বাস ছিল সঙ্গীত একটি সাধনার মার্গ। অতএব শ্রোতা ভগবান এবং সঙ্গীত নৈবেদ্য মাত্র। অর্থাৎ শোনানো হচ্ছে গায়কের অন্তরে যে শ্রোতা আছেন তাঁকেই। শিবোহম্। বহির্জগতের শ্রোতারা শুনছেন আড়ি পেতে। তাঁরা eaves dropper।

আবদুল করিম খাঁও গান করবার সময়ে তন্ময় হয়ে যেতেন, শ্রোতারাও সম্মোহিত হয়ে শুনত। পণ্ডিচেরির দিলীপকুমার রায়কে করিম খাঁ বলেছিলেন, ‘বাবুসাহেব আমি গান করবার সময়ে নিয়তই প্রভুর কৃপাপ্রসাদ প্রার্থনা করি।’ তিনি পেয়েওছিলেন। এই contemplative mood-এর গান বা সঙ্গীত ধ্যানযোগের পরম্পরার শেষ গায়ক আমীর খাঁ। তাঁর গানের শেষের অংশটি ছাড়া উনি শ্রোতাদের পরোয়া বিশেষ করতেন বলে মনে হয় না।

ঠুংরী পর্যন্ত কখনও আসরে গাননি, যদিও গোপনে বাড়িতে মূর্ছনা বদলে বদলে উনি অত্যন্ত সুশ্রাব্য ঠুংরী গাইতেন। এক-আধবার আমার মতো লোকেরও শোনবার সুযোগ হয়েছিল।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

দরবারে যখন হিন্দুস্থানি সঙ্গীত জাঁকিয়ে বসল তখন ওই শ্রোতার স্থান নিলেন রাজা বাদশাহ তাঁর আমলারা, বেশ কিছু সমঝদার এবং অন্যান্য গায়ক এবং বাদকরা। জমিদারিতন্ত্র উঠে যাওয়ার পূর্বে বেশিরভাগ রাজা ও নবাবরা শুধু ওস্তাদদের প্রচুর খাতির করতেন তাই নয়, অনেকেই ওস্তাদদের গাণ্ডাবন্ধ শাগীদও ছিলেন। দরবারী গানে শ্রোতাদের চিত্তজয় করার জন্য এই প্রথম দক্ষতা কুশলতা, এক কথায় ভার্চুয়োসিটির মূল্য বাড়ল।

সেই সঙ্গে আবির্ভাব হল অহং চেতনার। মুখে তাঁরা বলতেন আল্লার ফজল, ঈশ্বরের কৃপা, বুজুর্গদের দোয়া, হুজুরের বান্দানওয়াজি কিন্তু মনের মধ্যে থাকত আত্মপ্রশংসা এবং গলা ঘুরোনোর আনন্দ। শিল্পে অলঙ্কার বাহুল্য ও অহংবোধ যদি অবক্ষয়ের নিদর্শন হয় তো সঙ্গীতে অবক্ষয়ের পূর্বাভাষ এই দরবারী গানের সিলসিলায় যা ভারতীয় জীবনদর্শনের বিপরীতমুখী।

দক্ষিণে মন্দিরের স্থাপত্যের কারিগর শিল্পী এমনকি যে-রাজাদের হুকুমে মন্দির গড়া হয়েছিল তাদের মূর্তি দূরে থাকুক নামও পাওয়া যায় না, না পাওয়া যায় তাদের প্রাসাদের ধংসাবশেষ। শুধু মাদুরায় দেখেছি নায়েক  রাজা রানীর দুটি ক্ষুদ্র পুতুলের সাইজের জোড়হস্তে বিগ্রহের সামনে দণ্ডায়মান মূর্তি। ব্রিটিশ আগমনের সঙ্গে যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ওস্তাদি গানের প্রচলন হল তাঁদের সঙ্গে ভারতীয় বা বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক ছিল না।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

মধ্যবিত্ত কথাটা এখানে ব্যবহার করা হয়েছে বটে কিন্তু এর কোনও অর্থনৈতিক সংজ্ঞা নেই। বড়লোক বেনিয়ান মুৎসুদ্দিরাও এই মধ্যবিত্তের কোঠায় পড়েন। এই জন্য ভূদেব মুখোপাধ্যায় এই সম্প্রদায়কে ‘মধ্যবিধ’ বলেছেন এবং সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এঁদের ‘ভদ্রলোক’ আখ্যা দিয়েছেন। উপরন্তু তিনি এঁদের spurious middleclass বা মেকী মধ্যবিত্ত সমাজ বলেছেন তাঁর Modern Indian Culture, A Sociological Study নামক পুস্তকে। উদ্ধৃতি দিচ্ছি পৃ. ৮১ থেকে (তৃতীয় সংস্করণ Sociology of Indian Culture) :

Bengali culture takes its cue from the taste of these Calcutta compradors. When they first came into contact with the Company, Indian Society had not heard of them. They were neither of the old banking families, nor of the Brahmin caste. Later on, they would buy upland and became zamindars, patronise sanskrit to please the pandits, learn English, and ape their manners to play the saheb. In other words, they would be the Bhadralok or the Baboo…

They were the mutsaddis, the guarantee brokers, the ware house keepers, and so on. With the help of the first batch they consolidated the new middle class. None of them were scions the Jagat Seth family. But without exception they were all Hindus…

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

From the factotum of the English nabob to the frustrated Baboo of today is a continuous process. But between the commercial magnate of the past who would venture out to the Indies, to Champa, Bali, Sumatra and Ceylon.

cross the mountains into Burma & China, who would finance the adventure of the Kings, and fight them socially, if necessary, who could survive the loot of the Burgees and the durshanee of a couple of crores of tankhas to the Nawab of the Emperor, who would handle hundis with an all India criculation between such men on the one hand, and the progenitors of the Ghoses, Boses, Mitters, the Debs, the Lahas and the Basaks on the other, there was something more than a gulf.

It was a chasm in social evolution. The sense of this vacuity overhangs Bengali culture and accounts for its dissociation with its Indian context. It was sought to the filled with the debris of a Hindu nationalism, ancient glories, and the lumber of Western culture and democracy. Occasionally, better things would be thrown in. But the chasm remained, only the eyes became used to it. Not that it can now be bridged or should be bridged.

A sociologist can only note the fact of the break in the Indian Social process involved in the liquidation the older middle class and the creation of new landowning to foreign rule, and contrast it with the continuity in the rise of the industrial bourgeoisie in Europe out of its own feudal commercial orders.Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

With such a difference in the very of the elite group the brittleness of Indo Anglian Culture as compared to the solidity of the Victorian age should be obvious, with such a hiatus the growth of the elite much of the inner weakness of modern Indian renais sance, its nostalgia, its unrootedness, its haunting sense of inferiority, should only be natural.

ধূর্জটিপ্রসাদের মোদ্দা বক্তব্য এই মধ্যশ্রেণীর ঔপনিবেশিক উৎপত্তির মধ্যেই রয়েছে একদিকে তার আপন অক্ষমতার বোধ, অন্যদিকে জনগণের থেকে দূরত্ব, অথচ এঁরাই নতুন সংস্কৃতির নেতা ও ধারক। ভারতীয় প্রেক্ষিত থেকে এঁরা বিচ্ছিন্ন।

ভারতীয় রেনেসাঁসের এবং পরবর্তীকালের ইনটেলেকচুয়াল এবং কমিউনিস্টদের দুর্বলতা ও শিকড়হীনতার উৎস বহুলাংশে এই অভারতীয় হীনম্মন্যতা এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসন্ধান এবং অনুধাবনের অভাব।

ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর অসাধারণ পুস্তক ‘বাঙালির ইতিহাস আদিপর্বে যা লিখেছেন তার সঙ্গে উপরিউক্ত বক্তব্যের মিল আছে। সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হল এই প্রকার। নানা রাষ্ট্রীয় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানুষের ব্যক্তি বর্ণ ও শ্রেণীর স্বার্থবুদ্ধির প্রেরণায় অনাচার ও দুর্নীতির বোঝা যখন সমাজদেহের ওপর চাপে তখন সমাজ পঙ্গু ও দুর্বল হয়ে পড়ে।

সমাজের তখন দান ও গ্রহণ করবার এবং নতুন শক্তিকে আত্মসাৎ করে নিজেকে শক্তিমান করে তোলার ক্ষমতা থাকে না। এই পরিস্থিতি হিন্দু সমাজের হয়েছিল মুসলমানদের পুনরপি ব্রিটিশদের আগমনের সময়ে যে কারণে, সেই ক্ষীণ রাষ্ট্রীয় ও সমাজ ব্যবস্থা একটি ধাক্কায় ধসে পড়ল এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রশক্তি রাতারাতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

ব্রিটিশদের আগমনের পর আমাদের সমাজের সে শক্তি ছিল না যে বৈদেশিক সামাজিক প্রভাবকে আত্মসাৎ করে নতুন রূপ দিতে পারে। সেই কারণে যে ‘মধ্যবিধ’ বা ‘ভদ্রলোক’ সমাজের জন্ম হয়েছিল তারা অনুকরণে পটু আবার নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি তেমনই উদাসীন।

আর্য ভারতের রক্ষণশীলতা ও সনাতনী মনোভাব বাংলার চরিত্রে ছিল না, সেই কারণে ভারতের সংস্কৃতির মূল ধারা বেঁকে বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং ঠিক সেই কারণেই বৈষ্ণবধর্মের ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগ ওদিকে সহজেই জয় করতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে যে কবি ও গীতিকার প্রথম সর্বভারতীয় খ্যাতি লাভ করেন তিনি জয়দেব।

নীহাররঞ্জন রায়ের মতে শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞানচর্চায় বুদ্ধি ও মুক্তি অপেক্ষা হৃদয়াবেগের প্রাধান্য সেকালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আমি মনে করি নবদ্বীপ ও ভট্টপল্লীর পণ্ডিতেরা এর ব্যতিক্রমী ছিলেন। তবে এ কথা ঠিক এই নতুন ভদ্রলে সমাজ বুদ্ধিজীবী ছিলেন না আর ভারতীয় অথবা বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির কোনও প্রভাব এঁদের ওপর পড়েছিল বলে মনে হয় না।

এই সমাজের হাতে ভারতীয় সঙ্গীতের সমর্পণ অন্তত পূর্বাঞ্চলে অবক্ষয়ের দ্বিতীয় ধাপ বলা যেতে পারে। এর প্রধান খদ্দেররা ছিলেন বাবুর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বন্ধু চাটুকার, চামচারা।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

পরবর্তীকালে কিছু উচ্চশ্রেণীর ভদ্রলোকের প্রচেষ্টায় শহরে শহরে নানাবিধ সভা গড়ে উঠেছিল, কিছু সচ্ছল উচ্চশিক্ষিত যুবক যেমন পরবর্তীকালে গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, দিলীপকুমার রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রীতিবদ্ধ সঙ্গীতশিক্ষার পেছনে অর্থব্যয় করেছিলেন কিন্তু যেহেতু সে সময়ে কালোয়াতী গানবাজনা মানেই জাহান্নমের খোলা রাস্তা বিবেচিত হত, সে কারণে উচ্চমধ্যবিত্ত ইংরেজি শিক্ষিত ও ব্রাহ্ম সমাজে এর খুব একটা কদর হওয়ার কথা নয়।

বহু অর্ধশিক্ষিত বেকার তরুণ, যাদের কেরানিগিরি, ইন্সিওরেন্সের দালালি, টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করার কথা, তারা সে সস্তাগণ্ডার যুগে গানবাজনাকে পেশা করার কথা। ভাবতে লাগল।

মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি এই গভীর আগ্রহ হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের ইতিহাসে এক বিরাট ঘটনা এবং এই স্বল্প তালিম বা বেতালিমের গায়ক বাদকরা, যাঁরা অল্পবিদ্যার পুঁজি নিয়ে টিউশনি করে সঙ্গীতের প্রসারে নিজেদের নিয়োজিত করেন, এঁরাই অবক্ষয়ের পথ সুগম করে দিয়েছেন।

এ ধারা এখনও শুধু বর্তমান নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় এ ছড়িয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে বিশদ আলোচনা পরে করব।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

 

ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলায় একদল বুদ্ধিজীবীর উদয় হল তারা প্রায় সকলেই মধ্যবিত্ত সমাজের—তবে মুৎসুদ্দি ও বণিক সম্প্রদায়ের সন্তান নন। এঁদের অবশ্যই সেই ‘স্পিউরিয়াস মিডল ক্লাসে’র অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

ইতিহাসের প্রখ্যাত অধ্যাপক সুশোভন সরকার অমিত সেন ছদ্মনামে Notes on Bengal Renaissance (1940) নামক পুস্তিকাতে (১৯৭৯-তে মূল পুস্তিকাটি সহ আরও ৯টি প্রবন্ধ নিয়ে প্যাপিরাস প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয় On The Bengal Renaissance] এঁদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এঁরা অ্যাংলো-হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ছিলেন এবং অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে এঁরাও মূল ভারতীয় সংস্কৃতির ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। যাঁরা ছিলেন না তাঁদের কথা পরে আলোচনা করব।

১. ১৮১৪-১৮৩৩ সাল রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায়ের সমালোচকবৃন্দ যাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন গোঁড়া হিন্দু সমাজের মাথা রাজা রাধাকান্ত দেব, গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি রামমোহনের সঙ্গে রেষারেষি করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ [১৮২২) কাগজ বার করেন এবং কেশবচন্দ্র সেনের পিতামহ রামকমল সেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

২. ১৮৩৩-১৮৫৭ : অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রিফর্মার হেনরি ভিভিয়ান লুই ডিরোজিও এবং ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলনের অগ্রণী সুবক্তা রামগোপাল ঘোষ, ‘আলালের ঘরের দুলালে’র কথ্য ভাষায় সুপ্রসিদ্ধ লেখক প্যারীচরণ মিত্র, এভারেস্টের আবিষ্কারক রাধানাথ শিকদার, (একদা ইয়ং বেঙ্গলের নেতা| ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম সম্পাদক তারাচাঁদ চক্রবর্তী [১৮২৮), রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

এঁরাও সবাই মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ। যাঁরা হিন্দু সমাজে সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের নেতা ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সন্তানরা।

ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ এবং হিন্দু ইনটেলিজেনসার-এর [১৮৪৬] সম্পাদক কাশীপ্রসাদ ঘোষ, যিনি কবিতা লিখতেন, তবে ইংরেজিতে এবং [‘সংবাদ প্রভাকর’ সম্পাদক] ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, যাঁর বাংলায় লেখা কবিতা ও ছড়া আমাদের এক প্রজন্ম আগেও লোকেদের মুখে মুখে ঘুরত।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

৩. ১৮৫৭-১৮৮৫ সিপাহী বিদ্রোহের পর মহারানী ভিক্টোরিয়া যখন ভারতের সম্রাজ্ঞী হলেন, তখন ইংরেজি সভ্যতার প্রভাব বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজে ভালভাবেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়ের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে নাম করতে হয় মনমোহন ঘোষ, শিশিরকুমার ঘোষ, পেশায় ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল, নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, মনেপ্রাণে ইংরেজ স্বনামধন্য মাইকেল মধুসূদন দত্ত, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বেহাম, মিল ও সার ওয়ালটার স্কটের মানসশিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

কালীপ্রসন্ন সিংহ, বিদ্যাসাগরের অনুমোদনে যাঁর প্রচেষ্টায় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের সাহায্যে বাংলা ভাষায় রচিত মহাভারত তাঁরই প্যারীচরণ মিত্রর মতই কথ্য ভাষায় লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ সুবিখ্যাত, ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’র লাইব্রেরিয়ান এবং পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রলাল মিত্র, প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথ ড. মহেন্দ্রলাল সরকার যিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স-এর স্থাপনা করেন, ব্রাহ্ম সমাজের রায়বাহাদুর কেশবচন্দ্র সেন এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ব্রাহ্মধর্মের আন্দোলনের পাশাপাশিই হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন হয় যার জন্য, তিনি মধ্যযুগের সদ্ভদের মতই বিখ্যাত ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ (জন্ম ১৮৬২ ও মৃত্যু ১৯০২ সালে)।

৪. ১৮৮৫-১৯০৫ : এই সময়ের দুটি পৃথিবী বিখ্যাত নাম বিজ্ঞানে আচার্য জগদীশচন্দ্ৰ বসু এবং এই বেঙ্গল রেনেসাঁসের একটিই মাত্র মানুষ যাঁকে ‘টোটাল জিনিয়াস’ বলা যেতে পারে, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)।

৫. এই বেঙ্গল রেনেসাঁস বা নবজাগরণের জের পরেও চলেছে— রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুধীন্দ্রনাথ দত্তর পিতা বৈদান্তিক প্রবন্ধকার হীরেন্দ্রনাথ, ঐতিহাসিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও যদুনাথ সরকার, বিখ্যাত মনীষী ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

৬. সভ্যতার ইতিহাসে বরাবরই দেখা যায় বেশ কিছু বড়মাপের মানুষ একই সময়ে একই দেশে বা প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন, তারপর ধীরে ধীরে কলসির জল ফুরিয়ে আসে। সে দিক দিয়ে তথাকথিত বেঙ্গল রেনেসাঁসের ইতিহাস কিছু বেনজির ঘটনা নয়। দুই মহাযুদ্ধের মাঝেও অনেক বড়সড় লোক বাঙালির মুখোজ্জ্বল করেছেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ডাক্তারিতে স্যার নীলরতন সরকার, স্যার ইউ এন ব্রহ্মচারী ও রাজনীতিতে চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, ড. বিধানচন্দ্র রায়, বিজ্ঞানে সত্যেন বসু, মেঘনাদ সাহা, সঙ্গীতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং তাঁর ছেলে, জামাই ও শিষ্যবর্গ, সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী ও সবুজপত্রর সাহিত্যিকরা, পরিচয় গ্রুপ [ সুধীন্দ্রনাথের আমলের বিখ্যাত ‘পরিচয়’ এর আড্ডা] ও কল্লোল যুগের লেখকরা এবং এঁদের বাইরে দুই বিভূতিভূষণ।

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, অন্নদাশঙ্কর রায়, রাজশেখর বসু, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল ও সুবোধ ঘোষ, নীরদ চৌধুরি, জীবনানন্দ দাশ, আরও অনেকে। সত্যজিৎ রায় মারা যাওয়ার পর দেশে সৌরভ গাঙ্গুলি ও প্রবাসী অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বাঙালিরা উদ্বাস্থ হয়ে এখন নৃত্য করছে। ‘দুটি বই ল্যাজ মোর নাইরে’।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ধূর্জটিপ্রসাদ ও সুশোভন সরকার দুজনেই বেঙ্গল রেনেসাঁস কথাটি ব্যবহার করেছেন যদিও দুজনেই ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে এর তুলনা করেননি। এই বিষয়ে আমার বাল্যবন্ধু অক্সফোর্ডের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. তপনকুমার রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার বিশদ আলোচনা হয় এবং তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করছি।

দুটি বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। এক, পাশ্চাত্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে মিল ও গরমিল। দুই, ইউরোপের চতুর্দশ ও ষোড়শ শতাব্দীর মাঝে যে সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে যার জন্য প্রধানত দায়ী তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজ, সেই রেনেসাঁস বা সভ্যতার নবজাগরণকে কি ভারতবর্ষের ঊনবিংশ শতাব্দীর পণ্ডিত সম্প্রদায় এবং তাঁদের সৃজনশীলতার সঙ্গে তুলনা করা যায়?

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

দ্বিতীয় প্রশ্নটির আলোচনায় ঔপনিবেশিক ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার পাশ্চাত্য মধ্যবিত্ত সমাজের সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় কিনা এ বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা করা যেতে পারে। নিম্নলিখিত চিঠিটি ড. তপন রায়চৌধুরীর।

১, হক্সওয়েল গার্ডেনস

অক্সফোর্ড

কুমার,

তোমার প্রশ্নের উত্তর চিঠির আকারেই দিচ্ছি। যতদূর বুঝেছি তোমার মূল জিজ্ঞাস্য দুটি। প্রথম, সঙ্গীতচর্চার দিক থেকে উনিশ বিশ শতকের বাঙালি সংস্কৃতি, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঐতিহ্য নিতান্তই দুর্বল এবং অকিঞ্চন মনে হয়েছে তোমার বিশেষ করে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তর ভারতের তুলনায়। এবং তুমি এই দুর্বলতার মূল খুঁজে পাচ্ছ তাঁদের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অপরিচয়ে।

দ্বিতীয় কথা তুমি তোমার বাবা ধূর্জটিপ্রসাদ এবং ড. নীহাররঞ্জনের মত উদ্ধৃত করে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে spurious অর্থাৎ ভেজাল বা পাতি মধ্যবিত্ত বলে বর্ণনা করছ। এই প্রসঙ্গে উনিশ শতকে বাঙালির নবজন্ম বা নবজাগরণ হয়েছিল কি না সে আলোচনাও এসে পড়ে।

তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন নিয়ে আলোচনাই শুরু করি। সমাজশাস্ত্রীরা যতই চাঁচাছোলা সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করুন, ইতিহাসে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নানা স্তর ও তার নানা ধরনের জীবিকা বা পেশা নিয়ে গঠিত। তাদের যুগে যুগে পরিবর্তনও হয়েছে প্রচুর। পঞ্চদশ শতকে ইতালীয় শহরগুলিতে মধ্যবিত্ততার প্রধান ভিত ছিল ব্যবসা। তারই সুবাদে কারও রাজকীয় ঐশ্বর্য, কারও দিন চলে যাওয়ার মত রুজি রোজগার।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

বণিকসম্রাট মেদিচি বোর্জিয়াদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে ছোট-বড় নানা শ্রেণীর শিল্পী জীবিকা উপার্জন করত, তারাও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত। উনিশ শতকে উত্তর ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের যুগে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেরুদণ্ড নতুন শিল্পপতিরা। তাঁদের সঙ্গে নানা পেশার মানুষ—ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিত্রকর প্রমুখও আছেন। এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঐতিহাসিক কক্কা (Kocka) বলছেন মধ্যবিত্ত দু জাতের–সংস্কৃতিভিত্তিক আর সমাজ ও সম্পদ সৃষ্টি ভিত্তিক, তবে কে খাঁটি কে মেকী তা কে বলবে?

উনিশ শতকে বাঙালি মধ্যবিত্তর একটি বিশিষ্ট পরিচয়- colonial middle class, বাংলায় বললে বিদেশি শাসনের সৃষ্ট ও ভৃত্য মধ্যবিত্ত। ছোট মেজ চাকরি, জমিদারি বা মধ্যসত্ব, ডাক্তার, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক প্রমুখ পেশাদার মানুষ নিয়ে এই শ্রেণী গড়ে ওঠে। পশ্চিমী মধ্যবিত্তর তুলনায় এঁরা ক্ষীণজীবী তো ছিলেনই, দেখছি ১৮৬৭ সনে বঙ্গে মাসে ৭৫ টাকার বেশি রোজগার ১৩,৪৩১ জন মানুষের। তার মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ জনেরও কম বাঙালি। বছর কুড়ি পরে অবস্থার কিছু পরিবর্তন হয়। তবে খুব নয়।

কিন্তু এই সম্বল নিয়েই তারা নানা প্রচেষ্টায় এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্যেও নেমেছিল। চল্লিশের দশকে বেঙ্গল ব্যাঙ্ক ফেল পড়ল। চোট্টা সাহেব বাঙালি অংশীর ও সহযোগীদের পথে বসিয়ে বেলায়েত ফিরে গেলেন, বাঙালিরা পাত গুটিয়ে কোম্পানির কাগজ আর স্থাবর সম্পত্তিতে মূলধন নিয়োগ করলেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক ভিত্তি খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, সেই সীমিত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে সাহিত্যকীর্তি, দেশি-বিদেশি জ্ঞানের চর্চা, সমাজ সংস্কারের চেষ্টা, রাজনৈতিক চেতনা ও সংগঠন—সবই কিছু কিছু হল, হয়ত যুগান্তকারী ব্যাপার না, কিন্তু সব দিকের দরজা বন্ধ করে দেওয়া বিদেশি শাসকের আওতায় যা হল, তাকে অকিঞ্চিৎকর বলি কী করে?

সার্বভৌম ভারত রাষ্ট্রের উত্থানের চিন্তাও ওইখানে শুরু। ‘মা কি হইয়াছেন’ দেখে সে চিন্তার বিচার করলে ভুল হবে, তবে পূর্বপুরুষদের ‘পাতি মধ্যবিত্ত’ বলি কোন সুবাদে?

এবার এদের সংস্কৃতিগত ঐতিহ্যর কথায় আসি। প্রাক্ ব্রিটিশ যুগে আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী আমলের তুলনায় বেশিই ছিল মনে হয়, কিন্তু উচ্চশিক্ষা, সংস্কৃত বা আরবি ফার্সিভিত্তিক, অল্প লোকেরই আওতায় ছিল। বিদেশি শাসনে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ল ছাপাখানার কৃপায়, দেশি-বিদেশি – জ্ঞানবিজ্ঞানের খবর বহু লোকের কাছে পৌঁছল।

বললে ভুল হবে না যে, সংস্কৃতর জ্ঞানও আগের তুলনায় বেশিসংখ্যক লোকের আয়ত্তে এল। সঙ্গীত সম্পর্কে আমি অজ্ঞ, তবে নানা ধরনের কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, সুরে গাওয়া পাঁচালি (যাতে প্রতিটি গানের সুর ও তাল বাতলানো থাকত) এবং বাউল, জারি, সারি ইত্যাদি লোকসঙ্গীত বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্গত ছিল। বাঈজি মারফত মার্গসঙ্গীত তথা টপ্পা বাবু কালচারের অঙ্গীভূত হল। বাংলা গানের সংগ্রহও ছাপা হল।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

অবশ্যই পশ্চিমের বিপুল সংস্কৃতি সম্ভারের তুলনায় এ সব নিতান্তই তুচ্ছ, তবে ওদিকেও উচ্চশিক্ষার প্রসার খুব সাম্প্রতিককালে। অল্পদিন আগেও শেক্সপিয়ার পড়েছে এরকম ইংরেজ নিতান্তই সংখ্যালঘু ছিল, Country Squire বা গেঁয়ো জমিদাররা প্রায় নিরক্ষর ছিল। ন্যান্সি মিটফোর্ডের Lord Rededale জীবনে একটি বই পড়েছিলেন। রাজকন্যা অ্যান তাও নয়, সময় পান না।

যুদ্ধের সময়ে ইংরেজ রাজপরিবার এক গম্ভীর দর্শন রাজকর্মচারী মার্কা কবির পাঠ শুনে হেসে গড়িয়ে পড়েন, রানীমা বললেন, যতদূর মনে পড়ে কবিতাটির নাম ‘ডাস্টবিন’। কবির নাম মনে নেই, মনে পড়লে জানতেন নামটা টি এস এলিয়ট এবং কবিতাটির আসল নাম ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’। তবে কি উইন্ডসর রাজবংশ মেকী অভিজাত?

ইতি বশম্বদ

তপন

ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার সমাজ সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমায়িত। ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘আত্মচরিত’, রাজনারায়ণ বসুর ‘একাল ও সেকাল’, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ও মাইকেল মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ দীনবন্ধু মিত্রর ‘সধবার একাদশী’ প্রভৃতি খানকয়েক বই পড়েছি। পুরনো কলকাতা খোঁড়াখুঁড়িতে অভিজ্ঞ আমার বহুকালের বন্ধু প্রয়াত রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ও ‘সেই সময়’-এর প্রণেতা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে আমার যে ধারণা হয়েছে, তা এই প্রকার :

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

তৎকালীন সমাজের মাথা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু রাজা রাধাকান্ত দেব ও তাঁর বংশধররা, গৌরীকান্ত ভট্টাচার্য, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে রেষারেষি করে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ কাগজ বের করেন। অন্যদিকে ছিলেন রিফর্মাররা যথা ডিরোজিওর শিষ্যবৃন্দ এবং ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের নেতারা।

যাঁরা হিন্দু সমাজ সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন অথচ ইয়ং বেঙ্গলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে ৩টি উল্লেখযোগ্য নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হিন্দু পেট্রিয়ট এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখার্জি। বিদ্যাসাগর ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য, কারণ ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে এঁদের যোগাযোগ কখনই বিচ্ছিন্ন হয়নি।

একই কথা বলা যায় ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য নরেন্দ্রনাথ দত্ত বা পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ ও মনেপ্রাণে মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ ভূদেব মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে। রাজা রামমোহন রায়ের নাম সর্বাগ্রে আসে যাঁর ফার্সি, ইংরেজি ও সংস্কৃতর ওপর দখল ছাড়াও ভারতীয় সংস্কৃতির তিনি মূর্ত প্রতীক ছিলেন।

বাকি যাঁদের নাম এই পরিচ্ছেদে করা হয়েছে, প্রায় সবাইয়ের চিন্তাধারা ইংরেজি সভ্যতার সংস্পর্শে এসে প্রভাবান্বিত হয়েছিল এবং যদিও এঁদের মেকি মধ্যবিত্ত সমাজের সভ্য বলা আদৌ উচিত হবে না, কিন্তু ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সঙ্গে এঁদের ঘনিষ্ঠতা পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করি না।

Indian Classical Music Drawing 39

মনেপ্রাণে সাহেব মাইকেল মধুসূদন দত্ত পরিণত বয়সে তাঁর অসাধারণ কীর্তি ‘মেঘনাদ বধ’ রচনা করেন বটে, কিন্তু এতেও রামের পরিবর্তে রাবণকে হিরোর আসন দেওয়ার কল্পনা সম্পূর্ণ ইউরোপীয়, ভারতীয় নয় এবং সম্ভবত মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের প্রথম খণ্ডর দ্বারা অনুপ্রাণিত।

বেহাম, মিল ও সার ওয়াল্টার স্কটের মানসশিষ্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রৌঢ় বয়সে কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব এবং অনুশীলন তত্ত্ব লিখে প্রমাণ করলেন, উনি ভারতীয় সংস্কৃতির মূলধারায় প্রত্যাবর্তন করেছেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ পণ্ডিতদের বসিয়ে মহাভারতের অনুবাদ করিয়েছিলেন বটে, তবে একেও বেঙ্গ ল রেনেসাঁসের আর পাঁচজনের মতো ভারতীয় ধর্মীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা এককথায় Product of Indian composite cultural tradition বলা হয়ত সঙ্গত হবে না।

রাজা রামমোহন রায় এবং স্বামী বিবেকানন্দ ভিন্ন—সঙ্গীত তথা হিন্দুস্থানি রাগ সঙ্গীতে আগ্রহী কেউই ছিলেন না এক নাট্যকার গিরিশ ঘোষ ও বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া, ঠাকুরবাড়ির কথা স্বতন্ত্র। সে প্রসঙ্গে পরে আসব। যদু ভট্টর নাম ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই বিখ্যাত গায়কের কাছে তালিম নিয়েছিলেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

ওঁর ভাইপো ও জীবনী-লেখক শচীশচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় লিখেছেন ‘ত্রিশ বৎসরের পর “মৃণালিনী” লিখিবার সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাস ও বিজ্ঞানপাঠ আরম্ভ করেন। এই সময়ে সঙ্গীতশিক্ষার ঝোঁক চাপিয়াছিল। সুযোগও বেশ হইয়াছিল। কাঁঠালপাড়ায় একজন বহুবিশ্রুত গায়ক বাস করিতেন, তাঁহার নাম যদু ভট্ট তানরাজ। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতন দিতেন।

এই যদু ভট্টর নিকট বঙ্কিমচন্দ্র সঙ্গীতাদি শিক্ষা নিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র সুকণ্ঠ ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার তাললয়বোধ অনন্যসাধারণ ছিল। হারমোনিয়াম যন্ত্রে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন।’ (বঙ্কিমজীবনী, পৃ. ৩৬৯)।

আর একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালীর রাগসঙ্গীত চর্চা’ পুস্তকে পড়ে চমৎকৃত হলাম। সাধারণভাবে এই ধারণা প্রচলিত যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতের সুর সংযোজক। তাঁর ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থে প্রকাশিত বন্দেমাতরম্ গানের সঙ্গে সুরের উল্লেখ দেখা যায় মল্লার। কিন্তু এ সম্পর্কে একটি নির্ভরযোগ্য নির্দেশিকা আছে যা থেকে জানা যায় যে, ‘বন্দেমাতরম্’ গানে প্রথম সুর সংযোগ বঙ্কিমচন্দ্র করেননি, এ গৌরব প্রাপ্য তাঁরই সঙ্গীতগুরু যদু ভট্টর।

একদিন বঙ্কিমচন্দ্রের কাঁঠালপাড়া ভবনে যদু ভট্ট ‘বন্দেমাতরম্’ সঙ্গীতটি প্রথম সুর তালে গঠিত করে স্বয়ং গান করেন বলে প্রকাশ। সেদিনের এই স্মরণীয় ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তরঙ্গ সুহৃদ নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রর পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্র। সেদিন ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ও উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীকালে আমাদের অতিপরিচিত দেশ রাগে বন্দেমাতরম্ -এর সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

মেকি মধ্যবিত্ত বলতে ধূর্জটিপ্রসাদ ও ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁদের কথা অবশ্য ভেবেছেন যাঁদের হাতে সমাজের অর্থনৈতিক চাবিকাঠিটি ছিল। এঁরা ছিলেন বেনিয়ান মুৎসুদ্দি ও ব্যবসায়ীরা, যাঁরা পরে জমিজমা কিনে নিজেদের অভিজাত বলে গণ্য করতেন।

এঁদের সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, কলিকাতার অভিজাত ‘বাবু’ সম্প্রদায়রা ‘দিনে ঘুমাইয়া, ঘুড়ি উড়াইয়া, বুলবুলির লড়াই দেখিয়া, সেতার এসরাজ প্রভৃতি বাজাইয়া, কবি—ফুল আখড়াই, হাফ আখড়াই, পাঁচালি প্রভৃতি শুনিয়া রাত্রে বারাঙ্গনাদিগের গৃহে গীতবাদ্য ও আমোদপ্রমোদ করিয়া কাল কাটাইত এবং খড়দহের ও ঘোষপাড়ার মেলা এবং মাহেশের স্নানযাত্রা প্রভৃতির সময়ে কলিকাতা হইতে

বারাঙ্গনাদিগকে সঙ্গে লইয়া দলে দলে নৌকাযোগে আমোদ করিতে যাইত।’ আমাদের বিষয় সঙ্গীত। অতএব প্রাচীন কলকাতায় এই সঙ্গীতের স্থান নিয়ে আলোচনা করব। ড. উৎপলা গোস্বামীর ‘কলকাতায় সংগীত চর্চা’ নামক একটি পুস্তক সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমি প্রকাশ করেছে। নিম্নলিখিত তথ্যের জন্য আমি ড. গোস্বামীর কাছে ঋণী। তাঁর প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

নগরের অভিজাত সঙ্গীতের দুটি রূপ থাকে—বিশুদ্ধ রূপ এবং বিকৃত রূপ। বিশুদ্ধ অভিজাত গানগুলি প্রায়শই ধর্মীয় ভাবাপন্ন হয়ে কিছুকাল অবিকৃত থাকে। কিন্তু নগর জীবনের ভোগবিলাসী বাবুদের চাপে সেগুলি সবার অলক্ষ্যে বিনোদন সঙ্গীতের সঙ্গে মিশে যায়। সঙ্গীতোপজীবিগণ জীবনধারণের তাগিদেই হয়ত সাধারণ আমুদে নগরবাসীর উপযোগী করে গড়েপিটে নেন।Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

তৈরি হয় অভিজাত গানের বিকৃত রূপ… অভিজাত গানের আরেক প্রকার বিকৃত রূপও থাকে। শহুরে বাবুদের নিত্যনতুন আমোদের খোরাক জোগাতে গ্রামগঞ্জ থেকে বিচিত্র পল্লীগানের ডালি নিয়ে শহরে ছুটে আসে গ্রাম্য শিল্পীরা।

তরপর সেই গ্রাম্যগীতগুলি শহুরে বাবুদের রসনা তৃপ্ত করতে গিয়ে নিজেদের বিশুদ্ধ রূপ থেকে চ্যুত হয়ে অভিজাত গানের কিছু ভাসা ভাসা নিয়ম গ্রহণ করে এক নতুন বিকৃত রূপ ধারণ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

নগর কলকাতার সঙ্গীত চর্চার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলে আমরা উপরোক্ত তিন প্রকার অভিজাত গানই খুঁজে পাই। কলকাতার গোড়াপত্তনের সময়ে বাংলার বিশুদ্ধ অভিজাত গান বলতে কীর্তনকেই বোঝাত।

কলকাতার আদি অভিজাত পরিবার হচ্ছে তত্ত্ববায় সম্প্রদায়ের শেঠ-বসাক পরিবারবর্গ এবং তাঁদের আত্মীয়রা। এঁরা বৈষ্ণবভাবাপন্ন ছিলেন। সুতরাং, এঁদের গৃহে নানা উৎসব পার্বণাদিতে কীর্তন ছাড়া অন্য কোনও অভিজাত গানের চর্চা কল্পনা করা যায় না।

অন্যত্র উনি লিখছেন, ‘পালাকীর্তন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যানুসারে পাঁচটি প্রধান ঘরানায় স্বীকৃত হয়েছে। এগুলি গড়েরহাটি (গরাণহাটি), মনোহরশাহী, রেনেটি (রানীহাটি), মান্দারিনী এবং ঝাড়খণ্ডী। আজও প্রাচীনদের কণ্ঠে মহাজনদের রচিত যে ‘দাগী’ গানগুলি শোনা যায়, তাদের সুরগুলি বিশ্লেষণ করলেই লোকসঙ্গীতের সুরের প্রভাবকে স্পষ্ট অনুধাবন করা যায়।

Krithi lyrics in Tyagaraja's songs defined South Indian classic tradition of the 18th century

প্রশ্ন হতে পারে মহাজনদের রচিত শ্রীকৃষ্ণের জীবনলীলা বিষয়ক বিভিন্ন পদের শীর্ষদেশে যে রাগ-তালাদি চিহ্নিত হয়েছে—সেগুলির সার্থকতা কী?

এই প্রশ্ন শুধু আমাদেরই নয়, শাস্ত্রীয় পালাকীর্তনের মুখ্য প্রচারক শ্রীল নরোত্তম দত্ত ঠাকুরকেও (১৫৪০-১৬০৫) সেদিন ভাবিয়েছিল। তারই পরিণতিস্বরূপ খেতুরীর উৎসবে (১৫৮৫) নরোত্তম দত্ত ঠাকুর ব্রজভূমি থেকে শিখে আসা শাস্ত্রীয় রাগ তাল আলাপ বিশিষ্ট ‘বিষ্ণুপদ’ গানের অনুসরণে ‘শাস্ত্রীয় কীর্তন’ পরিবেশন করে বাংলার এই অভিজাত গীতধারাটিকে এক উচ্চ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

(ঐতিহাসিকদের মতে, উনি মিঞা তানসেনের গুরু বৃন্দাবনবাসী বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ স্বামী হরিদাসের কাছে গিয়ে শাস্ত্রীয় রাগশিক্ষা করেন আর বৃন্দাবনে জীবন গোস্বামীর আশ্রমে বৈষ্ণবশাস্ত্র অধ্যয়ন করে ঠাকুর উপাধি লাভ করেন। — লেখক)

… বৈষ্ণব মহাজনদের রচিত পদগুলির শীর্ষে নির্দিষ্ট রাগ-তাল অনুসারে পদগুলিকে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে গাইবার রীতিও তিনি প্রচার করেন। ফলে, নতুন রীতির ‘গড়েরহাটি’ শৈলীর কীর্তন অভিজাত সমাজে প্রচলিত হয়। দুঃখের বিষয়, নরোত্তম-সৃষ্ট শাস্ত্রীয় শৈলীর পদাবলী কীর্তন খুব বেশিদিন কীর্তনীয়া সমাজে স্থায়ী হয়নি।

Trinity of Indian Carnatic Classical Music [ ভারতীয় কার্নাটিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ত্রিমূর্তি
Trinity of Indian Carnatic Classical Music [ ভারতীয় কার্নাটিক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ত্রিমূর্তি

তার প্রধান কারণ হল শাস্ত্রীয় রীতির কীর্তন গাইতে গেলে কঠিন সাঙ্গীতিক শিক্ষা ও দীর্ঘ অনুশীলনের প্রয়োজন। (চিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবী ভাল কীর্তন গান করতেন। তিনি তাঁর ‘কীৰ্ত্তন পদাবলী’ নামক পুস্তকের ভূমিকায় লিখছেন, ‘পরবর্তীকালে বৃন্দাবনের সর্বশেষ শ্রীপণ্ডিত বাবাজি এই কীৰ্ত্তন পদ্ধতি রক্ষা করেন।

তাঁর পরলোকগমনের পর এই কীৰ্ত্তন কয়েকজন প্রিয় শিষ্য এবং কীৰ্ত্তনাচার্য নবদ্বীপচন্দ্ৰ ব্রজবাসী কীর্ত্তন রসসাগর মহাশয় এবং শ্রীবৃন্দাবনের অন্যতম কীর্ত্তন সাধক শ্রী গদাধর দাস বাবাজি মহাশয় প্রভৃতি ইহাকে রক্ষা করিয়া আসিতেছেন।’ (এর থেকে অনুমান করছি নরোত্তম দত্ত (দাসঠাকুরের) প্রবর্তিত শাস্ত্রীয় কীর্তন সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যায়নি, অন্তত শ্রীবৃন্দাবনে।— লেখক)

… অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই বিশুদ্ধ অভিজাত কীর্তন কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘ঢপ কীৰ্ত্তন’ নামে একটি বিকৃত শৈলীর গান সৃষ্টি হয়। আবার ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে বেশ কিছু কলাবত্ কয়েকটি অভিজাত পরিবারের দরবারে অবস্থান করে কলকাতায় ধ্রুপদ খেয়াল ইত্যাদি বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় গীতের প্রসার ঘটান। দেখা গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই ওই সকল গানের ছাঁচে (অবশ্য কিছু কাটছাঁট করে) নতুন শৈলীর ধ্রুপদাঙ্গ খেয়ালাঙ্গ বাংলা গান জন্মাতে থাকে।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

এও তো বিশুদ্ধ অভিজাত গানের এক বিকৃত রূপ। …বিকৃত অভিজাত গানের আরেকটা দিক দেখা যাক। আমরা জানি, অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে গ্রামগঞ্জ থেকে খেউড়, তরঞ্জা, পাঁচালি, কথকতা, ঝুমুর গান, কবিগান এসে নগর কলকাতাকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল কয়েক বছরের মধ্যেই এই সকল গ্রাম্যগীত তাদের গ্রাম্য বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে শহুরে বাবুদের মনোরঞ্জন করার জন্য গানের ভাষা ভঙ্গি শৈলীতে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে.. ফলে তৈরি হয়েছিল এক নতুন বিকৃত অভিজাত গান।

এই যে বিকৃতি, একে ঠেকানো মুশকিল। নগরজীবনে বণিক সভ্যতা যতদিন প্রাধান্য পাবে, ততদিন সংস্কৃতির এই বিকৃতি বারে বারে আবির্ভূত হবে।…

ইংরেজরা যখন ক্ষমতায় এল, তখন বাংলার পরিস্থিতি এইরকমই ছিল। ভবিষ্যতে যাতে রাজনৈতিক বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, তার জন্য তারা বাদশাহী জমানার পুরনো জমিদারদের সমূলে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হল। প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে নিলামের মাধ্যমে পাঁচ বছরের জন্য জমি বণ্টন ব্যবস্থা, তারপর লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯০ সালে তাকে বাড়িয়ে দশশালা ব্যবস্থা করেন।

Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]
Indian Classical Music, Hindustani & Carnatic [ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, হিন্দুস্থানি ও কার্নাটিক ]

অবশেষে এই কর্নওয়ালিসই ১৭৯৩ সালের ১০ ফ্রেব্রুয়ারি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ইংরেজবশংবদদের নতুন জমিদার করেন। পুরনো জমিদাররা অত্যাচার করলেও অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও করতেন। কিন্তু এই নতুন জমিদাররা? ১৮৬২ সালে কালীপ্রসন্ন সিংহ (জন্ম ১৮৪০) তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন:

পাঠক! নবাবী আমল শীতকালের সূর্য্যের মত অস্ত গ্যালো। মেঘাত্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছন্ন হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবো মুনসি, ছিরে বেনে ও পুঁটে তেলি রাজা হলো… কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো, তাই দেখে হিন্দুধর্ম্ম, কবির মান, বিদ্যার উৎসাহ, পরোপকার ও নাটকের অভিনয় দেশ থেকে ছুটে পালালো।

হাফ আখড়াই, ফুল আড়াই, পাঁচালি ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্পে। সহরের যুবকদল গোথুরী ঝকমারী ও পক্ষির দলে বিভক্ত হলেন। টাকা বংশগৌরব ছাপিয়ে উঠলেন। রামা মুদ্দফরাস, কেষ্টা বাগ্দী, পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল কলকেতার কায়েত বামুনের মুরুব্বী ও সহরের প্রধান হয়ে উঠলো। এই সময়ে হাফ আড়াই ও ফুল আড়াই সৃষ্টি হয় ও সেই অবধি সহরের বড় মানুষরা হাফ আখড়াইয়ে আমোদ কত্তে লাগলেন।Ustad Alladiya Khan, Founder of Jaipur Atrauli Gharana

শ্যামবাজার রামবাজার চক ও সাঁকোর বড় বড় নিষ্কৰ্ম্মা বাবুরা এক এক হাফ আড়াই দলের মুরুব্বী হলেন। মোসাহেব, উমেদার, পাড়া ও দলস্থ গেরস্তগোছ হাড়হাবাতেরা সৌখীন দোহরের দলে মিশলেন। অনেকের হাফ আড়াইয়ের পুণ্যে চাকরি জুটে গ্যাল। অনেক পুজুরী দাদাঠাকুরের অবস্থা হতে একেবারে আমীর হয়ে পড়লেন—কিছু দিনের মধ্যে তক্মা, বাগান, জুড়ি ও বালাখানা বনে গ্যালো।… (পৃ. ৩২, সাহিত্য পরিষদ সংস্করণ, ১ম সংস্করণ ১৩৪৫)।

বাবুয়ানিতে সেকালে আটজন বাবু বিখ্যাত হয়েছিলেন। হাটখোলা দত্তবাড়ির রামতনু দত্ত, নীলমণি হালদার, গোকুল মিত্তির, শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজকৃষ্ণ দেব, সিমলের ছাতু সিংহ ঠাকুর পরিবারের দর্পনারায়ণ, রাজা সুখময় এবং চোরবাগানের মিত্তিরবাড়ির ছেলে।

Classical singer Ustad Bade Ghulam Ali Khan, Munawar Ali Khan and Noor Jahan
Classical singer Ustad Bade Ghulam Ali Khan, Munawar Ali Khan and Noor Jahan

 

একটা সত্যি কথা বলে নেওয়া ভাল। অভিজাত বাবু সমাজের অধিকাংশই কৃষ্টি অপেক্ষা অপকৃষ্টিকেই প্রশ্রয় দিয়েছিলেন বেশি। দু-চারজনকে বাদ দিলে বেশিরভাগই ‘সংস্কৃতির চর্চা করব’ বলে নাচ গান বাজনার পৃষ্ঠপোষকতা করেননি। ভোগবাসনা চরিতার্থ করার অন্যতম উপকরণ হিসেবে সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে দু-চারজন মোসাহেব গোছের লোক ছাড়া অভিজাত সঙ্গীত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি।

অতএব এই সমাজকে মেকি মধ্যবিত্ত সমাজ বললে খুব একটা ভুল হয় না। আগেই বলেছি, এখানে বিত্তের প্রশ্ন ওঠে না, জীবনযাত্রার প্রণালী, সাংস্কৃতিক স্তর ইত্যাদির দিক দিয়ে বিচার করলে ‘বাবুরা’ সবাই এই ‘ভদ্রলোক’ বা ‘মধ্যবিত্ত সমাজের কোটায় পড়েন। এঁদের হাতে হিন্দুস্থানি বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এসে পড়া অবক্ষয়ের আর একটি ধাপ।

বণিক সভ্যতা ইউরোপে রেনেসাঁসের জন্ম দিয়েছিল, আমাদের বঙ্গে দিল বাবু কালচার। আমার ব্যক্তিগত মত, এ দুর্দশার মূল কারণ ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের থেকে যে সমাজ দূরে সরে যায়, তার মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়। ফল: যাকে আমরা আজকাল বলি অপসংস্কৃতি। শুনেছি এই লাগসই কথাটির উদ্ভাবক এককালীন পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী প্রয়াত যতীন চক্রবর্তী।

পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে [ Pandit Vishnu Narayan Bhatkhande ]
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডে [ Pandit Vishnu Narayan Bhatkhande ]

সেতার বাদক এবং ক্রিটিক সুব্রত রায়চৌধুরী বেশ কিছুকাল পূর্বে ওস্তাদ বিলায়েত্ খাঁর ওপর ‘দেশ’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন, তাতে উনি যতদূর মনে পড়ে কর্নওয়ালিসের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র ফলে বঙ্গে জমিদার শ্রেণীর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পৃষ্ঠপোষকতা ও সঙ্গীতের প্রসারের বিশেষ উল্লেখ করেন।

আমার হিসেবে অবিভক্ত বঙ্গের জমিদারদের মধ্যে ঢাকার নবাব, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদাররা, গৌরীপুরের ব্রজেন্দ্র ও বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বর্ধমানের মহারাজা, নদীয়ার দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় (ইনি আমার প্রথম শুরু ড. রবীন্দ্রলাল রায় এবং পণ্ডিচেরির দিলীপকুমার রায়ের পিতামহ এবং গোয়ালিয়রের প্রবাদপ্রতিম ওস্তাদ হদ্দু খাঁর গাণ্ডাবন্ধ শাগীদ), মহিষাদলের রাজা গর্গ পরিবার ভিন্ন আর কারও নাম উচ্চারণ করা যাচ্ছে না।

টেনেটুনে উল্লেখ করা যায় নাটোর ও রাজশাহীর মৈত্র পরিবার অর্থাৎ রাধিকামোহন মৈত্রর পিতা যিনি প্রতি বছর আষাঢ়ে ক্লাবের তত্ত্বাবধানে একটি কনফারেন্স করতেন এবং সরোদবাদক মহম্মদ আমীর খাঁকে চাকরিতে বহাল করেছিলেন। এঁরাও ওস্তাদ পুষেছিলেন, বিখ্যাত বাঈজিদের মুজরো এঁদের প্রাসাদে হত, এবং এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ওস্তাদের কাছে নাড়া বাঁধিয়ে সঙ্গীতচর্চা করতেন।

সঙ্গীতের প্রসারের জন্য এঁরা কিছু করেছিলেন বলে জানি না, সে কৃতিত্ব অর্জন করেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সর্বোপরি শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর যাঁদের ‘মধ্যবিধ’ সম্প্রদায়ভুক্ত বলা যেতে পারে।

অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশে (তদানীন্তন যুক্তপ্রদেশে) প্রতি ত্রিশ বছর অন্তর জমিদারি নিলামে চড়ত, সেইখানেই প্রধান ঘরানাগুলি জন্ম নেয়, যথা আতরৌলী/জয়পুর, কিরানা, আগ্রা, লখনউ (শুধু ঠুংরী নয় কাওয়াল বাচ্চাদের খেয়াল গায়কি এখান থেকে রপ্তানি হয় গোয়ালিয়রে যেটিকে আমি সব ঘরানার জনক বলে মানি।

দিলীপকুমার রায় [ Dilip Kumar Roy ]
দিলীপকুমার রায় [ Dilip Kumar Roy ]

এ ছাড়াও টপ্পা চালু করেন নবাব আসফউদ্দৌলা ও সুজাউদ্দৌলার সময়ে গুলাম নবী বা শোরি মিঞা) কাশী ও জৌনপুর আর গোয়ালিয়র তো আগ্রার পরের স্টেশন, মাত্র ৭৮ মাইল দূরে। কৃষ্টির প্রসার অত ইংরেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ভৌগোলিক রেখা মেনে চলে না।

এই প্রদেশে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রর মতো প্রতিটি রিয়াসতে বা রাজোয়াড়ায় সঙ্গীতের বিশেষ চর্চা ছিল এবং উস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁ, দরসপিয়া (মেহবুব খাঁ) এবং তাঁর সন্তানসন্ততিরা, উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ এবং তাঁর মাতৃকুল ও পিতৃকুলের খ্যাতনামা উস্তাদবৃন্দ, আবদুল করিম খাঁ, কিরানার জনক বন্দে আলি খাঁ,

রজব আলি ও আমীর খাঁর মানসগুরু আবদুল বহীদ খাঁ ও তাঁর গুরু সারেঙ্গীয়া হায়দর বখ্শ, মেরঠের অন্তর্গত অমবেঠার বাসিন্দা ডাগর কুল, ইটাওয়ার বিখ্যাত সেতারী উস্তাদ ইমদাদ খাঁ, রামপুর দরবারের সহসওয়ান গোষ্ঠীর বাহাদুর হুসেন, এনায়েত হুসেন, মুস্তাক হুসেন এবং তাঁর সেনী ঘরানার গুরু উজীর খা ইত্যাদি ইত্যাদি। এঁরা সবাই উত্তরপ্রদেশের লোক।

অবিভক্ত বঙ্গে জমিদারদের দান সে তুলনায় অত্যল্প, আর উপরোক্ত নামগুলির পাশে বাঙালি গায়কদের নাম করতে লজ্জা হয়, যতই আমরা বাঙালির প্রতিভা নিয়ে ঢাকঢোল পেটাই না কেন।

অবশ্য এর মানে এ নয় যে বঙ্গে বিশেষ করে সে যুগে কলকাতায় উস্তাদ ও সঙ্গীত শাস্ত্রকারদের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের এক বছর আগে লখনউ-এর নবাব ওয়াজিদ আলি শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে ১৮৫৭ সালে তাঁকে ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দী করে রাখা হয়।

A classical Indian music performance, Author - Pablo BD, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 2.0 Generic license.
A classical Indian music performance,

 

বছরখানেক বাদে মেটিয়াবুরুজে ইংরেজরা একটি ছোটখাট প্রাসাদ তৈরি করে দেন নবাবের জন্য এবং যথোপযুক্ত মাসহারা যার থেকে দেড়শজন গাইয়ে, বাজিয়ে এবং কথক নাচিয়েদের ভরণপোষণ করতেন ওয়াজিদ আলি শাহ। তবে আলি বখ্শ খাঁ এবং তাজ খাঁ বাদে আর বিশেষ কোনও উস্তাদদের কাছ থেকে কলকাতার গায়করা তালিম পাননি।

আলি বখ্শ খাঁর কাছে তালিম পান দিল্লি ঘরানার মুজফ্ফর খাঁ ও তাঁর পিতা। এই মুজফ্ফর খাঁ গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর গুরু এবং আলি বখ্শ খাঁর নাতি। ছ’বছর বয়স থেকে মুজফ্ফর খাঁ সাহেবের তালিম হয় পিতামহের কাছে।

ওঁর যখন জ্ঞান হয়, তখন অল্প কয়েকজন বাঙালি আলি বখশের কাছে শিখতে আসতেন, তাঁর মধ্যে একজন ভবানীপুরবাসী অশীতিপর নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি এখনও আসরে ধ্রুপদ ও খেয়াল গাইছেন। তাঁর জ্যাঠামহাশয় বামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আর একজন, নাম তাঁর গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি বাঁ হাতে খেতেন ও তানপুরা ছাড়তেন, ডান হাতে তাঁর কোনও জোর ছিল না। ইনিই বিখ্যাত গায়ক নুলোগোপাল। এই গোপালবাবুর সুপারিশে পাথুরেঘাটার মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর পরম সমাদরে আলি বখ্শ খাঁকে নিজের দরবারে নিয়ে আসেন।

An Indian classical music performance, Karen Blaha from Charlottesville, VA, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 2.0 Generic license.
An Indian classical music performance, Karen Blaha from Charlottesville, VA,

 

মুজফ্ফর খাঁ বলতেন, অঘোর চক্রবর্তী মহারাজার আত্মীয় ছিলেন এবং মহারাজার অনুগ্রহে আলি বখ্শ তাকে ধ্রুপদ ধামারের তালিম দিয়েছিলেন। অনেকে বলে যদু ভাটজিও (ভট্ট নাকি ভুল করে বলা হয়) আলি বখ্শ খাঁর কাছে কিছুদিন তালিম নেন, কিন্তু এর কোনও ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া যায় নি।

কলকাতার যে সমস্ত অভিজাত পরিবার সঙ্গীত চর্চার জন্য নাম কুড়িয়েছিলেন, তাঁদের নাম আবার ড. উৎপলা গোস্বামীর বই থেকে উদ্ধৃত করছি। এঁদের মধ্যে পাথুরেঘাটার ঠাকুর পরিবার অন্যতম। দর্পনারায়ণ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র গোপীমোহনের সময়কাল (১৭৬০-১৮১৮) থেকেই পাথুরেঘাটার ঠাকুর পরিবারে সঙ্গীত চর্চার সূত্রপাত হয়।

এ সময়ে শুধুমাত্র ধ্রুপদেরই প্রচলন ছিল, যদিও ওয়াজিদ আলি শাহর দরবারে আলি বখশ ও তাজ খাঁ ভারি চালের খেয়ালও গাইতেন। প্রখ্যাত বাংলা টপ্পা গায়ক ও রচয়িতা কালিদাস চট্টোপাধ্যায় (কালী মির্জা, এঁর কাছে রাজা রামমোহন রায় তালিম নেন) পাথুরেঘাটার দরবারে কিছুদিন ছিলেন।Music ensemble of benares 1983 hp5 009, Author -Nomo michael hoefner, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.

দর্পনারায়ণ ঠাকুরের নাতি যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরই এই পাথুরেঘাটার বাড়িতে স্থায়ী সঙ্গীত চর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) এই পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ‘প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রাদিতে উল্লিখিত সঙ্গীত সিদ্ধান্তগুলির বিশ্লেষণ শুরু হয় বাংলার রেনেসাঁস যুগে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে।

এ বিষয়ে পথিকৃৎ ছিলেন সঙ্গীতাচার্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী এবং তাঁর পরম্পরা। আজকের দিনে কলকাতা শহরে সঙ্গীত বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার পশ্চাতে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী এবং তাঁর প্রধান শিষ্যদ্বয় শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ও কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরোক্ষ অবদানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। এঁদের লেখা বই বিশেষত কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গীতসূত্রসার’ পড়বার জন্য ভাতখগুেজি বাংলা শেখেন।

দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘ভারতীয় সঙ্গীত গুণী’ নামক বইটিতে বেশ কিছু আধপাকা আধকাচা গল্প পড়ে একদা যে বিরূপ মনোভাবের সঞ্চার হয়েছিল, সেটি ওঁর ‘বাঙালির রাগ সঙ্গীত চর্চা’, পড়ে শুধু যে রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল তাই নয়, অসাধারণ পরিশ্রম করে লেখা এই তথ্যবহুল বইখানি পড়ে আমি প্রকৃতই উপকৃত বোধ করছি।

Pandit Chhannulal Mishra, Source-Wikipedia, Creative Commons Reuse License
Pandit Chhannulal Mishra

 

এই প্রবন্ধে বহু তথ্যের জন্য আমি এই পুস্তকটির ওপর নির্ভর করেছি। ওঁর লেখা পড়ে আমার নিশ্চিত ধারণা হল রেনেসাঁসের যুগে ভারতীয় সঙ্গীতের নতুন করে মূল্যায়ন করার গৌরব অর্জন করার কৃতিত্ব তিন বাঙালি তত্ত্বজ্ঞর– ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী (১৮২৩-১৮৯৩), পাথুরিয়াঘাটার শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) এবং কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৬-১৯০৪)।

কৃষ্ণধন শুধু সঙ্গীতবিদ ছিলেন না, কণ্ঠ এবং যন্ত্রসঙ্গীত দুয়েরই রীতিমত শিক্ষা পেয়েছিলেন একাধিক গুণীর কাছে। ওঁর প্রথম শুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। স্বরলিপি রচনা নিয়ে দুজনের মতানৈক্যের পর উনি শিক্ষা নিতে যান পাথুরিয়াঘাটার ধ্রুপদী ও বীণকার হরপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। ওঁর তৃতীয় ওস্তাদ গোয়ালিয়রের নামকরা সেতারী আহমদ খাঁ।

কৃষ্ণধন সেতার কী প্রকার বাজাতেন তার কোনও নজির পাওয়া যায় না, তবে বাংলাভাষায় সেতারবাদন সম্পর্কে দ্বিতীয় পুস্তক ‘সেতার শিক্ষা’র প্রণেতা কৃষ্ণধন। এ বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর—যন্ত্রক্ষেত্র দীপিকা– সেতার শিক্ষা’। কৃষ্ণধনের অন্যান্য বই মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা ‘বঙ্গৈকতান’, তারপর Hindusthani AirsArranged For the Piano Forte, ‘হারমোনিয়াম শিক্ষা’ ইত্যাদি।

তিনি সম্ভবত প্রথম ভারতীয়, যিনি ভারতীয় সঙ্গীতে ‘হার্মনি’ নিয়ে পরীক্ষামূলক কার্য করেন যার উত্তরসাধক মুর্শিদাবাদের ব্যান্ড মাস্টার হরিমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রুরিবন অর্কেস্ট্রার প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক দক্ষিণাচরণ সেন। পরবর্তীকালে এ নিয়ে অনেক কাজকর্ম করার প্রচেষ্টা হয়েছে।

Tansen mughal, Source- Wikipedia, The work is in public domain now.
তানসেন

 

কৃষ্ণধন প্রথম স্টাফ নোটেশনে অর্থাৎ রৈখিক পদ্ধতিতে হিন্দুস্থানী গানের স্বরলিপি করেন। বলা বাহুল্য, এর বহুল প্রচলন হয়নি। [কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের) জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা দিলীপকুমারের উপরোক্ত পুস্তকে সংবলিত দুখানি চিঠি থেকে কৃষ্ণধনের নিজস্ব মতামত উদ্ধৃত করছি।

বীণাবাদিনী অতি উত্তম হইয়াছে। ইহা দেখিয়া হৰ্ষ ও বিষাদ যুগপৎ উদিত হইয়াছে। সঙ্গীতচর্চ্চা প্রচারিত করার জন্য এইপ্রকার সাময়কি সঙ্গীত পত্রিকা উপযোগী। তাহা আপনি বাহির করিলেন, তাহাতে আমার যেমন হর্ষ, উহাতে আমার অননুমোদিত স্বরলিপি ব্যবহৃত হওয়াতে আমার ততোধিক বিষাদের কারণ হইয়াছে। আমাদের দেশে সঙ্গীত চর্চ্চা কি এতই বাড়িয়া গিয়াছে যে এইপ্রকার পত্রিকা ছাপাইবার খরচ উঠিবে? আমার তো মনে হয় না।

সঙ্গীত চর্চ্চা করে এরূপ লোক অতি কম। আবার ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী কৃত স্বরলিপি, কেহ আমার প্রদর্শিত স্বরলিপি, কেহ আপনার কৃত স্বরলিপি এইরূপ বিভিন্ন লোক বিভিন্ন স্বরলিপি ব্যবহার করাতে, কোনো একপ্রকার স্বরলিপি সম্বলিত পত্রিকা স্থায়ী হওয়ার পক্ষে অনেক ব্যাঘাত বোধ হয়।… তবে কি আমি স্বরলিপি সম্বন্ধে ছেলেখেলা করিয়াছি? … তবে আমার প্রকাশিত স্বরলিপি কেন আপনারা গ্রহণ করিবেন না?

Wazir Khan Sahab of Rampur, Author -Wazir Khan Khandara, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 4.0 International license.
Wazir Khan Sahab of Rampu

 

… ‘গীতসূত্রসারে’ আমার প্রকাশিত বাংলা সার্গম স্বরলিপি অপেক্ষা আপনার প্রণীত স্বরলিপি কি সহজ হইয়াছে? তাহা হয় না(ই]। বরং অনেক বিষয়ে জটিলতর হইয়াছে। আমি ইউরোপীয় সাংকেতিক স্বরলিপির যে বিশেষ পক্ষপাতী হইয়াছি তাহার বিশেষ কারণ আছে। আমি উহা অবলম্বন করিবার পূর্ব্বে সঙ্গীতের কয়েক প্রকার ইতিহাস প্রথমে পড়ি।

তাহাতে জগতে স্বরলিপি প্রণালী সমূহের কিরূপ উত্থানপতন হইয়া শেষে রৈখিক স্বরলিপির কিসে জয়সাধন হইয়াছে তাদের সমুদয় ইতিহাস পরিজ্ঞাত হইয়া ও তখনকার দুই এক সুশিক্ষিত মহৎ মহৎ ব্যক্তির পরামর্শ লইয়া ওই কাজে প্রবৃত্ত হই। তখন আমার rival একজন বিশেষ বড়লোক, অর্থাৎ রাজা শৌরীন্দ্রমোহন। সেই জন্য আমাকে বিশেষ সতর্ক হইতে হইয়াছিল।

আমার চেষ্টাও বেশ সফল হইয়াছে। কারণ, যাঁহারা ইউরোপীয় স্বরলিপি শিখিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই উহার পক্ষপাতী হইয়াছেন। তবে, কোনো বড়লোকের সাহায্যের অভাবে উহা আমার অভিলাষ মত সাধারণে বেশি প্রচলিত হয় নাই। আমাদের মহারাজ আর একরকম লোক। নইলে ভাবনা কি ছিল?

আমি যদি সঙ্গীতের একটি ইস্কুল করিতে পারিতাম, তাহা হইলে ইউরোপীয় স্বরলিপি প্রচারে যথেষ্ট সুবিধা হইত।… আপনি আমার আন্তরিকতার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। আমি এক সময়ে সঙ্গীতে পাগল হইয়াছিলাম। সঙ্গীত চর্চ্চার জন্য উপযুক্ত অবকাশ পাইতাম না বলিয়া আমি বেঙ্গল গভর্নমেন্টের অধীনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদ পরিত্যাগ করিয়াছিলাম, যে পদ এখন লোকে মাথা খুঁড়িয়াও পায় না। আমি সে পদে থাকিলে এখন ৫/৬শ টাকার গ্রেডে উঠিতাম।

আলাউদ্দিন খিলজি [ Alauddin Khalji ]
আলাউদ্দিন খিলজি [ Alauddin Khalji ]

আমার একুল ওকুল দুকুল গিয়াছে।… এসব বিষয়ে ধনুর্ভঙ্গ পণ হওয়াই তো উচিত। ‘Either go the Whole hog or none t নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল, এ কাপুরুষের কথা।

অন্যত্র কৃষ্ণধন বলছেন,

আমাদের সঙ্গীতে হামনি ব্যবহার হওয়া অনেক দূরে, এই কথা আপনি বলিতেছেন, অথচ দেশময় হারমোনিয়াম বাদ্যের mania ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছে। এই যন্ত্রের ব্যবহার যখন বাড়িতেছে তখন হার্মনির প্রচলন হইতে আর কতক্ষণ লাগে? আমি সাহায্য পাইলে পাঁচ বৎসরের মধ্যে হার্মনির প্রতি সাধারণের রুচি প্রবর্তিত করিতে পারি। হিন্দু সঙ্গীতে হামনি খাটিবে না, একথা মনে করিয়া কাজ নাই। হারমোনিয়াম বাদ্যে হিন্দু সঙ্গীতের স্বকীয় রূপ কি রক্ষা পাইতেছে? হিন্দু সঙ্গীতের death knell বাজিয়াছে এবং তাহার অন্তর্ধান বেশি দূরে নয়।

(প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘গীতবিতান বার্ষিকী’ ১৩৫০ মাঘ, প্রথম বর্ষ। ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী প্রকাশিত ‘কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্রাবলী’।) [ এবং প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘গীতবিতান ৫০’-এও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা চিঠি দুটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে।]

কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই লিপিবদ্ধ মতামতের শতাধিক বছর পরেও আমরা হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের death knell শুনছি। আর কোনও স্বরলিপিই, এমনকি ভাতখণ্ডেজির বহুল প্রচলিত স্বরলিপিও আমাদের গানের কঙ্কালটি মাত্র দিতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। বন্দিশ গাওয়ার গায়কির কোনও আন্দাজ দিতে পারে না। স্বৰ্গত আলাউদ্দিন খাঁ

সাহেব এবং পণ্ডিত রবিশঙ্করকে শ্রদ্ধাভরে মনে রেখেই বলছি একশ বছরেও অর্কেস্ট্রেশন এবং হার্মনির প্রচেষ্টা আমাদের সঙ্গীতে কোনও পর্যায়েই উঠতে পারেনি। আমাদের সঙ্গীতের দুটি খুঁটি মীড় ও শ্রুতি। কৃষ্ণধনের স্বরলিপি ও হার্মনি mania আমাদের মার্গ সঙ্গীতের ধর্মবিরুদ্ধ।

Babanrao Haldankar, Raspiya, 1927–2016, Exponent of Agra Gharana
Babanrao Haldankar, Raspiya, 1927–2016, Exponent of Agra Gharana

 

লক্ষণীয় বিষয়, বিষ্ণু দিগম্বর এবং বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডের মতই তাঁদের বহু পূর্বে শৌরীন্দ্রমোহন ও কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় চেয়েছিলেন, তাঁদের পুস্তক মারফত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত আর ধনী পৃষ্ঠপোষকের প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ না থেকে সাধারণ মধ্যবিত্ত সমাজে ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক। ‘গীতসূত্রসারে’র দ্বিতীয় ভাগের ভূমিকায় কৃষ্ণধন বলেছেন, ‘এই পুস্তক সাধারণকে সঙ্গীতবিদ্যার প্রতি সমাদর করিতে শিক্ষা দিবে এবং সঙ্গীত শিক্ষাতে আস্থাবান করিবে।’

এই বইটিতে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে গ্রাম, লয়, ছন্দ, তাল, রাগের পরিচয়, রাগ রাগিণীর কাল ও সময়, শ্রুতি, স্বর, সঙ্গীতের উৎপত্তি, স্বরসাধন, কড়ি ও কোমল স্বর, অলঙ্কার, আলাপ ও গানের রীতি। এ ছাড়া আছে বহু ধ্রুপদ খেয়াল ও টপ্পা গানের স্বরলিপি, তবে তা রৈখিক পদ্ধতিতে নয়।

একটা মজার খবর দিয়ে কৃষ্ণধন প্রসঙ্গ শেষ করি। এও দিলীপবাবুর বই থেকে জেনেছি। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেওয়ার তিন বছর আগে অর্থাৎ তের বছর বয়সে পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়া থিয়েটারে ফিমেল পার্টে গান ও অপূর্ব অভিনয় করে কৃষ্ণধন ওই নাট্যশালার সঙ্গীতাচার্য ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর স্নেহধন্য হন এবং শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এর জন্য দায়ী বিখ্যাত কুস্তিগীর গোবর গুহর ঠাকুরদাদা মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের অম্বুবাবু যাঁর আখড়ায় কৃষ্ণধন ব্যায়াম করতে যেতেন।

ওই ধনী গুহ পরিবারের সুপারিশ ছাড়া কিশোর কৃষ্ণধনের জন্য ওই অভিজাত শৌখিন থিয়েটারের দরজা কখনই খুলত না। মাইকেল মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটকে হিরোইন কৃষ্ণধনের অভিনয় সম্পর্কে নাট্যকার স্বয়ং অভিভূত হয়ে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখেন :

Khadim Hussain Khan, Sajan Piya, 1907–1993, Exponent of Agra Gharana
Khadim Hussain Khan, Sajan Piya, 1907–1993, Exponent of Agra Gharana

 

When Sharmishtha acted at Belgachia the impression created was simply indescridable. Even the least romantic spectator was charmed by the character of sharmishtha and shed tears with her. As for my own feelings they were things to dream of, not to tell.

বঙ্গে নবজাগরণের যুগে তিন সঙ্গীতজ্ঞের গবেষকদের মধ্যে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে পথিকৃৎ বলা যায়। সঙ্গীত সম্পর্কে গবেষণা ও systematise বা প্রণালীবদ্ধ করার প্রচেষ্টা তাঁরই প্রথম যদিও ক্ষেত্রমোহনের ‘সঙ্গীতসার’ গ্রন্থ প্রকাশের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভারতীয় সঙ্গীততত্ত্ব বিষয়ে রাধামোহন সেন ‘সঙ্গীত তরঙ্গ’ লেখেন তবে এটিকে মৌলিক রচনা বলে অমিয়নাথ সান্যাল তাঁর লেখায় স্বীকৃতি দেননি।

কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গীতসূত্রসার’, ক্ষেত্রমোহনের ‘সঙ্গীতসারে’র দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং তার ষোল বছরে পরে প্রকাশিত হয়।

ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানায় রাগরূপ সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত, রাগের চলন, স্বরসমূহ জাতি ও রূপ সম্পর্কে প্রচণ্ড মতাত্তর থাকার দরুন কয়েকজন সঙ্গীতজ্ঞের মধ্যে প্রণালীবদ্ধ করার প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য। এঁদের মধ্যে পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডের নামই সবাই জানেন। তিনি ১৯২০ সালে (১৯১৬৭] বরোদায় এবং ১৯২৪-২৫ সালে লখনউয় তৎকালীন বিখ্যাত ধ্রুপদী খেয়ালিয়া এবং যন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেন।

এর নজির আমার প্রণীত ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী’র পরিশিষ্টয় পাওয়া যাবে। কিন্তু এই ব্যাপারে পথপ্রদর্শক ক্ষেত্রমোহন, যিনি সঙ্গীতগুরু লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্রর উদ্যোগে যতীন্দ্রমোহন এবং শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের অর্থসাহায্যে ভাতখগুেজির উপরোক্ত প্রচেষ্টার ৫৩ বছর আগে, ১৮৬৭ সালে কলকাতায় এক বিরাট সঙ্গীত সম্মেলন বা কনফারেন্সের আয়োজন করেন এবং বহু গুণীর তর্কালোচনা এবং মতামতের ফলে বিভিন্ন রাগের যে চেহারা সর্বানুমতিক্রমে স্থির হয়, সেগুলি এই ‘সঙ্গীতসার’ গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট করেন ক্ষেত্রমোহন।

Pt. Yashpaul, Sagun Piya, b. 1937, Exponent of Agra Gharana
Pt. Yashpaul, Sagun Piya, b. 1937, Exponent of Agra Gharana

 

কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রিত স্বরলিপিগ্রন্থ ‘বঙ্গৈকতান’ ১৮৬৭ সালে বের হয়। তার এক বছর পরে ক্ষেত্রমোহনের ‘ঐকতানিক স্বরলিপি’। তবে এই নিয়ে কাজ শুরু করেন উনি প্রায় দশ বছর আগে এবং ওঁরই স্বরলিপি বেলগাছিয়া থিয়েটারের অর্কেস্ট্রা পার্টি বা কনসার্ট পার্টি সামনে রেখে বাজাতেন। এই অর্কেস্ট্রা পার্টির সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদনের বাল্যবন্ধু গৌরদাস বসাকের স্মৃতিকথায় উল্লেখ আছে।

অতএব ভারতবর্ষে প্রথম স্বরলিপিকারের গৌরব ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীরই প্রাপ্য। ওঁর প্রচলিত স্বরলিপি ছিল দণ্ডমাত্রিক আর কৃষ্ণধনের ইউরোপীয় রেখামাত্রার বা স্টাফ নোটেশন সিস্টেম। ক্ষেত্রমোহনের সাক্ষাৎ শিষ্যদ্বয় কৃষ্ণধন ও শৌরীন্দ্রমোহন। কৃষ্ণধন ক্ষেত্রমোহনের স্বরলিপির বিরুদ্ধতা করেন। শৌরীন্দ্রমোহন শুরুর পদ্ধতির অনুবর্তী ছিলেন।

বাংলা, হিন্দি ও সংস্কৃতয় অনেক ধ্রুপদ ক্ষেত্রমোহন রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে বাংলার বিখ্যাত ধ্রুপদীয়া রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী ওঁর রচিত যে গানগুলি গেয়ে আসর জয় করেছিলেন, তার মধ্যে একটি ঝিঝিট রাগে চৌতালে রচনা দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করছি। এটির প্রথম দুটি তুক আমি আমার পিতার কাছেও বাল্যবয়সে শুনেছি।

তেরো রি নয়নবাণ ভোঁ হৈ ধনুষ

চন্দ্রবদন পর ঝলকত মোহত মন

অরুণ বরুণ অধর দত্তকুন্দন বাহার দেত, সো হৈ ঐসী বেণী সির পর নাগ কৌ ফণ।।

শ্রবণ কুণ্ডল, নাশ বেসর, কণ্ঠমাল ভুজ মৃণাল, কুচ উত্তুঙ্গ, নাভি ভ্রমর, পহিরে নীল সারী।।

কটি কিঙ্কিণী [য] কদলী খৌম্ব জৌব, চরণ কনক নূপুর চলত চাল গতি মরাল যোবন ভরী।।

ক্ষেত্রমোহনের গুরু বিষ্ণুপুরের রামশঙ্কর ভট্টাচার্য হিন্দিতে একাধিক ধ্রুপদ রচনা করেন। ওঁর যোগ্য শিষ্য ওঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বহু রচনা স্বরলিপিবদ্ধ করে গেছেন। ক্ষেত্রমোহনের অপর এক গুরু কাশীর নামকরা বীণকার লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্র যিনি পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির সভাগায়ক ছিলেন।

লক্ষ্মীপ্রসাদের এবং তাঁর দুই ভাই সারদাসহায় এবং গোপালপ্রসাদের কাছে বাঙালিরা বিশষভাবে ঋণী। সারদা মিশ্র ছিলেন যাদুমণির গুরু। গোপালপ্রসাদের শিষ্য গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী বা নুলোগোপাল যিনি মহিষাদলের দেবপ্রসাদ গর্গর কাছে শুনেছি, মেটিয়াবুরুজে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর দরবারের ওস্তাদ আলি বখ্শের কাছে তালিম পেয়েছিলেন, তিনি লক্ষ্মীপ্রসাদের ভাই গোপালপ্রসাদেরও শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

বেঙ্গল রেনেসাঁসের তৃতীয় সঙ্গীতত্ত্ব

ওস্তাদ আমানত আলী খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Ustad Amanat Ali Khan, Patiala Gharana ]
ওস্তাদ আমানত আলী খান, পাতিয়ালা ঘরানা [ Ustad Amanat Ali Khan, Patiala Gharana ]

জ্ঞ — শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। এঁর রাজা খেতাব থেকে অনেকে অনুমান করবেন ইনি: পুরুষানুক্রমে জমিদার ঘরের মানুষ। বস্তুত ঠাকুরবাড়ির অন্য শাখার মত এঁর পিতৃপুরুষও ব্যবসায় সূত্রে ধনী।

এঁর বিত্তের পরিমাণ বিপুল হওয়া সত্ত্বেও এঁকে মধ্যবিত্ত সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, কারণ দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা ও চর্চা এবং সঙ্গীতকে সাধারণের মধ্যে প্রচার করার প্রচেষ্টা এঁকে সেই যুগের সমাজের অন্যান্য প্রতিভাবান ব্যক্তিদের সমগ্রোত্রীয় হতে সাহায্য করেছিল।

বাংলার নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য প্রতিভা ও ইনটেলেক্টের সমন্বয়। নিছক বুদ্ধিজীবী ও পণ্ডিতের অভাব তার পূর্বে নবদ্বীপ ও ভট্টপল্লীতে ছিল না, কিন্তু প্রতিভাবান ব্যক্তির মনন চিত্তন করার প্রবণতা এই যুগের বৈশিষ্ট্য যার জন্য অবশ্যই ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শ প্রধানত দায়ী। এছাড়া এঁরা সকলেই মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে নিজেদের রচনা, বক্তব্য এবং অভিজ্ঞতা পৌঁছে দিতে উৎসুক ছিলেন বিভিন্ন মাধ্যমে। সঙ্গীতেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে বিষ্ণু দিগম্বর ও বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডের বহু পূর্বে।

এই বাংলায়। শুধু স্বরলিপি নয়, বিদ্যালয়ে সঙ্গীতশিক্ষা দানের প্রচেষ্টার সূত্রপাতও এই সময়ে হয়, যার জন্য প্রাথমিক গ্রন্থাদির রচনাও শৌরীন্দ্রমোহন করেন। আমার মতে, এটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবক্ষয়ের তৃতীয় ধাপের সূত্রপাত। এ বিষয়ে আলোচনা ভাতখণ্ডে প্রসঙ্গে পরে করব।

শৌরীন্দ্রমোহনের সঙ্গীতশিক্ষার শুরু ১৭ বছর বয়সে। তাঁর প্রধান গুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। দ্বিতীয় গুরু পূর্বোক্ত কাশীর গুণী লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্র। তৃতীয় শিক্ষক স্বনামধন্য সেতার ও সুরবাহার বাজিয়ে সাজ্জাদ মহম্মদ, যাঁর পিতা গোলাম মহম্মদকে সুরবাহার যন্ত্রের আবিষ্কারক ও প্রবর্তক বলে ধরা হয়। অনেকের মতে, বিলায়েত খাঁর পিতামহ ওস্তাদ ইমদাদ খাও এই ঘরের শাগীর্দ হয়েছিলেন। অবশ্য এ তথ্য ইমদাদ খাঁর পুত্র পৌত্ররা মানেন না।

গোলাম ও সাজ্জাদ মহম্মদ সেনী ঘরানার ওস্তাদ ওমরাও খার শিষ্য। সাজ্জাদ মহম্মদ দীর্ঘকাল শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের দরবারে ছিলেন। এই দরবারে অন্য যে সব গুণী স্থান পেয়েছিলেন বিভিন্ন সময়ে তাঁদের নাম কাশীর ধ্রুপদী জোয়ালাপ্রসাদ ও কাতাপ্রসাদ, ধ্রুপদী মুরাদ আলি, বেতিয়া ঘরানার দুই ভাই শিবনারায়ণ

ও গুরুপ্রসাদ মিশ্র, মেটিয়াবুরুজের ওয়াজিদ আলি শাহর দরবারের আলি বখ্শ, তানসেনের পুত্রবংশের রবারী ওস্তাদ বাসৎ খাঁ, লখনউর নামী খেয়ালিয়া আহম্মদ খাঁ যিনি পরে ঢাকার নবাবের আশ্রয়ে চলে যান, আবদুল্লা খাঁ এবং সরোদ বাজিয়ে কৌকব খাঁ, বাঙালিদের মধ্যে নুলোগোপাল, যদু ভট্ট, মৃদঙ্গী কেশবচন্দ্র মিত্র এবং অবশ্যই রাজগুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী।

সঙ্গীত সম্পর্কে শৌরীন্দ্রমোহনের পুস্তকাদির নিম্নলিখিত তালিকা থেকে তাঁর প্রতিভা, পরিশ্রম ও সঙ্গীতশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কিঞ্চিৎ আন্দাজ পাওয়া যাবে।

১. জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৭০) কয়েকটি ধ্রুপদের স্বরলিপি ও ভারতীয় এবং ইউরোপীয় সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা।

২. যন্ত্রক্ষেত্র দীপিকা, সেতার শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ (১৮৭২) – এতে ৯৪টি গং-এর স্বরলিপি (এর মধ্যে ৭২টি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর রচনা) ছাড়া সেতার সাধনার বিভিন্ন প্রণালীর বর্ণনা আছে।

৩. মৃদঙ্গ মঞ্জরী (১৮৭৩) – বিভিন্ন তাল ও বোলের লিপি।

৪. হারমোনিয়াম সূত্র (১৮৭৪)।

৫. যন্ত্রকোষ (১৮৭৫) দেশ-বিদেশের বাদ্যযন্ত্রের পরিচয়।

৬. ভিক্টোরিয়া গীতিমালা (১৮৭৭) ব্রিটিশ রাজা-রানীদের উদ্দেশে স্বরচিত বাংলা

গানের স্বরলিপি। বলা বাহুল্য, এটি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত K.C.S.I খেতাব পেতে সাহায্য করে।

৭. গীতপ্রবেশ (১৮৮২) – জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে অ্যান্ডারসন সাহেবের অনুরোধে বাংলাদেশের বিদ্যালয়গুলিতে সঙ্গীতশিক্ষা দানের জন্য রচিত প্রাথমিক গ্রন্থ।

৮. সঙ্গীতশাস্ত্র প্রকাশিকা।

৯. নৃত্যাঙ্কুর (১৮৮৫)। সে যুগের সমাজে নাচগান, বিশেষত নৃত্য সম্পর্কে আলোচনা, বিরাট সাহসের পরিচয়।

So. English Verses set to Hindu music-In honour of His Highness, the Prince of Wales– (১৮৭৫) ইংরেজি ভাষায় রচিত গানের স্বরলিপি। রাগ ভূপালী, পরজ, বসন্ত, সাহানা, যোগীয়া, আল্হাইয়া বিলাবল, হিন্দোল, ললিত, সারঙ্গ, বেহাগ ইত্যাদি।

11. Six principle ragas-with a brief view of Hindu music

(১৮৭৬)–ইংরেজি স্বরলিপিতে ভৈরব পঞ্চম বসন্ত শ্রী মেঘ ও নট নারায়ণ রাগের

রচনা ও পরিচয়।

১২. Short notices of the Hindu Musical Instruments (১৮৭৭)। 13. A few lyrics of Owen Meredith set to Hindu Music (১৮৭৭)।

18. A Vedic Hymn (১৮৭৮)—তিনটি বেদগানের স্বরলিপি কুকুভ, খম্বাবতী ও সৌরভী রাগে।

15. Fifty Tunes (১৮৭৮)।

16. A few specimens of Indian Songs (১৮৭৯)।

17. Indian Music Address to Lord Lytton (১৮৮০)।

18. Eight Tunes (১৮৮০)।

19. Hindu music from Various Authors (১৮৮২)।

20. Musical Scales of the Hindus (১৮৮৪)।.

21. Twenty two musical snetis [sic] of the Hindus (১৮৮৬)।

22. Seven principal musical Notes of the Hindus (১৮৯২)।

23. Indian Ragmala (১৮৯৪)।

28. Universal History of Music together with Varios Original Notes on Hindu Music—এটিকে শৌরীন্দ্রমোহনের Magnum Opus অ্যাখ্যা দিয়েছেন সঙ্গীত জগতের স্কলাররা। এতে হিন্দু-মুসলমান ও ব্রিটিশ আমলের সঙ্গীতের কথা ছাড়া ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গান ও নেপালি সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা আছে। আর আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংক্ষিপ্ত সাঙ্গীতিক ইতিহাস। এটি ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়।

উদয়শঙ্কর, রবিশঙ্কর, আলি আকবর প্রমুখের অর্ধশতাব্দীরও পূর্বে ভারতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পুস্তক ও স্বরলিপির মাধ্যমে ইউরোপ ও আমেরিকার সঙ্গীত গুণীদের প্রথম পরিচয় ঘটে শৌরীন্দ্রমোহনের অনলস প্রচেষ্টায়। এই সঙ্গে লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ মিউজিককে প্রচুর অর্থদান এবং ব্রিটিশ রাজপরিবার ও বড় লাটসাহেবদের তৈলমর্দন তো ছিলই।

ফলে ওঁর K.C.S.I ও রাজা খেতাব ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ওঁকে ডক্টর অফ মিউজিক উপাধি দেন, সেই সঙ্গে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও। আন্তর্জাতিক খ্যাতি তাঁর এমনই হয় যে, রোমের পোপ লিও দা থার্টিল্থ ওঁকে আমন্ত্রণ করেন। বিদেশি সঙ্গীত সম্পর্কে ঔৎসুক্য ও ঔদার্য থাকলেও কালাপানি পার হওয়ার ব্যাপারে উনি প্রাচীনপন্থী ছিলেন। সেজন্য বিদেশযাত্রা উনি কখনও করেননি।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে সঙ্গীতের গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে পুরোভাগে ছিলেন উপরোক্ত তিন বাঙালি। এঁরা তিনজন প্রায় একই সময়ে গ্রন্থ রচনা আরম্ভ করেন এবং স্বরলিপি প্রণয়ন ও প্রচারের ক্ষেত্রেও এই তিনজনের নাম সর্বাগ্রে। এ প্রসঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও স্মরণ করতে হবে। রবীন্দ্রনাথের এই ঋষিতুল্য বড়দাদাটি যে অনেক বিষয়েই অসাধারণত্বর নজির রেখে গেছেন, তা সৈয়দ মুজতবা আলির লেখায় পাওয়া যাবে।

যা উনি উল্লেখ করেননি, তা হল – শৌরীন্দ্রমোহনের কিছু পূর্বে উনি স্বরলিপি রচনা করেন। দ্বিজেন্দ্রনাথের নিজের ধারণা ছিল যে, এ বিষয়ে উনিই প্রথম। ওঁর স্মৃতিকথায় উনি বলেছেন— ‘বাংলায় প্রথম স্বরলিপি যে আমার রচিত তাহা একেবারে নিঃসঙ্গেই। শৌরীন্দ্রমোহন তাহার পরে তাড়াতাড়ি একটা স্বরলিপি প্রস্তুত করিয়া ছাপাইয়া দিল।

দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, ক্ষেত্রমোহনের ১৮৫৮ সালের স্বরলিপি রচনার তথ্য দ্বিজেন্দ্রনাথের অজ্ঞাত ছিল। নচেৎ দ্বিজেন্দ্রনাথের মত ঋষিতুল। ব্যক্তি এ প্রকার মন্তব্য করতেন না।

দ্বিজেন্দ্রনাথকে ঋষিতুল্য না বলে ঋষি বলাই উচিত। সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর ‘বড়বাবু’ গ্রন্থে লিখেছেন,

‘ধীরে ধীরে তিনি সাহিত্য কাব্য সঙ্গীত শব্দতত্ত্ব, ইতিহাসের দর্শন (philosophy of history) সব জিনিস থেকে বিদায় নিয়ে ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান ও তাঁর অনুশীলনে নিযুক্ত হলেন। এ যে কী অভ্রভেদী দুর্জয় সাধনা, তার বর্ণনা দেওয়ার শাস্ত্রাধিকার আমার নেই।

একদিকে ইউরোপীয় দর্শন তাঁর নখাগ্রদর্পণে ছিল, অন্যদিকে বেদাত্ত সাংখ্য এবং যোগ—উপনিষদ, গীতা এবং মহাভারতের তত্ত্বাংশ। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান শুধু স্পেকুলেট তথা তর্কবিতর্ক করতে শেখায় না। গোড়া থেকেই ধ্যানধারণা সাধনা করতে হয়। ভারতীয় তত্ত্বজ্ঞান মেন্টাল জিমনাস্টিক নয়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ শাস্ত্রচর্চার সঙ্গে সঙ্গে ধ্যানধারণায় মগ্ন হলেন। এখনও বাংলাদেশে বিস্তর না হোক, বেশ কিছু লোক বেঁচে আছেন যাঁরা তাঁর সে ধ্যানমূর্তি দিনের পর দিন দেখেছেন। সূর্যোদয়ের বহু পূর্বেই তিনি আগের দিনের বাসি জলে স্নান করে ধ্যানে বসতেন। সে সময়ে ছোট ছোট পাখি, কাঠবেড়ালি তাঁর গায়ের ওপর বসত, ওঠানামা করত।

অন্যদিকে ছিলেন তিনি শিশু ভোলানাথ। ‘একবার এক ভিখিরি এসে তাঁর কাছে ভিক্ষা চাইলে তিনি বলেন, “আমার কাছে তো কিছু নেই, তুমি আমার এই শালখানা নিয়ে যাও।” দামি কাশ্মীরি শাল, হয়ত তাঁর ঠাকুরদাদা প্রিন্স দ্বারকানাথের আমলের। ভিখিরি প্রথমটায় নাকি নিতে চায়নি।

শেষটায় যখন বড়বাবুর চাকর দেখে বাবুর উরুর ওপর শালখানা নেই, সে নাতি দিনু ঠাকুরকে (রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারী) খবর দেয়। তিনি বোলপুরে লোক পাঠিয়ে শালখানা কিনিয়ে ফেরত আনান। কথিত আছে, পরের দিন যখন সেই শালই তাঁর উরুর ওপর রাখা হল, তখন তিনি সেটি লক্ষ্যই করলেন না যে, এটা আবার এল কী করে!’

একবার বাম্পার গ্রুপ হয়েছিল। বড় ছেলেকে মহর্ষি খাজনা আদায় করতে জমিদারিতে পাঠান। গ্রামের অবস্থা দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের চিন্তা মাথায় ঢুকল। পিতাকে তার করেছিলেন ‘সেনড্ ফিফটি থাউজ্যান্ড।’ উত্তর গেল ‘কাম ব্যাক’।

এপর ভাইয়েদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বড় হলে তাঁকেই জমিদারি দেখাশোনার ভার দেন মহর্ষি।

যে বঙ্গে ধ্রুপদের প্রচণ্ড বোলবোলাও ছিল এবং এই কলকাতাতেই বিষ্ণুপুর ও বেতিয়া ঘরানার মিলন ঘটে, তা আজ অনেক সঙ্গীতপ্রেমীর পক্ষেই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না এমনই হাল হয়েছে ধ্রুপদ ধামারের। অতএব সংক্ষেপে এ সম্পর্কে দু-চার কথা বলা প্রয়োজন।

এমনই এক সময় গিয়েছে যখন গোয়ালিয়রের প্রবাদপ্রতিম ওস্তাদ হদ্দু খাঁ কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর খেয়ালের আসরে। এক এক করে শ্রোতারা উঠে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু-একজন মুসলমান ওস্তাদও ছিলেন। আসরের শেষে স্তম্ভিত হন্দু খাঁ মাথা

হেঁট করে বসে। খোঁজখবর নিয়ে বুঝলেন, কলকাতা শহরে তখন মেটেবুরুজের নবার ওয়াজিদ আলি শাহর দরবারি গায়ক তাজ খাঁ ও আলি বখ্শ খাঁ ভিন্ন আর খেয়াল গায়ক ছিলেন না, খেয়ালের প্রচলনও হয়নি। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর মানেই ধ্রুপদ ও টপ্পার আসর। কীভাবে ওস্তাদ হদ্দু খাঁ কলকাতার কসবীদের চিত্তজয় করেন, খেয়ালের মুড়কী, খনক, তানকর্তব বাদ দিয়ে সে গল্প ‘কুরত্ রঙ্গিবিরঙ্গী ‘তে পাওয়া যাবে।

বঙ্গদেশে ধ্রুপদের ধারা মোটামুটি তিনটে। প্রথমেই আসে বিষ্ণুপুর ঘরানা, যার ওপর গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র রমেশবাবু তাঁর পিতার উপদেশে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ লিখেছেন। যে সময় রাজা রামমোহন রায়ের গুরু কালী মির্জা পশ্চিম থেকে সঙ্গীতশিক্ষা করে গুপ্তিপাড়ায় প্রত্যাবর্তন করেন, সেই একই সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীর আশির দশকে বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদের প্রচলনের সূত্রপাত হয়। ড. বিমল রায়ের মতে, মথুরার ।

হাভেলি-সঙ্গীত থেকেই এই ঘরানার জন্ম। হাভেলি-সঙ্গীত বা কীর্তনের বিষয় ছিল কৃষ্ণের বাললীলা এবং এখনও মথুরা, বৃন্দাবনে এ গান নানা রাগে চৌতাল, আড়াচৌতাল, ধামার এবং ঝাপতালে গাওয়া হয়। প্রধান গায়কের সঙ্গে ধুয়ো ধরবার লোক থাকে। রেলপথ হওয়ার আগে এঁরা পুরীতে তীর্থ করতে যেতেন বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর হয়ে।

রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তানসেনের ছেলের বংশের বাহাদুর সেন বিষ্ণুপুররাজ রঘুনাথ সিংহের দরবারে নিযুক্ত হয়ে গায়ক গদাধর চক্রবর্তীকে তালিম দেন। বিষ্ণুপুর ঘরানার সবচেয়ে বিখ্যাত গায়ক রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের (১৭৬১-১৮৫৩) এক শিষ্য অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় ছেলে রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ধ্রুপদ সঙ্কলন গ্রন্থ ‘সঙ্গীত মঞ্জরী’তে দ্বিতীয় রঘুনাথের রাজসভায় ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ-র অবস্থানের কথার উল্লেখ করেন।

রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপরোক্ত ঐতিহাসিক তথ্যের সমর্থন করেছেন। কিন্তু দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের আরেকটি বই ‘বিষ্ণুপুর ঘরানাতে প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য ও নথিপত্র দিয়ে প্রমাণ করেন যে, বিষ্ণুপুরের রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ ও তানসেনের ছেলের বংশের জীবন খাঁর পুত্র বাহাদুর খাঁ আদৌ সমসময়িক নন। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথকে হত্যা করান তাঁরই পত্নী, ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে।

ধ্রুপদী বাহাদুর খাঁ-র পিতামহ গুলাব খাঁ বিখ্যাত সদারঙ্গের (নিয়ামত খাঁ) সমবয়সী ও পরম বন্ধু ছিলেন। অতএব দিল্লির বাদশা মহম্মদ শাহ রঙ্গিলের (১৭১৯-১৭৪৮) সভাগায়ক গুলাব খাঁর নাতি বাহাদুর খাঁ কোনক্রমেই রঘুনাথ সিংহের দরবারে থাকতে পারেন না। কারণ রঘুনাথ সিংহের মৃত্যু হয় ১৭১২ সালে।

উপরন্তু দিলীপবাবুর মতে, বিষ্ণুপুরের শ্রুতি স্মৃতিতে গদাধর চক্রবর্তীর নাম সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এবং তাঁর কোনও শিষ্যদের নাম পাওয়া যায় না।

পরিশেষে দিলীপবাবুর বক্তব্য যদি তর্কের খাতিরে ধরাও হয় যে, বাহাদুর খাঁ রাজা রঘুনাথের দরবারে ছিলেন, তাহলে তাঁর পক্ষে গদাধর চক্রবর্তী বা তাঁর শিষ্য রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে তালিম দেওয়া অসম্ভব। কারণ শেষোক্ত দুজনেরই জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে। রামশঙ্করের সঙ্গীত জীবনের আরড ১৭৮০-র দশকে এবং ১২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৫৩ সালে।

গদাধর চক্রবর্তী বা অন্য কোনও বিখ্যাত গায়কের রামশঙ্করের পূর্বে কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। এছাড়া গায়কির দিক দিয়ে দেখতে গেলে সেনীয়া ঘরানার সঙ্গে বিষ্ণুপুরের প্রচুর গরমিল। সেনীয়া ধ্রুপদের তুলনায় বিষ্ণুপুরী ধ্রুপদ অনেক সরল ও নিরাভরণ ছিল। অলঙ্কারের বাহুল্য বা গমকের প্রাবল্য একেবারেই ছিল না, বোলবাটের অতিশয্যও নয়— এ সবই সম্ভবত হাভেলি-সঙ্গীতের প্রভাব।

রাগ রূপায়ণেও অনেক পার্থক্য লক্ষণীয়, যেমন, বসন্তে ও পূর্বীতে শুদ্ধ ধৈবত, ভৈরবে কোমল নিখাদের ছোঁয়া ও বেহাগে গ ম প ধ নি স ফ্রেজ-এর ব্যবহার। এ আমরা জ্ঞান গোঁসাইয়ের ‘আমারে বোলো না ভুলিতে বোলো না’ রেকর্ডেও পাই। যদিও উনি বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়ার মানুষ হয়েও কাকা রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর মারফত বেতিয়ার তালিম পেয়েছিলেন। ধূর্জটিপ্রসাদের কথায় সে তালিম নাকি নেহাতই আধাখেঁচড়া।

দিলীপবাবুর বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন প্রয়াত সঙ্গীতজ্ঞ সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। তিনিও মনে করেন বৃন্দাবন, মথুরা, রাজস্থানের নাথদ্বারা, এবং গুজরাটের বিভিন্ন মন্দিরে ভজন হিসেবে ধ্রুপদ গানের প্রচলন আছে, যাকে হাভেলি-সঙ্গীত বলে। হাভেলি-সঙ্গীত সব বিষয়েই ধ্রুপদ, তবে তাতে আলাপ বা বিস্তার নেই, বোলবাট ও লয়কারীরও স্থান নেই বললেই চলে। অতএব রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের গুরু যে মথুরার হিন্দু বৈষ্ণব ছিলেন, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অসুবিধা হয় না।

রামশঙ্করের বিখ্যাত শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে পড়েন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। এই ঘরানার শেষ প্রতিভূ ছিলেন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সন্তানদের মুখে ধ্রুপদের পরিবর্তে খেয়ালই শোনা যায়। অতএব বর্তমান যুগে বিষ্ণুপুর শৈলীর জন্ম নিয়ে জল্পনা-কল্পনা অবান্তর।

এরপর আসে বেতিয়া ঘরানা। এই ঘরানা প্রথম পরিচিতি লাভ করে ১৮২০-২৫ সাল থেকে, অর্থাৎ সিপাহী বিদ্রোহের বেশ কিছুকাল আগে। বেতিয়া বর্তমান বিহারে উত্তরে চম্পারণ জেলার (প্রাচীন নাম চম্পকারণ্য অনেক বেশি রোম্যান্টিক) একটি মহকুমা। এখানকার রাজা আনন্দকিশোর একাধারে খুব বড় ধ্রুপদ গায়ক আর রচয়িতা ছিলেন। এঁর গুরু, শোনা যায়, তানসেনের ছেলের বংশের উস্তাদ হায়দার খাঁ, উপরোক্ত বাদশা মহম্মদ শাহ্ রঙ্গিলের সভাগায়ক গুলাব খাঁর নাতি।

সে অর্থে বেতিয়া ঘরানাও সেনীয়ার শাখাপ্রশাখা। আনন্দকিশোরের অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যু হলে ছোট ভাই নবলকিশোর রাজা হন। ইনিও অসাধারণ গায়ক, রচয়িতা ও গাইয়ে-বাজিয়েদের বিরাট পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মতান্তরে, জাফর খাঁ ও ছেলে প্যার খাঁর কাছে এই দুই রাজা তালিম পান।

এ ছাড়া কাল্পি ঘরানার ধ্রুপদীয়া কালে খাঁ এবং শাজাহানপুরের সরোদি হাসান আলি এই দরবারে ছিলেন। এই হাসান আলি পরবর্তীকালের বিখ্যাত সরোদবাজিয়ে ফিদা হুসেনের বাবা। এঁদের ঘরের শিষ্য পর্যায়ক্রমে বখতাওয়ারজি, সদাশিব রাও, শিবনারায়ণ মিশ্র ও গুরুপ্রসাদ মিশ্র। সদাশিব রাওয়ের নাম করা ধামারি শিষ্য বিশ্বনাথ রাও। তাঁর চেলাদের মধ্যে খ্যাত লালচাঁদ বড়াল, ধ্রুপদী বিনোদ মল্লিক

(ইনি পাখোয়াজি গোপাল মল্লিকের ছোট ছেলে, নুলোগোপালের সঙ্গে এঁর কোন সম্পর্ক নেই)। এ ছাড়াও তালিম পেয়েছিলেন অমর ভট্টাচার্য ও মানদাসুন্দরী। গুরুপ্রসাদ মিশ্রর প্রধান শিষ্য রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, যিনি বাল্যকালে বিষ্ণুপুরে যদু ভট্টর কাছেও কিছু তালিম পেয়েছিলেন। তাঁর শিষ্য ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর গুরুর দক্ষতা ও বিদ্যার যত না তারিফ করতেন, তার চেয়ে বেশি করতেন মহিম মুখুয্যের গলার।

ধূর্জটিপ্রসাদ বেতিয়ার সুরিলাপন, গানের স্থায়ী অন্তরা সঞ্চারী আভোগ বর্তানোর ও গানের মাঝখানে বোল বিস্তারের অঙ্গের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। অন্যদিকে, বহরাম খাঁর অর্থাৎ ডাগরদের ঘরানার আলাপের। আজকের দিনে বিষ্ণুপুর ও বেতিয়া ঘরানার পার্থক্য গেয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার লোক খুঁজে পাচ্ছি না। যা লিখছি, এ সবই মলিন বিবর্ণ শুষ্ক ইতিহাস মাত্র।

ধ্রুপদ প্রসঙ্গ অসমাপ্ত থেকে যাবে যদি ভিন্ন ধারার আর এক নামী গায়ক বিষ্ণুচন্দ্ৰ চক্রবর্তীর উল্লেখ না করা হয়। ইনি ৯৬ বছর বেঁচেছিলেন এবং বাংলার সাঙ্গীতিক নবজাগৃতির সঙ্গে এঁর সঙ্গীতজীবন ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত। ইনি নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের রাজদরবারের সভাগায়ক হনু খাঁ ও দিলওয়ার খাঁর কাছে ধ্রুপদ এবং মিঞা মীরনের কাছে খেয়ালের তালিম পান।

রাজা রামমোহন রায়ের আহ্বানে ইনি ব্রহ্ম সমাজে গায়করূপে যোগদান করেন এবং কলকাতায় সে সময়ে ধ্রুপদাঙ্গ ব্রহ্মসঙ্গীতের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেব প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গীতাচার্য হওয়ার কারণ ওঁর প্রত্যক্ষ প্রভাব মহর্ষির সন্তানদের ওপর পড়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ যখন বিষ্ণু ওস্তাদের কাছে শিক্ষালাভ করেন, তখন তাঁর বয়স নয়/দশ বছরের বেশি নয় এবং নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনীহার উল্লেখ ওঁর ‘জীবনস্মৃতি’তেই পাওয়া যায়। তবে ওঁর গানের ওপর বিষ্ণুচন্দ্র ও যদু ভট্টর ধ্রুপদী রাগসঙ্গীতের প্রভাব যে পড়েছিল, তা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সব গবেষকই স্বীকার করবেন।

আজ পূর্বাঞ্চলে হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয়ের প্রায় শেষ ধাপে (আমি চিরকেলে অপ্টিমিস্টিক, তাই প্রায় শব্দের ব্যবহার করছি) পৌঁছে ধ্রুপদের মুমূর্ষু অবস্থা দেখে যাঁরা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দৌড়দৌড়ি করছেন, তাঁদের মধ্যে ফাল্গুনী মিত্র, বিশ্বভারতীর কাবেরী কর এবং বৎসরান্তে কলকাতায় ধ্রুপদ সম্মিলনীর উদ্যোক্তা রক্তিদেব মৈত্রর নাম উল্লেখযোগ্য।

অন্যত্র ডাগর ঘরানার ফহিমুদ্দিন, বসিফুদ্দিন ও সৈয়দুদ্দিন এবং গুন্ডেচা ভ্রাতৃদ্বয় না থাকলে এতদিনে ধ্রুপদ প্রাগৈতিহাসিক জুরাসিক প্রাণীদের পাশে স্থান অধিকার করত। কলকাতায় অশীতিপর তিন বৃদ্ধ সুবোধরঞ্জন দে, শিবশঙ্কর মুখোপাধ্যায় এবং নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছেন বটে, তবে এঁদের জোয়ান বয়সের গানের আকর্ষণী শক্তি যদি আজ ওঁদের থাকত, তো হয়ত এ অঞ্চলে ধ্রুপদের এবং বিধ দুরবস্থা হত না।

এই বাৎসরিক সম্মিলনীতেই গতবছর অজয় চক্রবর্তী খুবই সুরেলা ও পরিমিতি জ্ঞানের পরিচয় দিয়ে পুরিয়া রাগের আলাপ ও ধ্রুপদ গেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন এ সুসংবাদ পেয়েছি। বাংলায় প্রতিভাবান সুকণ্ঠর অধিকারী গায়কের অভাব নেই, তাঁরাও যদি মাঝেমাঝে খেয়ালের আগে আলাপ করে ধ্রুপদ গান তো এ অঞ্চলে ধ্রুপদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ক্ষীণ আশা পোষণ করা যেতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, তৎকালীন বঙ্গসমাজে যেমন বাবু এবং পেতি বাইজি কালচারের হাতে পড়ে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত এবং লোকায়ত সঙ্গীতের বিকৃতি হয়েছিল, অন্যদিকে বুদ্ধিজীবী এবং ভদ্রলোক বা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় কালোয়াতী গানকে আত্মসাৎ করে তার নিজস্ব বাঙালি চেহারা দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। ভৌগোলিক প্রভাব সব কৃষ্টির ওপর পড়ে। এক্ষেত্রে ধ্রুপদ থেকে জন্মাল বাংলা ব্রহ্মসঙ্গীত ও বাংলার চার তুকের খেয়াল যার প্রবর্তকের নাম রঘুনাথ রায় (১৭৫০-১৮৩৬) এবং যার বর্তমান নাম রাগপ্রধান।

পাঞ্জাবি টপ্পাকে বাঙালিরা গোল গোল দানা দিয়ে বুকে করে নিল–নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত (১৭৪১-১৮৩৯) এবং কালিদাস চট্টোপাধ্যায় বা রাজা রামমোহন রায়ের গুরু কালী মির্জার (১৭৫০-১৮২০) কল্যাণে। এই নতুন রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা ও মধ্যবিত্ত সমাজে তাকে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস তৎকালীন নবজাগরণের বৈশিষ্ট্য।

বর্তমান অবক্ষয়ের যুগে মেনে নিতে হবে বাংলা ধ্রুপদ বা বাংলা খেয়াল ধোপে টিকল না জ্ঞান গোস্বামী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, দীপালি নাগ, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তী বা একালে অজয় চক্রবর্তীর বিশিষ্ট ভূমিকা সত্ত্বেও। আর বাংলা টপ্পা আমাদের শৈশবের কালীপদ পাঠক এবং বুদ্ধদেব গুহর গুরু চণ্ডীদাস মালও একে ইদানীংকালে লোকপ্রিয় করতে সক্ষম হননি।

ধ্রুপদের তিরোভাবের পেছনে দুটি ব্যাখ্যা মনে আসে, যা আমি আমার ‘মজলিস’ নামক পুস্তকে আলোচনা করেছি। প্রথমটি সমাজতাত্ত্বিক ও দ্বিতীয়টি সাঙ্গীতিক। সমাজ গঠনের ও মূল্যবোধ বা ভ্যালুসিস্টেমের সঙ্গে এর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। শুধু ধ্রুপদ নয়, ক্লাসিক্যাল গানবাজনারও এক ঠ্যাং এখন গোরস্থানে। আই টি সি বা ডোভার লেন কনফারেন্স বা রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির বিনটিকিটের বার্ষিক সম্মিলনী ছাড়া কোথায় ভিড় হয় গানবাজনার জলসায়?

ওগুলি এখন অ্যানুয়াল ইভেন্ট, বড়দিনে রেসের মাঠে যাওয়া বা ইডেন গার্ডেনে ক্রিকেট দেখার মতো। কিছু হুজুগে গোলা লোকেরা যান, মুষ্টিমেয় সমঝদাররাও, যাঁদের সামর্থ্য টিকিটের দামের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারে না, বাকিরা যান সমবচ্ছরে একবার নামীদামি ওস্তাদদের চেহারা দেখতে, বাহারে পাঞ্জাবি, শাড়ি-গয়না দেখাতে—এটা তাঁদের স্টেটাস সিম্বল। বড় বড় নাম না থাকলে এ সব কনফারেন্সে কত লোক যেত, একবার পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করে।

শেয়ার মার্কেটে আজ যেমন বেশিরভাগ শেয়ারই মরা সাপের মতো পড়ে, নড়েচড়ে কিছু নামীদামি কোম্পানির শেয়ার সেই রকমই গানবাজনার জগতে কিছু বাঁধা রুচিপ্ ওস্তাদ ও ওস্তাদনী আছেন, তাঁদেরই ঘুরেফিরে ডাক পড়ে। ছোটোখাটো সংস্থা যাদের এই সব তারকাদের ডাকার হিম্মত নেই, তাদের কনফারেন্সে কুল্লে চার-পাঁচশ লোকও হয় না।

অথচ আমরাই দেখেছি, সারারাতের আসরে হলের বাইরে মাইকে সবরকম গাইয়ে বাজিয়েদের শোনবার জন্য শয়ে শয়ে লোক খবরের কাগজ পেতে ট্রাম রাস্তায় বসে থাকত যা তৎকালীন পুলিস কমিশনার পি কে সেনের এক কথায় নাকচ হয়ে যায়।

পাঠক, প্রশ্ন করতে পারেন আজ সময় কোথায় মানুষের? চাকরি রাখতে হবে, বাচ্চাদের দুধ আনতে যেতে হবে, কেরোসিনের লাইন দিতে হবে, মনমোহন-যশোবস্তের কৃপায় এই সাংঘাতিক মাগ্যিগণ্ডার বাজারে কুলিয়ে ওঠার অক্লান্ত চেষ্টা বাকি সময়ে উদয়াস্ত করে যেতে হবে।

যাদের চাকরিতে ঘুষের ব্যবস্থা নেই, তারা ঝুরো ব্যবসা করে, কেউ টিউশনি করে ছেলে পড়ায়, গান শেখায়। মোদ্দা কথা, স্বাধীনতার পঞ্চান্ন বছরের মধ্যে মধ্যবিত্ত মানুষের অবসর নামক যে মহামূল্য সম্পদ ছিল, তা ফুরিয়ে গেছে। অতএব কে এখন বসে বসে ধ্রুপদের দেড়-দু ঘুণ্টার আলাপ শুনতে যাবে?

এ ব্যাখ্যাটি আংশিক সত্য পুরোপুরি নয়। কেন নয় সে আলোচনা আমি পরে করব। এটি যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হত তো শ্রোতারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রসঙ্গীতের আলাপ আসরে বা কনফারেন্সে বসে শুন না। এবার আমরা দ্বিতীয় অর্থাৎ সাঙ্গীতিক কারণটির অনুসন্ধান করব।

অমিয়নাথ সান্যাল তাঁর ‘স্মৃতির অতলে’তে লিখেছেন যে জাকিরুদ্দিন, আল্লাবন্দে খাঁর (মৈনুদ্দিন ও আমিনুদ্দিন ডাগরের পিতামহ এবং তাঁর বড় ভাই) আলাপ শুনে মনে হত কে কতক্ষণ পাল্লা দিয়ে রাগের বিস্তার করতে পারেন তারই মহড়া চলছে। সে ভুল ভাঙল বন্দে আলি খাঁর বীণের আলাপ ও ফৈয়াজ থাকে শুনে। দিলীপকুমার রায়ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা এঁদের হৃৎস্তম্ভনকারী গমকের কথা ‘ভ্রাম্যমাণের দিনপঞ্জিকা’য় লিখে গেছেন।

সম্ভবত এত দীর্ঘ স্বরালাপ, গমকের প্রাচুর্য ও পাখওয়াজের সঙ্গে মারপিট শোনবার ধৈর্য বা মানসিকতা আজকালকার শ্রোতাদের নেই। এই কারণেই আমীর খাঁ তাঁর সঙ্গীতজীবনের গোড়ার দিকে তাঁর মানস গুরু আবদুল বহীদ খাঁর অনুকরণে দেড়-দু ঘণ্টার বিস্তারকে কেটেছেঁটে মানানসই করে নিয়েছিলেন। কিন্তু এটিই ধ্রুপদের প্রতি বিরাগের একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না।

আমি মনে করি, ধ্রুপদ ধামারকে আত্মসাৎ করে খেয়াল এখন অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। এর জন্য দায়ী মূলত কিরানা ও আগ্রা, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে আবদুল করিম খা ও ফৈয়াজ খাঁ। গোয়ালিয়রে এখনকার প্রচলিত অর্থে বিস্তার ছিল না। এই অভাববোধে ফৈয়াজ খাঁ নোম তোম আলাপ করে তারপর খেয়াল গাইতেন।

আবদুল করিম খাঁ ধ্রুপদী স্বরবিস্তারকে বোল বিস্তারের রূপ দিয়ে খেয়ালের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ করে তুলেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায় এবং সারা উত্তর ও পশ্চিম ভারত তাঁর এই দান মেনে নিয়েছে। বোলবাট ধামার থেকে ধার করেছে গোয়ালিয়র ও আগ্রা। বোলতান আগ্রার দান। সার্গম কিনারা ঘরে এসেছে আবদুল করিমের দৌলতে।

কর্ণাটকী সঙ্গীত থেকে যদিও আল্লাদিয়া খাঁর আত্মজীবনী থেকে জানা গেছে ধ্রুপদে ডাগরদের পূর্বপুরুষ বহরাম খাঁ এর বহুল ব্যবহার করতেন এবং পাঞ্জাবিরা এই অঙ্গটি বরাবরই বড়ই পছন্দ করে এসেছে। বোলবাটের ঠুংরি কাওয়ালি থেকে ফৈয়াজ খাঁ নিলেন বোল বানাবার কায়দা মধ্য এবং দ্রুত লয়ের খেয়ালের জন্য। এই সঙ্গে পুকার।

সব শেষে খেয়ালের ক্লাইম্যাক্স হচ্ছে রকম-বেরকমের তানে। ফলে এই প্রকারের খেয়ালের পাশে (অবশ্য যদি এই সবক’টি অঙ্গ ব্যবহার করা হয়) ধ্রুপদ ধামার অনেক সরল এবং ফ্যাকাসে মনে হওয়া আশ্চর্য নয়। সব মানুষের মধ্যেই একটা অন্তর্নিহিত ছন্দজ্ঞান আছে, তার প্রয়োজন মেটাতে হয় সুচরুরূপে। নৃত্য বাদ্য গীত এই তিনে মিলে সঙ্গীত। বেশিরভাগ ধ্রুপদীরা

এ কথা ভুলে এতকাল পাখাওয়াজের সঙ্গে বোলবার্ট ও লয়কারীর নামে বেসুরো ঝগড়া কাজিয়া করে ধ্রুপদের সরল গাম্ভীর্যের অবমাননা করে এসেছেন এবং যে ধ্রুপদ ধামারের লোকপ্রিয়তা গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেও এই পূর্বাঞ্চলে তুঙ্গে ছিল, তা আজ খাদের তলায় এসে পৌঁছেছে। খুব সুরেলা ও সুকণ্ঠর অধিকারী ধ্রুপদী না হলে তার গান ভাল লাগার কথা নয়, আর আজকের যুগে ধ্রুপদের সরল গাম্ভীর্য ও ডিরেকটনেস চলবে না।

খেয়ালে ওজন কমছে ও তানের স্পিড বাড়ছে। নানাপ্রকার হালকা অলঙ্কার মুড়কি ও পাঞ্জাবি হরকত ঢুকে পড়েছে যা বছর ষাট-সত্তর আগেও ভদ্রসমাজে অকল্পনীয় ছিল। ধ্রুপদ ও বন্দেশি খেয়াল চোখের সামনে না থাকায় আধুনিক খেয়ালের বাঁধুনি ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। অস্থায়ী অন্তরার মূল্য নেই, অতএব তাকে নিয়ে শৃঙ্গার করার প্রশ্ন উঠছে না।

এর সবচেয়ে বড় কুফল যা দেখতে পাচ্ছি, তা স্পষ্ট হচ্ছে রাগ রূপায়ণে। এর প্রধান কারণ তালিমের অভাব। রাগবাচক স্বরসমূহ বা ফ্রেজকে অলঙ্করণ করার পরিবর্তে মীরখণ্ডের সাহায্যে মেকানিকাল স্বরবিস্তার এবং তান ও পালটার যথেচ্ছ ব্যবহার রাগ রূপায়ণের প্রতিকূল। যদি রাগই না ফোটে, তো রাগসঙ্গীত কী?

এ প্রশ্ন আমাদের প্রজন্মের শ্রোতাদের মনে জাগা অস্বাভাবিক নয়। যুগবাহিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ট্র্যাডিশনাল ফর্মের প্রতি অবজ্ঞা, স্পিডের নামে অহেতুক পাগলামি এবং সদাই তাক লগাবার প্রচেষ্টা—এ সবই যুগোপযোগী অবক্ষয়ের নিদর্শন। শুনতে পাই একজন প্রখ্যাত সেতারবাদক নাকি প্রকাশ্যেই বলেন, এই কম্পিউটারের যুগে ধরাবাঁধা রাগের চলনের মূল্য কি?

মাদ্রাজিরা এ প্রশ্নের সদুত্তর অনেককাল আগেই পেয়ে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে শুধু স্কেল ও পাল্টা বাজাচ্ছেন ও গাইছেন। অতএব উপরোক্ত চিন্তাধারাকে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশনের নিদর্শন বলে ধরে নিয়ে রাজনীতির জগতের কর্তাব্যক্তিরা আনন্দ করতে পারেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগ যে কীপ্রকার রত্নগর্ভা ছিল, তার পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না ঠাকুরবাড়ির সম্পর্কে বিশদ আলোচনা ভিন্ন। এই বংশে যাঁরা জন্ম নিয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ থেকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, বোন স্বর্ণকুমারী দেবী মায় ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ-গগনেন্দ্রনাথ, [ভাইঝি সুনয়নী ও বিনয়নী দেবী] যাঁরা নিজের নিজের জগতে দিকপাল।

বড়দাদা সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলি লিখেছেন, তাঁর জীবনে উনি দুটি বিরাট পণ্ডিত দেখেছেন, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রজেন্দ্রনাথ সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ বলতেন, তাঁর সঙ্গে এক ঘণ্টা আলোচনা করলে একটা আস্ত ডক্টরেট থিসিসের মাল মশলা বেরিয়ে আসত। লিখতেন তিনি গুরুগম্ভীর খটমট ইংরেজিতে। (লর্ড কার্জন প্রথম দর্শনে ব্রজেন্দ্রনাথকে বলেন, ‘সো ইউ আর সীল, বাট ইউ রাইট লাইক আ হিপোপটেমাস’)। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘গীতাপাঠ’ পুস্তক সম্পর্কে মুজতবা আলির বক্তব্য :

ছত্রে ছত্রে পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তিন দর্শন এক করে (প্রয়োজনমত ইউরোপীয় দর্শন দিয়ে সেটা আমাদের আরও কাছে টানে) তার সঙ্গে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমজনিত দীর্ঘকালব্যাপী সশ্রদ্ধ সাধনালব্ধ অমূল্য নিধি যোগ করে, কবিজনোচিত অতুলনীয় তুলনা, ব্যঞ্জনা বর্ণনা দিয়ে অতিশয় কালোপযোগী করে তিন এই পুস্তকখানি নির্মাণ করেছেন। সকলেই বলে এ পুস্তক বড় কঠিন।

আমিও স্বীকার করি, তার প্রধান কারণ দ্বিজেন্দ্রনাথ একই সময়ে একাধিক ডাইমেনশনে বিচরণ করতেন। কিন্তু এ কথাও সবিনয় নিবেদন করি, এরকম কঠিন জিনিস এত সরল করে ইতিপূর্বে কেউ লেখেননি। … ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে আমার যেটুকু সামান্য জ্ঞান সে দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। বাকিটুকু রমন মহর্ষির কাছ থেকে ও বিবেকানন্দ পড়ে।

হিন্দু দ্বিজেন্দ্রনাথ আমাকে সুফিতত্ত্বের মূল মর্মকথা বুঝিয়ে দেন। সুফিতত্ত্বে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে। …এই দ্বিজেন্দ্রনাথ বাংলায় শর্টহ্যান্ড বই ছাপিয়েছিলেন। তার ১২/১৪ বছর পর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে বৃদ্ধ দ্বিজেন্দ্রনাথ সেটি আবার নতুন করে লেখেন… রামানন্দ ঘন ঘন তাড়া না লাগালে এই অতুলনীয় পুস্তক সৃষ্ট হত না।

অন্যত্র উনি লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ দাদার গণিতচর্চা বিদেশে প্রকাশিত করার জন্য উৎসাহী ছিলেন কিন্তু বড়দাদা বিশেষ গা করেননি। গ্রীক, লাতিন ও সংস্কৃতয় ওঁর সমান ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর সাহিত্যচর্চা বিশেষত ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ [১৮৭৩], ‘মেঘদূতে’র [১৮৬০] বাংলা অনুবাদ ও অন্যান্য কাব্য নিয়ে সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন।

রবীন্দ্র প্রতিভার ছায়ায় যে দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে যাননি, সে জন্য বঙ্গজন সুকুমারবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ। মাইকেল মধুসূদন ‘স্বপ্নপ্রয়াণ’ পড়ে বলেছিলেন ‘নাউ! দেয়ার ইজ আ পোয়েট, হ্যাটস অফ টু দ্যাট ম্যান।’* রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জীবনস্মৃতিতে’ লিখেছেন

বসন্তে আমের বোল যেমন অকালে অজস্র ঝরিয়া পড়িয়া গাছের তলা ছাইয়া ফেলে, তেমনি স্বপ্নপ্রয়াণের কত পরিত্যক্ত পত্র বাড়িময় ছড়াছড়ি যাইত তাহার ঠিকানা নাই। বড়দাদার কবিকল্পনার এত প্রচুর প্রাণশক্তি ছিল যে, তাঁহার যতটা আবশ্যক তাহার চেয়ে তিনি ফলাইতেন অনেক বেশি। এই জন্য তিনি বিস্তর

* আচার্য কৃষ্ণকমল (ভট্টাচার্য) তাঁহার স্মৃতিকথায় বলিয়াছেন “আজকালকার ছেলেরা [লক্ষণীয় মেয়েদের উল্লেখ নেই] শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নপ্রয়াণ’ গ্রন্থখানির সহিত বিশেষ পরিচিত নহে। কিন্তু অত originality. অমন রচনাসৌষ্ঠত আমি আর কুত্রাপি দেখি নাই।

ভাব সকল যেন luscious। যদি কেহ বাঙ্গালা, সাহিত্যের মধ্যে শেলীর আস্বাদ পাইতে চায় তাহা হইলে এই গ্রন্থখানি হইতে পাইবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই somehow or other, it never came the surface. ‘পুরাতন প্রসঙ্গ, ১ম পর্যায়, বিপিনবিহারী গুপ্ত। প্রকাশকের টীকা।

লেখা ফেলিয়া দিতেন। সেইগুলি কুড়াইয়া রাখিলে বঙ্গ সাহিত্যের একটি সাজি ভরিয়া তোলা যাইত। আজ পুস্তকের নামও সম্ভবত বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজ্ঞাত।

বাংলায় প্রথম স্বরলিপি রচনা ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। দ্বিতীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ এবং তিনি ক্ষেত্রমোহনের স্বরলিপি রচনা সম্পর্কে যে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। তিরিশ সঙ্গীতও রচনা করেন উনি। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন তাঁর এগার বছর বয়সে ‘আমি বেহাগে গান গাহিতেছি তুমি বিনা কে প্রভু সংকট নিবারে

কে সহায় ভব-অন্ধকারে

তিনি [মহর্ষি] নিস্তব্ধ হইয়া নতশিরে কোলের উপর দুই হাত জোড় করিয়া শুনিতেছেন, সেই সন্ধ্যাবেলাটির ছবি আজও মনে পড়িতেছে।’ এই গানটি দ্বিজেন্দ্রনাথের রচনা। [বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র-রচনাবলীর ১৭ খণ্ডে ‘জীবনস্মৃতি’র ৩১৭ পৃষ্ঠার পাদটীকায় গানটি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা বলে চিহ্নিত প্রকাশকের মন্তব্য।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পঞ্চম পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একাধারে গায়ক, সুরকার, সেতার, বেহালা পিয়ানোতে দক্ষ, নাট্যকার, সুসাহিত্যিক, অনুবাদক চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী। এঁর পুস্তকের সংখ্যা ছেচল্লিশ। সাহিত্য সংসদের ‘বাঙালি চরিতাভিধান’ প্রথম খণ্ড থেকে এঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিচ্ছি বিস্তারিত তথ্য বিবরণ পাওয়া যাবে বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি’তে [এবং সুশীল রায়ের ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে]

গৃহেই শিক্ষারম্ভ। তারপর সেন্ট পলস, মন্টেগু আকাদেমি হিন্দু স্কুলে পড়াশুনা করেন, সবশেষে ব্রহ্মানন্দ প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা কলেজ [পরে নাম হয় অ্যালবার্ট] থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন (১৮৬৪)। প্রেসিডেন্সী কলেজে এফ. পড়ার সময়ে পারিবারিক জোড়াসাঁকো থিয়েটার সংগঠনের চেষ্টায় কলেজ ত্যাগ করেন। ১৮৬৭ খ্রিঃ অগ্রজ সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথের কর্মস্থল আমেদাবাদে গিয়ে সেতারবাদন, অঙ্কনবিদ্যা এবং ফরাসি মারাঠি ভাষা শিক্ষা করেন।

কলকাতায় ফিরে এসে আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকরূপে (১৮৬৯-৮৪ খ্রিঃ) কাজ করেন। ১৯২৪ খ্রিঃ বালগঙ্গাধর তিলক রচিত ‘গীতা রহস্যে’র বঙ্গানুবাদ করেন। চৈত্র হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘উদ্বোধন’ নামে একটি স্বদেশ-প্রেমোদ্দীপক কাব্য পাঠ করেন (১৮৬৮)। ১৮৭৪-৭৫ খ্রিঃ মেলার যুগ্মসম্পাদক নিযুক্ত হন।

এর আগেই তাঁর রচিত জাতীয় ভাবোদ্দীপক ঐতিহাসিক নাটক ‘পুরুবিক্রম’-এর সাফল্যমণ্ডিত অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাট্যকার জীবনের সূত্রপাত হয়। রাজনারায়ণ বসুর সভাপতিত্বে তাঁর উদ্যোগে ‘সঞ্জীবনী’ সভার [হামচ্পামুহাফ] সূচনা সম্ভবত ১৮৭৬ খ্রিঃ হয় (মতান্তরে ১৮৭৭ ‘সাহিত্য সাধক চরিতমালা’ ৬৮ খণ্ড, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পৃ.৩০]।

গুপ্ত স্বদেশি সভার প্রকাশ্য কর্মতৎপরতার ফলে দেশলাই প্রস্তুত দেশি কাপড় বোনার চেষ্টা হয়। দেশি স্টিমার সার্ভিস চালু করার চেষ্টায় (১৮৮৪) এবং কিছু আগে নীলচাষ পাটের ব্যবসায়ে তিনি অনেক আর্থিক ক্ষতি সহ্য করেন। প্রধানত অনভিজ্ঞতা মূল কারণ হলেও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের অপচেষ্টার ফলেই এইসব দেশি ব্যবসা ধ্বংস হয়। স্ত্রী-শিক্ষা ও নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা তিনি। এক সময়ে ‘কিঞ্চিৎ জলযোগ’ (১৮৭২) প্রহসন রচনার জন্য পরে দুঃখপ্রকাশ করেন।

নিজ স্ত্রী কাদম্বরীকে শুধু শিক্ষার সুযোগই দেননি, পরন্তু সকল সামাজিক বাধা উপেক্ষা করে কলকাতার ময়দানে প্রকাশ্যে অশ্বচালনায় পারদর্শিনী করে তোলেন। কুলীন বহুবিবাহ প্রথাকে ব্যঙ্গ করে রামনারায়ণ রচিত ‘নবনাটক’ তাঁরই চেষ্টায় জোড়াসাঁকো থিয়েটারে অভিনীত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম বিস্তৃত। ‘পুরুবিক্রম’ ছাড়া ‘স্বপ্নময়ী’, ‘সরোজিনী’, ‘অশ্ৰুমতী’ ইত্যাদি নাটকগুলি বিখ্যাত হয় ও কোনও কোনওটি হিন্দি, গুজরাটি ও মারাঠি ভাষায় অনুদিত হয়।

‘অলীকবাবু’, ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রহসন। বেশ কয়েকটি নাটক পেশাদার রঙ্গমঞ্চ ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে’ সাফল্যলাভ করে। তরুণ বয়সে স্বয়ং মঞ্চাভিনয়ে খ্যাতি পান। ‘বিদ্বজ্জন সমাগম’ (১৮৭৪) এবং ‘সারস্বত সমাজ’ (১৮৮২) নামে দুটি সংগঠনের মাধ্যমে বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির চেষ্টা করেন। ‘ভারতী’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান উদ্যোগী (১৮৭৭)। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি ছিলেন (১৯০২-০৩)।

ইতিহাস, দর্শন, ভ্রমণ কাহিনী এবং বহু গল্প ও উপন্যাস ফরাসি সাহিত্যসম্পদ থেকে আহরণ করে বাংলায় অনুবাদ করেন। অনেকগুলি সংস্কৃত নাটকও বাংলায় অনুবাদ করেন। চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী তাঁর ছবির খাতায় বহু খ্যাত-অখ্যাত ব্যক্তির প্রতিকৃতি সংগৃহীত আছে। বিখ্যাত ইংরেজ শিল্পী [রবীন্দ্রনাথ ও] রদেনস্টাইনের আগ্রহে তাঁর চিত্রাবলীর একটি স্বনিবার্চিত সংগ্রহ ১৯১৪ খ্রিঃ বিলাতে প্রকাশিত হয়।

প্রায় দু’হাজার চিত্রের অধিকাংশই রবীন্দ্রভারতী সমিতির সংগ্রহভুক্ত। তাঁর সাঙ্গীতিক অবদানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম শিক্ষা ঠাকুরবাড়ির সঙ্গীত শিক্ষক বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীর নিকট। বোম্বাইয়ে সেতার শিক্ষার পর কলকাতায় ফিরে পিয়ানো, বেহালা ও হারমোনিয়াম অনুশীলন করেন।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ সময়ে নূতন নূতন সুর সৃষ্টি করিতেন ও রবীন্দ্রনাথ…সেগুলিকে কথায় বাঁধিবার চেষ্টায় নিযুক্ত থাকিতেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘মায়ার খেলা’র ও সমসাময়কি কালে রচিত অন্তত ২০টি গান জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরে গঠিত। হিন্দি ধ্রুপদাঙ্গের অনুসরণে অনেকগুলি ব্রহ্মা সঙ্গীত রচনা করেন। বাংলাদেশে আকারমাত্রিক স্বরলিপির উদ্ভাবন ও প্রচলনে তাঁর দান স্মরণীয়।

তাঁর রচিত ‘স্বরলিপি-গীতিমালা’ [চার খণ্ডে ও কাঙ্গালীচরণ সেন সঙ্কলিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি’ পুস্তকে তাঁর অনেক গান প্রকাশিত। ‘বীণাবাদিনী’ [১৮৯৭] ও ‘সঙ্গীত প্রকাশিকা’ [১৯০১] তাঁর সম্পাদিত (সঙ্গীত-বিষয়ক] মাসিকপত্র। ভারতীয় সঙ্গীত সমাজ’ স্থাপন (১৮৯৭) তাঁর অন্যতম কীর্তি।

রবীন্দ্রনাথের এই দুই ক্ষণজন্মা দাদার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়ার একমাত্র কারণ এঁদের প্রভাব রবীন্দ্রনাথের ওপর। নবজাগরণের কালের অবদান বাংলা ধ্রুপদ, বাংলা খেয়াল এবং একান্তই বাঙালি নিধুবাবুর টপ্পা আজ এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবক্ষয়ের যুগে হারিয়ে যাওয়ার মুখে হলেও যা বেড়ার এপার ওপার দুই বঙ্গ ছেয়ে রয়েছে তা রবীন্দ্রসঙ্গীত। কিছু গোঁড়া উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বোদ্ধা আছেন, যাঁরা এই প্রশ্ন তুলতে পারেন হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে টেনে আনা কেন?

আমি মনে করি উনি হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের মূলধারা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন হননি এবং হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের আধারেই ওঁর বেশিরভাগ গান রচনা করেছেন। উনি নিজেই ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছেন, ‘ইচ্ছা করলেও সেই (হিন্দুস্থানি) সঙ্গীতকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারিনে। সেই সঙ্গীত থেকেই আমি প্রেরণা লাভ করি এ কথা যারা জানে তারাই হিন্দুস্থানি সঙ্গীত জানে না’ (‘সুর ও সঙ্গতি’)।

অন্যত্র উনি দিলীপকুমার রায়কে বলছেন ‘হিন্দুস্থানি গানের সুরকে তো আমরা ছাড়িয়ে যেতে পারি না। আমাকেও তো নিজের গানের সুরের জন্য ঐ হিন্দুস্থানী সুরের কাছে বারবার হাত পাততে হয়েছে।’ (সংগীত চিন্তা, পৃ. ১০১)।

‘জীবনস্মৃতি’তে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

সাহিত্যের শিক্ষায়, ভাবের চর্চায় বাল্যকাল হইতে জ্যোতিদাদা আমার সহায় ছিলেন। তিনি নিজে উৎসাহী এবং অন্যকে উৎসাহ দিতে তাঁর আনন্দ… জ্যোতিদাদাই সম্পূর্ণ নিঃসঙ্কোচে সমস্ত ভালোমন্দর মধ্য দিয়া আমাকে আত্মোপলব্ধির ক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিয়াছেন, এবং তখন হইতেই আমার আপন শক্তি নিজের কাঁটা ও নিজের ফুল বিকাশ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে পারিয়াছে।

… এক সময়ে পিয়ানো বাজাইয়া জ্যোতিদাদা নূতন নূতন সুর তৈরি করায় মাতিয়াছিলেন। প্রত্যহই তাঁহার অঙ্গুলিনৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সুরবর্ষণ হইতে থাকিত। আমি এবং অক্ষয়বাবু তাঁহার সেই সদ্যোজাত সুরগুলিকে কথা দিয়া বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলাম। গান বাঁধিবার শিক্ষানবিশি এইরূপে আমার আরম্ভ হইয়াছিল।

আমাদের পরিবারে শিশুকাল হইতে গানচর্চার মধ্যেই আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমার পক্ষে তাহার একটা সুবিধা এই হইয়াছিল, অতি সহজেই গান আমার সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে উল্লেখ আছে জ্যোতিদাদার এই প্রসঙ্গে উক্তি।

সরোজিনী প্রকাশের পর হইতেই আমরা রবিকে (বার বছরের ছোট) প্রমোশন দিয়া আমাদের সমশ্রেণীতে উঠাইয়া লইলাম। এখন হইতে সঙ্গীত ও সাহিত্যচর্চাতে আমরা হইলাম তিনজন—অক্ষয় (চৌধুরি), রবি ও আমি।… এই সময়ে আমি পিয়ানো বাজাইয়া নানাবিধ সুর রচনা করিতাম। আমার দুইপার্শ্বে অক্ষয়চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ কাগজ পেন্সিল লইয়া বসিতেন।

আমি যেমনি একটি সুর-রচনা করিলাম, অমনি ইঁহারা সেই সুরের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ কথা বসাইয়া গান-রচনা করিতে লাগিয়া যাইতেন। একটি নূতন সুর তৈরি হইবামাত্র, সেটি আর কয়েকবার বাজাইয়া ইহাদিগকে শুনাইতাম… সচরাচর গান বাঁধিয়া তাহাতে সুর সংযোগ করাই প্রচলিত রীতি, কিন্তু আমাদের পদ্ধতি ছিল উল্টা। সুরের অনুরূপ গান তৈরি হইত।

স্বর্ণকুমারীও অনেক সময়ে আমার রচিত সুরে গান প্রস্তুত করিতেন। সাহিত্য এবং সঙ্গীতচর্চায় আমাদের তেতলা মহলের আবহাওয়া তখন দিবারাত্রি সমভাবে পূর্ণ হইয়া থাকিত। রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রথম রচনা ‘কালমৃগয়া’ গীতিনাট্যে এবং তাঁহার দ্বিতীয় রচনা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ গীতিনাট্যেও উক্তরূপে রচিত সুরের অনেক গান দেওয়া ছিল।

ঠাকুরবাড়িতে সঙ্গীতের পরিবেশ উন্নতমানের ছিল। বিষ্ণু চক্রবর্তী, যদু ভট্ট, বরোদার মৌলা বখ্শ, শ্যামশঙ্কর মিশ্র, গায়ক ও গীতরচয়িতা চন্দ্রকোণার রমাপতি বন্দ্যোপাধ্যায়, মহর্ষির পৃষ্ঠপোষকতা ও মাসহারা পেতেন। কিন্তু তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথই মহর্ষির সন্তানদের মধ্যে বিষ্ণু ওস্তাদের নিষ্ঠাবান শিষ্য ছিলেন। চিরকেলে পলাতক রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যোতিদাদার মতই পদ্ধতিগত ও নিয়মনিষ্ঠ তালিমে অনাগ্রহী ছিলেন।

সেইজন্য আশ্চর্য লাগে যখন পড়ি যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সংগৃহীত ও স্বরলিপিবদ্ধ হিন্দুস্থানি গান অনুসারে রবীন্দ্রনাথ অল্পবয়সে বেশ কয়েকটি ধ্রুপদাঙ্গের বাংলা গান রচনা করেন। ‘তাদের কিছু সংখ্যক ধ্রুপদাঙ্গ গান আছে যাদের সুর গঠনে সাদৃশ্য লক্ষণীয়। যেমন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘গাওরে পরব্রহ্মের নাম’ (গৌড় মহলার—চৌতাল এবং রবীন্দ্রনাথের ‘চকোরে মুখচন্দ্রিমা”।

আবার সুর গঠনে সাদৃশ্য না থাকলেও সুর যোজনার মেজাজে সাদৃশ্য দেখা যায়—জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘হৈ অন্তৰ্য্যামী ত্রাহি’ (ঢিমা তেতালা) এবং রবীন্দ্রনাথের ‘কাফিতে টপ্পাঙ্গে এ পরবাসে কে’ (‘জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি’—বসত্তকুমার চট্টোপাধ্যায়)। রীতিবদ্ধ তালিম না পেয়েও রবীন্দ্রনাথ কীভাবে অন্তত খানচল্লিশ হিন্দুস্থানী রাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচিতি লাভ করেছিলেন যার প্রমাণ ওঁর বিভিন্ন গানের সুর সংযোজনের পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে পাওয়া যায়, এ বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।

শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, আমার মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছিলেন লখনউতে প্রফেসর নির্মলকুমার সিদ্ধান্তর বাড়িতে। হিসেবমত তখন আমার বয়স বছর আষ্টেক হবে। শীতকাল। প্রচুর জামাজোব্বা পরে হাঁটুর ওপর রাগ্ বিছিয়ে এক কোণে রবিঠাকুর, অপর কোণে কালো আচকান ও গোল টুপি পরে রতনজনকর।

পরে জেনেছি উনি এক গান্ধারের জয়জয়ন্তী, ছায়ানট ও পরজ গেয়েছিলেন। ঘরভর্তি লোক, তার মধ্যে অতুলপ্রসাদও ছিলেন, তাঁর উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। এইটুকু পরিষ্কার মনে আছে ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে গানের শেষে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নটনারায়ণের ধ্রুপদ গেয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। নটনারায়ণ কিছু প্রচলিত সাদামাঠা গেরস্থপোয়া রাগ নয়।

হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের পরম্পরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কীপ্রকার ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং তাঁর রচনায় হিন্দুস্থানি রাগ সঙ্গীতের স্থান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন আমার চেয়ে একাধিক যোগ্যতর ব্যক্তি। তাদেরই মধ্যে একজনকে বেছে নিচ্ছি। সৈয়দ মজুতবা আলি লিখেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে আলোচনা ও বালাপ রবীন্দ্রনাথ করতেন প্রধানত দিলীপকুমার রায় ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যার নজির পাওয়া যাবে বিশ্বভারতী প্রকাশিত ‘সংগীতচিন্তা’য়।

শেষোক্ত লেখকের Tagore, a study পুস্তকের Music & Dance পরিচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। প্রথম প্রকাশনা ১৯৪৫ সালে। সম্প্রতি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির দ্বারা। এই অংশটির অনুবাদ করেছেন আমার স্নেহভাজন জয়স্তকুমার মুখোপাধ্যায়।

গত (ঊনবিংশ) শতাব্দীর আটের দশকের মধ্যেই যে সমস্ত সঙ্গীতজ্ঞ সামস্ততান্ত্রিক দরবারের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন, নব্য ধনী সম্প্রদায় নিজ নিজ গুণীজনসভায় তাঁদের সাগ্রহে গ্রহণ করলেন। কলকাতা ইতিমধ্যেই বহুজাতি অধ্যুষিত প্রসিদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছে এবং এটি তখন এই নূতন ধনী সম্প্রদায় ও গুণীজন—উভয়েরই আকর্ষণস্থল। বিষ্ণুপুরী সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে তখন বাংলাদেশে হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের একটা ক্ষীণধারা বয়ে চলেছিল।

এই পটভূমিকায় দুই ঠাকুর পরিবার সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের পরিবারে উস্তাদদের পোষণ করা হয়েছিল পরিবারের অল্পবয়সীদের শিক্ষাদানের এবং আদি ব্রাহ্ম সমাজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য। কিন্তু হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের প্রাত্যহিক শিক্ষায় যে একঘেয়ে খুঁটিনাটি সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত, তা পরিবারের বালক-বালিকাদের তেমন আকর্ষণ করতে পারেনি। তা ছাড়া, ঠাকুর পরিবারে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতও যথেষ্ট সমাদৃত ছিল।

এর মোট ফলাফল, সঙ্গীতের ব্যাকরণগত শিক্ষা নয়—রসগ্রহণের শিক্ষা, যেটা সঙ্গীতের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ প্রশস্ত করেছিল। গতানুগতিকতার বাঁধনছাড়া চিরদিনের বাউণ্ডুলে রবীন্দ্রনাথ এই নবলব্ধ স্বাধীনতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেতে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথের সাঙ্গীতিকবোধ ছিল তীক্ষ্ণ, যদিও প্রয়োগকৌশলের দিক দিয়ে কতটা অভ্রান্ত ছিলেন।

সেটা তিনি জানতেন না। সারা জীবন ধরেই ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত—হিন্দুস্থানি ও কর্ণাটকী— উভয়ের প্রতিই তাঁর ভালবাসা ছিল অক্ষুণ্ণ। তা ছাড়া, তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান শ্রোতা। এমন এক শান্তিময় ভাব তাঁর মধ্য দিয়ে উৎসারিত হত যেটা ধ্যানেরই নিকটতম রূপ।

এই ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ধারার যতটা প্রভাব তাঁর ওপর পড়েছিল, পরবর্তীকালে বিভিন্নরূপে তার প্রকাশ ঘটে। ধ্রুপদের চারতুকের চলন, তার স্থির গাম্ভীর্য, তার সরল ও ভারী ছন্দ, তার উচ্চারণের শুদ্ধতা ও উপযুক্ত মেজাজের প্রতি গুরুত্ব এবং তাঁর অন্তত দুটি বিশিষ্ট অলঙ্কার— মীড় ও গমক,

এবং ধ্রুপদের বেশ কিছু তাল—যেমন চৌতাল, ঝাঁপতাল, তেওড়া ইত্যাদিই প্রধানত, রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার গানের কাঠামো রচনা করেছিল। তাঁর ধর্মসঙ্গীত ও সমবেত সঙ্গীতগুলি প্রায় পুরোপুরিই ধ্রুপদভিত্তিক যা এই জাতীয় গানে অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত।

তাঁর কিছু কিছু মধ্যবর্তী রচনায়ও ধ্রুপদের প্রভাব নির্ভুলভাবে লক্ষ্য করা যায়। দ্বিতীয়ত, একটা সময় পর্যন্ত তিনি বিষ্ণুপুরী ধারার উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সুর নিয়ে তাঁর গান রচনা করে গেছেন। বর্তমানে এইসব গানের অনেকগুলিই হারিয়ে যেতে বসেছে। এগুলি বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করতে হলে সঙ্গীত-গবেষকদের সম্ভবত একমাত্র পথ হল রবীন্দ্রনাথের গানের প্রথম দিককার স্বরলিপিগুলির অনুসন্ধান করা।

বিশেষজ্ঞদের উল্লিখিত গান অনুযায়ী এদের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। তৃতীয়ত, সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ রাগের সময়তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন, যে তত্ত্ব অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ রাগ দিন ও রাতের বিশেষ বিশেষ সময়ে গেয়। ঋতু অনুযায়ী রাগের নির্ধারিত সময়ও তিনি অনুসরণ করেছিলেন। ফলে, তাঁর বর্ষার গানে মল্লারের বিভিন্ন প্রকার, বসন্ত ঋতুর গানে বসন্ত ও সমভাবাপন্ন কাফি, সিন্ধুড়ার সুর স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে।

কিন্তু এখানেও তিনি গতানুগতিক পথ অনুসরণ করেননি। চতুর্থত, খেয়ালের তানকর্তব, বাটোয়ারা ও অন্যান্য অলঙ্কার এবং ভাবপ্রকাশের নামে ঠুংরীতে দেহভঙ্গিমার যে আভাস লক্ষিত হয় তা তিনি পরিহার করেছেন। (সম্ভবত বাংলা ভাষা এ সকলের অনুপযোগী বলে)। রবীন্দ্রনাথের ওপর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রভাব সম্পর্কে মোটামুটি এটুকুই বলা চলে।

কিন্তু এটা ধরে নিলে ভুল হবে যে তিনি ওস্তাদী গানের কাছে শিশুর মত আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সেই প্রথম যুগেও গতানুগতিক পথ থেকে সরে যাওয়ার ও বিদ্রোহের চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ও ‘মায়ার খেলা’য় তিনি আইরিশ সুর সংযোজন করেন এবং নাটকের প্রয়োজনে হিন্দুস্থানি সুরের সংস্কার সাধন করেন।

সেতারের কিছু কিছু নির্দিষ্ট গতে কথা বসানো হয়। গানে তাঁর প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সুরের মিশ্রণ বিফল না হলেও তিনি তা নিয়ে কখনওই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যন্ত্রসঙ্গীতের বন্দিশ নিয়ে তাঁর পরীক্ষা সফল হলেও তিনি তা পরিত্যাগ করেন। বহু আগেই রবীন্দ্রনাথ দো-আঁশলা বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম বর্জন করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল বীণা, কিন্তু বীণকর সহজলভ্য ছিল না।

সঙ্গতকারী যন্ত্র হিসেবে তিনি মেয়েলি যন্ত্র এসরাজের (দিলরুবা) ব্যবহার শুরু করেন। যদিও তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে আদর্শ যন্ত্র ছিল, সারেঙ্গি, কিন্তু সারেঙ্গিবাদকদের সামাজিক পরিমণ্ডলের জন্য সেটা সম্ভব ছিল না।

শীঘ্রই তিনি উপলব্ধি করেন, রাগরাগিণীর বাঁধা স্বর-কাঠামো যথেষ্ট নয়। এই তাগিদটা সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প এমনকি রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবন্ধেও লক্ষ্য করা যায়। তাঁর সব রচনাতেই দেখা যায় পুরনো বিশ্বাস থেকে সরে গিয়ে বহির্বিশ্বে নতুনের অনুসন্ধান এবং তার মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের বিকাশ।

তাঁর রচনা যেন গুটিবদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করে বিকশিত হয়ে উঠছিল এবং বহির্বিশ্বকে নতুন করে চিনে নিচ্ছিল। তাঁর গানের মধ্যেই এর প্রকাশ সবচেয়ে ভালভাবে লক্ষ্য করতে পারি। তাঁর এই প্রচেষ্টা শুরু হয় বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ ও তাদের একটা নতুন রূপদানের মধ্য দিয়ে। এর মোট ফলাফল—তিরিশ থেকে চল্লিশটি নতুন রাগিণী ও হাজারখানেক গানের সৃষ্টি। স্বভাবতই উস্তাদ এবং সঙ্গীতোৎসাহীরা এদের নিছক মিশ্রণ বলে অভিহিত করলেন।

কিন্তু এগুলি ছিল নতুনই নয়, মহান সঙ্গীতজ্ঞরা যে মূলনীতিগুলি অবলম্বন করে নতুন সৃষ্টি—শুধু তাদের সঙ্গীত সৃষ্টি করেন এবং জনসাধারণ তাকে গ্রহণ করে এই নবসৃষ্টির মধ্যে সেই নীতিগুলিই অনুসৃত হয়েছিল। শুধু পার্থক্য ছিল এই যে, রবীন্দ্রনাথ খানদানবহির্ভূত ব্যক্তি, তিনি জীবিত ও বর্তমান এবং তাঁর গানের কথা উদ্ভাদদের তানের অর্থহীন শব্দগুচ্ছ নয়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ক্রমবিকাশের যে ধারা, রবীন্দ্রনাথের এই সময়কার গান তারই অনুসারী।

এই তিরিশ বা চল্লিশটি নতুন রাগিণীকে বেশ কয়েকটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। টোড়ির শ্রেণীতে রবীন্দ্রনাথের মিশ্রণগুলি হল, আশাবরী-ভৈরবী, জৌনপুরী-ভৈরবী, দরবারী টোড়ি-জৌনপুরী বা ভৈরবী, খট-টোঁড়ি এবং টৌড়ি রামকেলী। ভৈরব শ্রেণীতে পড়ে রামকেলী-ভৈরব, আনন্দ-ভৈরব, কালাংড়া-ভৈরব, ভৈরব-ভৈরবী। তাঁর খাসদুর্গ ছিল ভৈরবী এবং তাঁর সকাল বেলার একটি গানও এর ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত নয়।

স্থানাভাবে রবীন্দ্রনাথের ভৈরবীর প্রকারগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না, যার সংখ্যা অন্তত এক ডজন। বিলাবলের ওপর যেমন, সারঙের ওপরও তেমনি তাঁর বহু গান আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু এ দুটি রাগের ক্ষেত্রে তিনি ঠিক স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। প্রচলিত বৃন্দাবনী, মধুমদ্ ও গৌড়ই তাঁর গানে রয়েছে, ব্যতিক্রম শুধু বৃন্দাবনী সারঙের সঙ্গে মেঘের মিশ্রণ।

পিলু ও বারোয়া তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল, কিন্তু এদেরকে তিনি পৃথক রাগ হিসেবে দেখেননি। তাঁর সমস্ত পিলু-বারোয়াঁর গানগুলি হালকা চালে এবং প্রধানত কাশ্মীরি খেমটা ও কাহারবা জাতীয় হালকা তালে রচিত, যে তালগুলি প্রধানত শহরের হীনজীবিকার মেয়েদের গানে এবং গ্রামের মানুষদের পারিবারিক উৎসব-অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের আর একটি প্রিয় রাগ মুলতানী। এর তিনপ্রকার মিশ্রণ তিনি ঘটিয়েছেন—মুলতানী-ভীমপলাসী, মুলতানী-পূরবী ও মুলতানী-টোড়ি।

এবং এখানেই আমরা স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথের রাগ মিশ্রণের মূলনীতিগুলি বুঝতে পারি। সময়ের দিক দিয়ে মুলতানী হল ভীমপলাসী ও পূরবীর পূর্ববর্তী এবং রাগগুলির ভাব একই জাতীয়। দিনাত্ত ও গোধূলির বিষাদাচ্ছন্নতাই এই রাগগুলির মূলভাব। বাংলার গ্রাম্য সঙ্গীতে (country songs) মুলতানী ও ভীমপলাসীর পার্থক্য এখনও পর্যন্ত করা হয় না। টৌড়ি ও মুলতানীতে রে, গা, ধা—এই তিনটি বিকৃত স্বর লাগে এবং যথোচিত সতর্কতা অবলম্বন না করলে এ দুটি রাগকে এক শোনায়।

একটি বিশেষ সময়ের সঙ্গে একটি বিশেষ রাগের মূল ভাবটির যে সম্বন্ধ তৈরি হয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথ কদাচিৎ তাকে ভেঙেছেন। এক রস থেকে অন্য রসে যেতে গিয়ে তিনি প্রথমে একই জাতীয় রাগের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন এবং তারপর এমন কিছু রাগ মিলিয়েছেন যাদের কয়েকটি সাধারণ স্বর এক হলেও স্বরবিন্যাস ভিন্ন প্রকারের।

প্রসিদ্ধ সঙ্গীতবিদরা তো এভাবেই নতুন রাগ সৃষ্টি করে গেছেন। নইলে, দেশি টোড়ি, ইমন-কল্যাণ, কাফি-সিন্ধু, গৌড়-মল্লার, দেশ-মল্লার, সুরট-মল্লার, ঝিঝিট খাম্বাজ, বেহাগ-খাম্বাজ, ভৈরো-বাহার, বসন্ত-বাহার ও আরও অজস্র রাগের সৃষ্টির পেছনে আর কী নীতি কাজ করেছে? আড়ানা আসলে সারং-কানাড়া, শঙ্করা আসলে বেহাগ-কল্যাণ ছাড়া আর কী? সত্যি বলতে, তানসেন আর ডারউইনের পর বিপরীতধর্মী মত পোষণ করা নিছকই মূর্খতা।

প্রধান সন্ধ্যাকালীন রাগের শ্রেণীগুলি হল, কল্যাণ, কেদার, বসন্ত, বেহাগ ও মল্লার। কল্যাণ জাতীয় রাগের সংখ্যা বেশি নয়, পূরবী ও ভূপালির সঙ্গেই প্রধানত তাদের মিশ্রণ ঘটেছে। কেদারা চমৎকারভাবে ছায়ানট, হাম্বীর, খাম্বাজ, শ্যাম ও বেহাগের সঙ্গে মিশেছে। অন্যদিকে, বেহাগ মিশেছে খাম্বাজ ও শঙ্করার সঙ্গে এবং বসন্ত মিশেছে সোহিনী, হিন্দোল, পরজ, বাহার ও ললিতের সঙ্গে। যেহেতু অষ্টাদশ প্রকারের কানাড়া প্রচলিতই আছে তার ওপর তিনি নতুন কোনও উন্নতিসাধণ করতে পারেননি।

সম্ভবত বাগেশ্রী রাগটি রবীন্দ্রনাথের ততটা পছন্দের ছিল না, কারণ বর্তমান প্রবন্ধকারের মাত্র একটি গানের কথাই জানা আছে যেটা তিনি বাগেশ্রীর ওপর রচনা করেছেন। যাই হোক, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমস্ত প্রতিভা মনে হয় যেন বর্ষার সুর মল্লারের জন্যই সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। দ্বাদশ প্রকারের মল্লারের অস্তিত্ব রয়েছে বলে শোনা যায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মল্লারের মধ্যে নিজেকে যেন সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দিয়েছিলেন। বর্ষাকালই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।

ভারতের সম্রাটের মতই তিনি ফিরে আসতেন তাঁর মানস-রাজধানী শান্তিনিকেতনে যেখানে বৃষ্টি সমস্ত জায়গা জুড়ে রাজকীয় মহিমায় নেমে আসে এবং তাঁর আগমনে আশ্রম যেন জীবনের পূর্ণতা লাভ করে। শান্তিনিকেতন যেন বৃষ্টির অপেক্ষাতেই থাকে।

গ্রীষ্মে শুকনো মাটি কঙ্কালের অস্থির কাঠিন্য লাভ করে। কিন্তু প্রবল বর্ষণের শেষে জলের ক্ষীণ ধারা পরিণত হয় প্রবল জলস্রোতে, কেতকী প্রস্ফুটিত হয় এবং আনন্দোৎসবে চারিদিক মেতে ওঠে (একমাত্র অসুবিধে, সাপ বেরিয়ে আসে—কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন একবার বলেছিলেন, ‘কেউ কি এখানে আজ পর্যন্ত সাপের কামড়ে মারা গেছে?’

সত্যিই, কেউ নয়। দু’বারে সাপের কামড় খাওয়ার ঘটনা ঘটেছে—কিন্তু মারা যাওয়ার ঘটনা একবারও ঘটেনি। অবশ্য, এ তো আশ্রমের ভেতরে বাইরে নয়।)।

রবীন্দ্রনাথের মল্লারগুলিকে বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। গুরুগাম্ভীর্য থেকে উচ্ছল আনন্দ—সবই তাঁর মল্লারের গানে দেখা দিয়ে গেছে। তিনি মল্লারকে মিশিয়েছেন কাফি, কানাড়া, দেশ, সুরট, পিলু-বারোয়া ইত্যাদি আরও অনেক রাগের সঙ্গে। এ সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কখনও কখনও প্রায় হঠকারীর পর্যায়ে চলে এসেছেন।

কিন্তু তাঁর বর্ষাসঙ্গীতের মূল কাঠামোয় মেঘ রাগের চিহ্ন থেকেই গেছে। আরও দুটি রাগ খাম্বাজ ও কাফি—যাদের গাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় বাঁধা নেই, রবীন্দ্রনাথ তাদের পুনঃপুন ব্যবহার করেছেন। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পদ্ধতি অনুসারে এই রাগ দুটি সব সময়ই গাওয়া চলতে পারে। চেখফ-এর ‘ডার্লিং’-এর মতো খাম্বাজও অতি নমনীয় রাগ।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিয়েছেন খাম্বাজ-বেহাগ, পিলু-খাম্বাজ, খাম্বাজ ছায়া, গারা-খাম্বাজ, খাম্বাজ-বাহার, খাম্বাজ-কেদারা, খাম্বাজ-কাফি প্রভৃতি অসংখ্য রাগ, যার সামান্যই এখানে উল্লিখিত হল। কাফি মিশেছে সিন্ধু, সিন্ধুড়া, খাম্বাজ, পিলু এবং অবশ্যই কানাড়ার সঙ্গে (রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিভাসের মতো সাহানারও ব্যবহার ঠিকভাবে করেননি)।

ওপরের তালিকা বিস্তৃত না হলেও চল্লিশের বেশি প্রকারের উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা লিখেছি, ‘তিরিশ থেকে চল্লিশ’, তার সহজ কারণ হল, অন্ততপক্ষে তিরিশটি মিশ্রণ যদি কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকে, সম্ভবত তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও অজানা এবং আমাদের মতো অধিকাংশজনের কাছে তো বটেই। ঐতিহাসিক নিরিখে এগুলি নিঃসন্দেহে নতুন সৃষ্টি। অবশ্য সব মিশ্রণই নিখুঁত হয়নি। কোনও কোনও গানে এই মিশ্রণ বেশ নড়বড়ে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সুরের মিশ্রণ ঘটিয়েই থেমে থাকেননি। তালের ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি নতুন সৃষ্টি হয়েছে যথাক্রমে ৯, ১১, ও ১৩ মাত্রার। বর্তমান নিবন্ধকারের মনে পড়ে, তিনি কদা রবীন্দ্রনাথের ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ প্রবন্ধটির বিরুদ্ধে আহূত এক সভায় উপস্থিত ছিলেন, যেখানে একজন সঙ্গীতবিদ জনৈকা গায়িকার গাওয়া গানের মধ্য দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলেন এই নতুন তালগুলি আসলে নববেশ পরিহিত পুরনো তাল ছাড়া কিছু নয়।

আসলে কিন্তু তেমন কিছুই প্রমাণিত হয়নি। ফলে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ শেষ পর্যন্ত টেকেনি। স্বভাবতই রবীন্দ্রনাথ ‘জনতার রুচি’কে আমল দেননি এবং ধ্রুপদ, ধামার প্রভৃতি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে রূপগুলির সঙ্গে সাধারণ মানুষ পরিচিত, তার বাইরে গিয়ে কিছু করার সাহস দেখালেন। পরিহাসের বিষয় এই যে, সাধারণ মানুষ জানে না যে, বর্তমানে যে ধ্রুপদ, ধামার গাওয়া হয়, তা এক সময়ে আগ্রা, গোয়ালিয়র ও মথুরার আঞ্চলিক রীতির গান ছিল।

ধামারকে বলা হত হোলি এবং এ গানের অসম ছন্দ—যেটা এর সৌন্দর্য—আসলে স্থানীয় দোল উৎসবেরই ছন্দ। রবীন্দ্রনাথও সম্ভবত এ কথা জানতেন না। কিন্তু তিনি ভিখারি ও মাঝি, ভ্রাম্যমাণ সাধু ও গায়কের গানে এবং সাধারণ মানুষের সমবেত প্রার্থনা বা ভক্তি সঙ্গীতের মধ্যে বহু লোক-সুর শুনেছেন। এই সুরগুলিই এখন তাঁর সহায় হয়ে উঠল।

বর্ষামঙ্গলের (১৯২১) পর থেকেই তাঁর গান হয়ে দাঁড়াল সত্যকার ব্রাত্য—সঙ্গীতের অভ্যজ। অবশ্য এ নয় যে, লোকসঙ্গীত ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সমস্ত মিশ্রণই তৎক্ষণাৎ আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল, এও নয় যে, তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আধারে গান রচনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু অন্ততপক্ষে, সৃষ্টির যে গূঢ় নীতিগুলি, তাদের সঙ্গে নিজেকে অনেকখানি একাত্ম করতে পেরেছিলেন। তাঁর সঙ্গীতের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল।

তৃতীয় পর্যায়েও তাই-ই হয়, উপরন্তু তিনি পুনরাবৃত্তি করেন সমগ্র সঙ্গীতের ইতিহাসেরই। অর্থাৎ, একই জাতীয় সুরকে কেটে বা জুড়ে, অথবা ভিন্নধর্মী সুরের মিশ্রণ ঘটিয়ে তার মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের পুনরুজ্জীবন ঘটান। অবশেষে, মানুষের সামগ্রিক রুচি বা অভ্যাসের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে তিনি মানবীয় সৃষ্টির মূলে যে প্রধান নিয়মগুলি বর্তমান, তাদের মেনে নেন।

যখনই ভারতীয় সঙ্গীত (পাশ্চাত্য সঙ্গীতও) বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়েছে এবং তার বৃদ্ধি ও বিকাশ থেমে গেছে, তখনই সে সাধারণ মানুষের গান ও লোকসঙ্গীত থেকে জীবনদায়ী শক্তি সংগ্রহ করেছে। বঙ্গালি, গুজরাটি, মূলতানি, সৌরাঠি, জৌনপুরি, দেশি ও আরও বহু নামই এ কথাকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করছে।

সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে পার্সী ও তুরস্কের লোকসুরের সঙ্গেও মিশ্রণের কথা জানা যায়। কীর্তন, কাওয়াল, ভজন—প্রকৃতপক্ষে অর্থসঙ্গীতের এই পুরো এলাকাটাই মার্গ (উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এবং দেশি বা লৌকিক সঙ্গীতের মিলনস্থান। যখন ‘রাগ’ বা ‘রাগিণী’র পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ ‘সঙ্গীত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তখন তাঁর অন্তরিন্দ্রীয় তাঁকে ভুল পথ প্রদর্শন করেনি।

সরল লোকসুরের অনুসন্ধান একই তাগিদ থেকে এসেছিল, যা পুরোনোধর্মী নাটকের বদলে তথাকথিত রূপকধর্মী নাটক (ফাল্গুনী) রচনার জন্য দায়ী ছিল। কবিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা সহজ হয়নি, ফলে ১৯২০ সাল থেকেই প্রচেষ্টা চলে (ব্যতিক্রম পুরবী, মহুয়া, প্রবাহিণী) যতদিন না তিনি খুঁজে পেলেন গদ্য কবিতা ও মুক্ত ছন্দ কবিতাকে, যেগুলি পরিণত হল গানে এবং গানগুলি ছিল কবিতা।

১৯২০ ও ১৯৩২ (পুনশ্চ)-এর মধ্যে স্বরলিপিসহ তাঁর গান এগার খণ্ডে প্রকাশিত হয় (রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রটি অতঃপর ইয়েটস-এর থেকে স্বতন্ত্র ছিল, যিনি গানের জন্য কথা রচনা করেছিলেন। ইয়েটস-এর সাঙ্গীতিক কান ছিল ত্রুটিপূর্ণ।) কিন্তু এক অর্থে রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যেই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, যখন তিনি লোককাব্য ও কবিতার ছন্দ ও মিল গ্রহণ করে তার থেকে নতুন কিছু সৃষ্টি করলেন।

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের গান তাই বলে লোকসঙ্গীত নয়, যেমন তাঁর পরবর্তীকালের সাহিত্য লোকসাহিত্য নয়। যুক্তিশাস্ত্রের দিক দিয়ে তা কখনও সম্ভব নয়। অকৃত্রিম সারল্য এবং মার্জিত রুচিশীলতা—দুটি পৃথক ধারায় চলে। কিন্তু যখন এই দুই ধারা পূর্ণ হয়ে ছাপিয়ে পড়ে তখন তারা মিশে গিয়ে সৃষ্টির এক দুর্বার ধারায় পরিণত হয়।

কীসের এই তাগিদ? আবার বলা যায়, এটা মূলত ব্যক্তিত্বের। আমাদের এই রাগ—ষোড়শ শতাব্দী থেকে তাদের যে রূপ আমরা পাই, তা বড় বেশি বিমূর্ত, বড় বেশি অমানবী এবং ব্যক্তিগত আশা ও ভয়, সঙ্কট ও সন্তুষ্টি থেকে বড়ই দূরে। তাদের বাহা শিষ্টাচার যেন ভারতীয় প্রশাসনের মতো।

এর সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই সে একে কখনওই সহৃদয়তার চোখে দেখবে না। সাধারণ মানুষের চিরকালই নিজস্ব সঙ্গীত আছে, যেগুলি প্রধানত ভক্তিমূলক, আনুষ্ঠানিক, ঋতুকালীন, সাম্প্রদায়িক (অবশ্যই র্যামজে ম্যাকডোনাল্ড বর্ণিত অর্থে নয়।), এবং কর্মসঙ্গীত। এই দুই শ্রেণীর সঙ্গীত কখনও পরস্পরের সংস্পর্শে আসে না তা নয়, কিন্তু এরা

প্রধানত দুটি ভিন্নধর্মী ধারা এবং অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই আমাদের এই পবিত্র দেশের শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি এদের মধ্যে ফুটে উঠেছে। লৌকিক বা অর্থসঙ্গীতে একক গায়কের স্থান আছে, কিন্তু তার তাৎক্ষণিক সৃষ্টি কখনওই সম্প্রদায়ের সমবেত সঙ্গীতকে ছাপিয়ে তার প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করে না।

সুতরাং একজন গায়ক ধ্রুপদেই হোক আর সাধারণের গানেই হোক, নিজেকে প্রকাশ করার সম্পূর্ণ সুযোগ কদাচিৎ-ই পায়। একমাত্র ভবঘুরে (বাউল) (peripatetic singer) গায়ক তার দ্ব্যর্থবোধক গানের মধ্য দিয়ে—যা একাধারে শ্রোতা এবং নিজ সম্প্রদায়ের গুরু বা ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত, অনেকাংশে নিজেকে স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজভাবে প্রকাশ করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সমমর্মিতা তার সঙ্গে, তার গানের সঙ্গে, তার গানের ছন্দ ও মিলের সঙ্গে।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বলে পরিচিত মার্জিত হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের সাধারণ ও বিমূর্ত প্রকৃতিকে পরিহারের মধ্যে দিয়েই যেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত বিকাশ লাভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ রচিত গানের বৈশিষ্ট্য হল ব্যক্তির বিশেষ চাহিদা থেকে এদের সূচনা। অবশ্য এখানেই তারা থেমে থাকেনি। এই গানগুলি থেকে আমরা যা খুঁজে পাই তা হল এমন একটা দণ্ড যার একদিকে আছে ব্যক্তি এবং অপর দিকটি সঙ্গীতের ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে গেছে।

একদিক দিয়ে সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে হয়ত লক্ষণ অনুযায়ী অবক্ষয়ের প্রচারক বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তা হলে প্রমাণিত হওয়া দরকার যে, হিন্দুস্থানি সঙ্গীত ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত, সেটা নিছকই অর্থহীন কথামাত্র। একই সঙ্গে আমরা লক্ষ্য না করে পারি না, কোনও এক বিশ্বাস বা মত থেকে উদ্ভূত হওয়া সেই অনিশ্চয়তাকে যার মধ্যে ব্যক্তি ও বিশ্ব মধ্যবর্তী পর্যায়গুলিকে আবৃত করে রাখে, যে পর্যায়গুলিতে গড়ে ওঠে কর্ম ও সম্প্রদায় সঙ্গীত।

সূচনা ও সমাপ্তির নামে এই মধ্যবর্তী পর্যায়গুলি দ্রুত পেরিয়ে যাওয়ার শাস্তি কাউকে না কাউকে পেতেই হবে। এবং ভিন্নজাতীয় বলে রবীন্দ্রনাথের গানগুলিকে বর্ণনা করার মধ্যেই এই শাস্তি নিহিত আছে। অথচ, প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতের—বিশেষ করে হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের উন্নতির যে প্রধান ঐতিহ্যবাহী ধারা, রবীন্দ্রনাথের গান তারই অন্তর্গত। এর চেয়ে ভালভাবে আর কোনও ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথের বিশাল প্রতিভার এমন প্রকাশ আর দেখা যায়নি।

যখনই আমরা এই মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে ধরতে পারি, অর্থাৎ বিমূর্ত ভাবনার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অনীহা এবং মানুষের জন্য, ব্যক্তি ও বিশেষের জন্য তাঁর অনুসন্ধান, আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি কেন তাঁর নাটকগুলিতে এত গানের ব্যবহার, কেন তাঁর গান সব ধরনের মানুষ সব ধরনের মানসিক অবস্থায় গুনগুন করেই হোক আর গলা ছেড়েই হোক (যদিও বেশিরভাগ সময়েই অত্যন্ত বেসুরো) গেয়ে থাকে।

বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী তাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি মানসিক অবস্থা ভাবের যথোপযোগী গান তাঁর রচনা থেকে খুঁজে নেয় বা নিতে পারে।

মনের অবস্থা যতই অস্থির তাঁর গান ততই মধুর। বহু দূরদর্শী সমালোচক তাই মনে করেন যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মে তিনি তাঁর গানের মধ্য দিয়েই অমর হয়ে থাকবেন। অনেক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বোদ্ধা আছেন যাঁদের কানে রবীন্দ্রসঙ্গীত একঘেয়ে লাগে। আমার মনে হয় এর জন্য দায়ী যাঁরা গান করেন গলা চেপে, মুখের হাঁ-টি ছোট করে এক বিচিত্র স্টাইলাইজ্ড ভঙ্গিতে যা ধূর্জটিপ্রসাদের অভিজ্ঞতায় পর্যাপ্ত খেয়ালের তালিমপ্রাপ্তা রাজেশ্বরী দত্ত ও সুচিত্রা মিত্রর উদাত্ত কণ্ঠে পাওয়া যায়নি।

বাকি সকলেই নাকি এই সাঙ্গীতিক ন্যাকামি দোষে দুষ্ট। তাছাড়া এরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত নয়। রাগ ও তাল বদলে একক আসরে গাইলে এই একঘেয়েমি অনেকটাই কেটে যেতে পারে। এখন কপিরাইটের শৃঙ্খল থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুক্ত হয়েছে এবং তার ধ্রুপদী রচনায় বোলবার্ট তেহাই বা সেতারের গং ও খেয়ালের বন্দিশভিত্তিক গানে তানকর্তব করা উচিত কিনা এ প্রসঙ্গ উঠেছে।

রবীন্দ্রনাথের ‘বাকি আমি রাখব না কিছুই’কে আমি ফৈয়াজখানি ঢঙে দাদরায় গাইতে পারি কিন্তু সেটা শুধু রবীন্দ্রভক্তদের কেন, অনেক বাঙালিরই ঔচিত্যবোধে আঘাত করতে পারে। এ সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত মতামতের কোনও মূল্য নেই, অতএব আমি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং দিলীপকুমার রায়ের বক্তব্য থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি ‘সংগীতচিন্তা থেকে।

কবিবর বললেন, তুমি কি বলতে চাও যে আমার গান যার যেমন ইচ্ছা সে তেমনিভাবে গাইবে? আমি তো নিজের রচনাকে সেরকমভাবে খণ্ডবিখণ্ড করতে অনুমতি দেইনি…যে রূপসৃষ্টিতে বাহিরের লোকের হাত চালাবার পথ আছে তার এক নিয়ম, আর যার পথ নেই তার অন্য নিয়ম। মুখের মধ্যে সন্দেশ দাও—খুশির কথা। কিন্তু যদি চোখের মধ্যে দাও তবে ভীমনাগের সন্দেশ হলেও সেটা দুঃসহ। হিন্দুস্থানী সঙ্গীতকার, তাঁদের সুরের মধ্যকার ফাক গায়ক ভরিয়ে দেবে এটা যে চেয়েছিলেন।

তাই কোনো দরবারি কানাডার খেয়াল সাদামাঠাভাবে গেয়ে গেলে সেটা নেড়া নেড়া না শুনিয়েই পারে না। কারণ দরবারী কানাড়া তানালাপের সঙ্গেই গেয়, সাদামাঠা ভাবে নয়। কিন্তু আমার গানে তো আমি সেরকম ফাঁক রাখিনি যে সেটা অপরে ভরিয়ে দেওয়াতে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে উঠব।… গান নানা লোকের কণ্ঠের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে গায়কের নিজের দোষগুণের বিশেষত্ব গানকে নিয়তই কিছু না কিছু রূপান্তরিত না করে পারে না।

ছবি ও কাব্যকে এই দুর্গতি থেকে বাঁচানো সহজ। ললিতকলার সৃষ্টির স্বকীয় বিশেষত্বর উপরই তার রস নির্ভর করে। গানের বেলাতে তাকে, রসিক হোক অরসিক হোক, সকলেই আপন ইচ্ছামত উলটপালট করতে সহজেই পারে বলেই তার উপরে বেশি দরদ থাকা চাই। সে সম্বন্ধে স্বার্থবুদ্ধি একেবারে থুইয়ে বসা উচিত নয়।

এতদ্সত্ত্বেও দিলীপকুমার রায় প্রচুর তর্কবিতর্ক এবং অনুনয়-বিনয় করে রবীন্দ্রনাথের অনুমতি আদায় করে নিয়েছেন ওঁর নিজের ঢঙে তানকর্তব করে গাওয়ার। মেগাফোনে এই রেকর্ডটি শুনে দিলীপকুমার নিজেই সেটিকে বাতিল করে দেন। বহুকাল পরে

কলামন্দিরে এক সভায় উনি চক্ষের জল ফেলতে ফেলতে কম্পিতকণ্ঠে বলেন ‘রবীন্দ্রনাথ আমায় বলেছিলেন, যেখানে যা দেবার ঠিক ঠিক আমি দিয়ে দিয়েছি আমার গানে। বাড়তি কিছু দেবার চেষ্টা করলে উপছে পড়বে। আমি মূর্খ সে কথা বুঝেও বুঝিনি।

এই প্রসঙ্গে আমার শেষ কথা রবীন্দ্রনাথ যে ধারার প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন তারই অনুবর্তী রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ ও নজরুল ইসলাম। এঁদেরও চেষ্টা করলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূলধারা থেকে কোনওমতেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। আর এতগুলি গুণীর সৃজনী উদ্ভাবনী শক্তির সমাবেশ আর ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রদেশে হয়েছে বলে জানি না।

আপাতদৃষ্টিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দায়রা থেকে বেরিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারেই নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা বাংলার বাইরে আর কেউ যে করে সক্ষম হয়েছেন এ খবরও আমার কানে পৌঁছয়নি। মহারাষ্ট্রে নাট্যসঙ্গীত রাগকে কখনও পরিত্যাগ করেনি, ছোটখাটো লিবার্টি হয়ত নিয়েছে, যেমনকি আরোহণে ভীমপলশ্রীতে শুদ্ধ নিষাদ, কখনও বা কোমল ধৈবত ভৈরোতে কোমল নিষাদ, তিলককামোদে কোমল গান্ধার বা কোমল নিষাদ ইত্যাদি।

এর প্রধান কারণ নাট্যসঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে বিরাট বিরাট শাস্ত্রীয় কলাকার সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ভাস্কর বুয়া, রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজে, মিরাসী বুয়া, গোবিন্দরাও টোম্বে ইদানীংকালে বিনায়করাও পটবর্ধন এমনকি উস্তাদ আবদুল করিম। খাঁও যে বাদ যাননি তার প্রমাণ তাঁদের রেকর্ডে রয়েছে। এঁরা শুধু খেয়ালের বন্দিশ মারাঠিতে রচনা করে ক্ষান্ত হননি, তরানা, ঠুংরী, কাজরী, টপ্পা সবই নাট্যসঙ্গীতে পাওয়া যায়।

গায়করাও দস্তুরমত বহুকাল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অভ্যাস করে স্টেজে আসতেন। বালগন্ধর্ব তো প্রবাদপুরুষ ছিলেন। লতার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর, ভীমসেন যোশি ও গঙ্গুবাইয়ের গুরু সওয়াই গন্ধর্ব, মেয়েদের মধ্যে জয়মালা শিলেদার আগ্রা ঘরানার জ্যোৎস্না ভোলে, কিরানার হীরাবাঈ বড়োদেকর আরও বহু উচ্চ ও মধ্যমানের ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের কলাকার মারাঠি স্টেজের মান বাড়িয়েছেন, কিন্তু এঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনও নতুন ফর্ম দেওয়ার চেষ্টা করেননি।

এককালে ফিল্মের জগতে রাইচাঁদ বড়াল, অনিল বিশ্বাস, শচীন দেববর্মন, নৌশাদ প্রমুখ বেশ কিছু ভাল সুর দিয়েছেন গানে, কিন্তু তার কাব্য ও সঙ্গীতের মান ওই উপরোক্ত মনীষীদের রচনার উৎকর্ষে পৌঁছয়নি। পৌঁছলে তা এখন ঘরে ঘরে শোনা যেত।

এবার নিছক কালোয়াতী গানবাজনার সুরত-এ-হাল অর্থাৎ বর্তমান অবস্থার খোঁজখবর নেওয়ার সময় এসেছে। কিছুকাল আগে আই টি সি সঙ্গীত রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন ডিরেক্টর বিজয় কিচলু এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, যাঁরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবক্ষয়ের কথা তোলেন তাঁদের ধারণা সঠিক নয়। এবংবিধ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রসার বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজে ইতিপূর্বে সঙ্গীতের ইতিহাসে দেখা যায়নি।

আর পূর্বাঞ্চলে প্রতিভার ছড়াছড়ি এ নাকি অন্য কোনও প্রদেশ সম্পর্কে বলা যায় না। হয়ত বা উভয় উক্তিই ঠিক, কিন্তু এর সঙ্গে অবক্ষয়ের সম্পর্ক কতটা আছে তা ভাল করে তত্ত্বতালাশ করে দেখতে হয়।

প্রথমেই প্রশ্ন ওঠে গুণাগুণ বিচারের মাপকাঠি কি? কোয়ান্টিটি না কোয়ালিটি? আমার এক প্রিয় শিষ্য হুগলি জেলার শিয়াখালায় থাকে। বছর কুড়ি আগে অর্থাৎ আমার কাছে আসার অব্যবহিত পরে সঙ্গীত প্রভাকর পরীক্ষায় বসেছিল। পরীক্ষক ধ্রুপদ ধামার গাইতে বলায় সে পরিষ্কার উত্তর দিয়েছিল ওসবের সঙ্গে তার পরিচয় নেই।

খেয়াল গাইতে বলায় সে কামোদ গায় এবং বোলবার্ট করে দেখায়। পরীক্ষকদের বক্তব্য ছিল, ধ্রুপদ ধামার না শিখলে বোলাবাট করা যায় না, সেই জন্য। উপরন্তু সে কামোদে গান্ধার দিয়ে বড়হৎ করেছিল, যা মাঝে মাঝে ফৈয়াজ খাঁ সাহেব করতেন এবং আমিও করে থাকি। এটিও পরীক্ষার্থীর স্বপক্ষে যাওয়ার কথা নয়। থিওরিতে কোনও গণ্ডগোল হয়নি। কারণ সেখানে বাঁপাশে খোলা বই রেখে উত্তর দেওয়ার প্রথা বহুকাল ধরে প্রচলিত। ফল: সে পাস করে উইথ ডিস্টিংশন।

তার আর-এক এককালীন ঘনিষ্ঠ সঙ্গীত বিভাকর স্কুল খুলে বসেছে ওই গ্রামেই, সেখানে ধ্রুপদ থেকে পল্লীগীতি সবই শেখানো হয়। আমার ওই উপরোক্ত শিষ্য আমাকে বার বার অনুরোধ করেছে আমার ষোল বছরের পুরাতন রাঁধুনি বাদল রাউলকে ছেড়ে দিতে, তাকে বছরদেড়েকের মধ্যে প্রভাকর পাইয়ে দিতে পারে।

সঙ্গীতবিশারদ হতে গেলে নাকি আরও চার-ছ মাস লাগবে। এই সব পরীক্ষায় ফেল বেশি করলে affiliated সংস্থার বদনাম হয় ও রোজগারে ঘাটতি পড়ে। এই কারণে এই সুচারু প্রথাটির প্রচলন হয়েছে। দেবী সরস্বতী এখন ঘাঘরা পরে জেলায় জেলায় মহা উল্লাসে বানরী নৃত্য করে বেড়াচ্ছেন। অতএব সঙ্গীতের তুমুল প্রসার হয়েছে বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজে। এ তথ্য শতকরা একশ ভাগ সত্য, যাকে বলে জজে মানে এ কথা।

আমাদের দেশে বড় বড় মানুষ জন্মেছেন যাঁরা কখনও কল্পনা করতে পারেননি তাঁদের কৃতকর্মের ফলাফল আখেরে গিয়ে কী দাঁড়াবে। স্বাধীন ভারতে কর্তারা সাজা হুঁকো হাতে নিয়ে যে খেল দেখালেন, ঢেলে সাজতে হলে কী হত ভাবতে শিউরে উঠতে হয়। স্বাধীনতা যে এই চেহারা নেবে এর ছিটেফোঁটা আন্দাজ যদি মহাত্মা গান্ধী করতে পারতেন তো সন্দেহ নেই উনি আমরণ উপবাসে দেহত্যাগ করতেন বা কুতুবমিনারে উঠে ঝাঁপ খেতেন।

জওহরলাল কখনও কল্পনায়ও আন্দাজ করতে পারেননি তাঁর সাধের পাবলিক সেক্টর বছরের পর বছর মন্ত্রীদের জমিদারি হয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার বারোটা বাজাবে। ভাতখণ্ডেজি সম্পর্কে এ কথা আরও বেশি করে খাটে। বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডের বিরাট পাণ্ডিত্য, পরিশ্রম ও তাঁর অবদানের কথা আমি একাধিক জায়গায়। লিখেছি।

রবীন্দ্রনাথ স্কুল-কলেজে সঙ্গীতশিক্ষার সপক্ষে ছিলেন না, কিন্তু নেহাত যদি করতেই হয় তো ভাতখণ্ডের পদ্ধতিতেই করা উচিত এ কথা উনি ‘সংগীতচিন্তা’য় বলে গেছেন এবং লখনউয় ধূর্জটিপ্রসাদকে পোস্টকার্ডের খোঁচায় জর্জরিত করেছিলেন একটি সভ্যভব্য শিক্ষিত ম্যারিস কলেজের পাস করা সঙ্গীতবিশারদ পাঠাতে। ফলে হেমেন্দ্রলাল রায়ের শান্তিনিকেতনে আবির্ভাব হয়, তবে উনি বছর দুয়েকের বেশি টেকেননি।

এঁর ছোট ভাই মালবিকা কাননের পিতা রবীন্দ্রলাল রায় (আমার গানের প্রথম হাতেখড়ি এঁর কাছে, স্বরপরিচয় গোটা দুই লক্ষণগীত ও ধামার) অনেক বছর পরে ওই জায়গায়ই অধ্যাপনা করতে যান। এঁর হাত দিয়েও ওঁর কন্যা ছাড়া ছাত্রছাত্রীমহলে কোনও শিল্পী বা সঙ্গীতবেত্তার জন্ম হয়েছে বলে জানি না।

বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের দুটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এত বছরেও কোনও বড়মাপের শিল্পী (অজয় চক্রবর্তীকে বাদ দিয়ে বলছি, কারণ, আমাদের ধারণা, উনি কোনও প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভ করে শিল্পী হননি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা থেকে সটান ফেরত এলেও উনি এই অজয় চক্রবর্তীই হতেন) তো দূরের কথা একটি সঙ্গীতজগতের মাঝারিমাপেরও স্কলার বা সঙ্গীতবিদ পয়দা করতে পারেনি!

এটা কলকাতা বা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক্সের ক্ষেত্রে হলে কী হত আন্দাজ করুন। রবীন্দ্রভারতী থেকে মাঝে মাঝে এক্সপার্ট হিসেবে আমার ডাক পড়ে, শুনলে মজা পাবেন, যন্ত্রসঙ্গীত বিভাগ থেকে। তবে যতদূর মনে হয় সেখানে এখনও আমার অজ্ঞতার হাঁড়ি হাটে ভাঙেনি।

এবার প্রাইভেট টিউশনের খবর নেওয়া যাক। গুজবে কান ওয়ার পেরিয়ে গেছে তবু কানে আসে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের কাছে আলাদা কোচিং নিলে পরীক্ষায় ভালভাবে পাস করা আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। এটা শুধু অ্যাকাডেমিক্সের ক্ষেত্রেই আবদ্ধ নয়, তবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পরোয়ানা সঙ্গীতজগতে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না।

যাঁরা প্রতিষ্ঠিত শিল্পী তাদের হাতে সময় অত্যল্প, টিউশনির পসার বিরাট। ফলে কেউ পায় মাসে আধ ঘণ্টার শিক্ষা, কেউ মাসে দুবার মিনিট পনের কুড়ি করে, দয়া বেশি হলে সেরকম প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রীকে সপ্তাহে দু’সপ্তাহে একবার করে নিয়ে বসার খবর পেলেও আশ্চর্য হব না। আমাদের কালে উস্তাদের খাস শাগীদরা তালিম পেত রোজই, সকাল-সন্ধ্যা বাড়িতে থেকে তাঁর হুঁকো ভরে, ফাইফরমাশ খেটে, জুতো ঝেড়ে, চাকরবাকরদের খরচ বাঁচাত।

উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ভাস্কররাও বাখলে, রামকৃষ্ণ বুয়া ভাজে, বালকৃষ্ণ বুয়া ইছলকরঞ্জিকর প্রমুখের রোমাঞ্চকর কাহিনী আমার অন্যান্য পুস্তকে পাবেন যে, সে প্রকার মানসিকতা ও আধপেটা ও ঝাঁটালাথি খেয়ে টিকে থাকার ক্ষমতা আজকের দিনে অকল্পনীয় আর সে প্রকার দায়বদ্ধতাও এখনকার গুরুদের কাছে প্রত্যাশা করা অন্যায়।

তবে প্রতিদিন দু বেলা তালিম বছর পনের-কুড়ি পাওয়ার পর প্রতিভাবান ও মেহনতী শাগীদ উস্তাদের পেছনে তানপুরো ধরার অধিকার অর্জন করত। যদি নেহাতই উস্তাদের দয়া হত তো তাঁর নিজের আসরে শাগীদকে সুযোগ দিতেন আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা গাইবার। এইভাবে তখনকার দিনে উস্তাদ তৈরি হত।

এইভাবেই ইদানীংকালেও উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁর কাছে তাঁর ছেলে, জামাই, নাতি, এমনকি রাশিদ খাঁও তৈরি হয়েছে। খাঁ সাহেব বেঁচে থাকলে হয়ত সে আরও তালিম পেত। কারণ শিক্ষার শেষ নেই। এইভাবেই মশকুর আলি খাঁ তার ভাগ্নে আরশাদকে তালিম দিচ্ছে। আমিও আমার চার নম্বর গুরু উদ্ভাদ লতাফত খাঁকে একবার দু মাস আমার বাড়িতে এনে রেখেছিলাম, তখন আমার পঁয়তাল্লিশের ওপর বয়স।

প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা উপ্তাদের সঙ্গে বসতাম অফিস-কাছারি সেরে। আমার কাছে যে দু-চারজন প্রতিভাবান ছাত্রছাত্রী শেখে এই বৃদ্ধ বয়সে দু-দুবার বাইপাস ও নৈবিদ্যির চূড়োর ওপর একটি পেসমেকার নিয়ে আমি তাদের সপ্তাহে তিনদিন ঘণ্টা দেড়েক করে নিয়ে বসি। এ তালিম সে যুগের তালিমের বিকল্প না হলেও কিছুটা ইমানদারির পরিচয় দিতে পারছি এই ভেবেই আমি খুশি। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি অবহিত বিদ্যাদান মহৎ কর্ম, তার মধ্যে ফাঁকি চলে না, আর তা ব্যবসায়ের পণ্য নয়।

আমার পিতা ধূর্জটিপ্রসাদের কাছে শুনেছি বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল পাঁচ বছরে সঙ্গীতের ফান্ডামেন্টালস অর্থাৎ ধ্রুপদ ধামার খেয়াল তরানা, রকম বেরকমের তাল ও মোটামুটি সব মেজর রাগের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এ সে যুগের কথা বলছি, যখন মুসলমান উস্তাদরা নাম-গোত্রহীন শিক্ষার্থীদের বিশেষত ভদ্রঘরের অমুসলমানদের তালিম দিতে একেবারেই নারাজ ছিলেন।

ভাতখণ্ডেজির স্বপ্ন ছিল, মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে সেই শিক্ষার প্রসার করা যা উস্তাদ ও খানদানের প্রকোষ্ঠে সযত্নে আবদ্ধ এবং যা উদ্ধার করে স্বরলিপির সাহায্যে ও ক্লাসে নিয়মিত শিক্ষা দেওয়া। উনি এবং ওঁর প্রধান শিষ্যও ওঁর পাণ্ডিত্য এবং আদর্শের উত্তরাধিকারী শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর এই প্রচেষ্টার পেছনে সঙ্গীতের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ফল গোড়ার দিকে ভালই হয়েছিল।

হেমেন্দ্র ও রবীন্দ্রলাল রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ, পাহাড়ী সান্যাল থেকে শুরু করে ড. সুমতি মুতাটকর, এস সি আর ভাট, কে জি গিঙে, চিদানন্দ নাগরকর, দিনকর কাইকিনি, সুনীল বসু, চিন্ময় লাহিড়ী প্রমুখ এই প্রচেষ্টার সম্মান রেখেছিলেন। ভাতখণ্ডেজি অবশ্য এই শিক্ষাই পর্যাপ্ত বলে বিবেচনা করেননি।

এরপর গায়কির জন্য কোনও বড় উস্তাদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন এ চিন্তা ওঁর মনে সদাসর্বদাই থাকত, নচেৎ উনি ওঁর স্নেহের বাবুরাও অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকরকে প্রথমে গোয়ালিয়র ঘরানার অনত্তমনোহর যোশি, (অন্তু বুয়া, ইনি উল্লাস কশলকরের দাদাগুরু) ও পরে ফৈয়াজ খাঁর কাছে তালিমের জন্য পাঠাতেন না।

গোয়ালিয়র ও আগ্রার গায়কির অসাধারণ মিলন হয়েছিল রতনজনকরের গানে, যা শোনার সৌভাগ্য আমাদের প্রজন্মের পর আর কারও হয়নি। ভাতখণ্ডেজির দূরদৃষ্টি যদি আজকের সঙ্গীতবিশারদ ও সঙ্গীতনিপুণ ডিগ্রিধারীদের অবধি পৌঁছত তো উনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বরাবরের মত জগন্নাথের পায়ে দান করে ওকালতিতে ফিরে যেতেন।

বিষ্ণু দিগম্বরের গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয় থেকেও কোনও নামীদামি গায়ক-গায়িকা বেরিয়েছে মনে করতে পারছি না। ওঁর পুত্র ডি ভি পলুস্কর পিতার মৃত্যুর পর বিনায়করাও পটবর্ধনের কাছে শিক্ষালাভ করেন।

সদিচ্ছার সম্ভার নিয়ে প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর। নাম দেওয়া হয় Bengal Academy of Music ১৮৭১ সালে। প্রথম স্বরলিপি করেন তাঁর গুরু ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। তারপর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়। মহারাষ্ট্রে ভাস্কর বুয়া, বিষ্ণু দিগম্বর ও বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে।

আজ আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি সঙ্গীত শিক্ষার ক্ষেত্র স্কুল-কলেজ নয়। এও বুঝছি যা বরোদায় করিম খাঁ সাহেব ব্যান্ডমাস্টার ফ্রেডলিক সাহেবকে বলেছিলেন— স্বরলিপি তো দেয় আমাদের রাগের ও গানের কঙ্কালটি মাত্র। রক্ত-মাংস ও প্রাণ সঞ্চার করে গায়কের তালিম যা আমাদের oral tradition-এর অন্তর্গত। ইংরেজ স্কুল-কলেজ তৈরি করেছিল কিছু রাজভক্ত উচ্চ কর্মচারী তৈরি করার জন্য বাকি গড্ডলিকা কেরানির পাল।

আমরা সেই নীতি অনুসরণ করে এসেছি গত পঞ্চাশ বছর ধরে। আর সঙ্গীতের ক্ষেত্রে গুরু-শিষ্য পরম্পরার বিকল্প স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা এখন গড়ে ম্যানুফ্যাকচার করছি সঙ্গীতের বাবু, সঙ্গীতের কেরানি। এদের বেশির ভাগেরই ভবিষ্যৎ টিউশনি— Blind leading the blind!

বিজয়কুমার কিচলুর উক্তির দ্বিতীয় ভাগও সম্পূর্ণ না হলেও আংশিক সত্য। এ অঞ্চলে আমদের সুকণ্ঠ ও প্রতিভার অভাব নেই। মারাঠিদের তুলনায় বেশি কী কম বলতে পারব না। এখানে দুটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। একবার গ্রিনরুমে বেগম আখতার গানের আগে হাসি গল্প করছেন, বাঁ হাতের আঙুলে সিগারেট আর ডান হাতে আইসক্রিম।

একজন অনুরাগী ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার গলা খারাপ হয় না? ঠুংরির একহারা তানের মত হেসে বেগম সাহেবা বললেন, ‘গলে থোড়ি গানা গায়া যাতা?? অতএব শুধু সুকণ্ঠের অধিকারী হলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বড় গাইয়ে হবে এ ধারণা সত্য নয়। আমাদের সঙ্গীতের ষাট পারসেন্ট বিদ্যা, বাকি মেহনত প্রতিভা বিচারবুদ্ধি ও এসথেটিক সেনস।

এ ক্ষেত্রে প্রতিভা মানে শুধু গলা ঘোরানো নয় ভাল তালিম গ্রহণ করার ক্ষমতা, ভাল ভাল গান শুনে তার থেকে বাছা বাছা ফ্রেজ, স্বরসমূহের কম্বিনেশন, কিছু হরকং নিজের মত করে তুলে নেওয়ার প্রবৃত্তি এবং এলেম। বাকিটা মেহনত, সাঙ্গীতিক বিচারবুদ্ধি বোধ ও সৎসঙ্গ। এরপর যদি ওপরওলার কৃপা থাকে তো কথাই নেই।

দ্বিতীয় সমস্যা সুকণ্ঠ শুধু হলে চলবে না, না হলেও চলবে। কিন্তু রেওয়াজ করতে হবে প্রথম পর্যায়ে খোলা গলায় শুদ্ধ আকারে। বেশিরভাগ উঠতি বাঙালি গান পাগল ছেলের ভাল লাগে কিরানা, বিশেষ করে আমীর খাঁর গায়কি। ফলে মুখ না খুলে গলা চেপে নকল করতে গিয়ে গলা যায় বুজে, পরে কখনই সুরের মধ্যবিন্দুতে লাগে না।

মাইক্রোফোনের দৌলতে গাইয়ের নিজের মনে হয় খাসা শোনাচ্ছে। অন্যদের মনে হয় ঠিক বেসুরো না হলেও মন ভরে যাওয়ার মতো সুরেলা গলা নয়। সবাই আজকাল মোটামুটি সুরে তালে গায় এ তল্লাটে কিন্তু বড় গাইয়েরা গান একটু বেশি সুরে, তার সঙ্গে সুকণ্ঠের বিশেষ কোনও সম্পর্ক নেই। বাঙালির কাছে মাছই সুখাদ্য কিন্তু ইলিশ চিংড়ির দামটা একটু বেশি।

এরা জানে না আমীর খাঁ চাঁচাছোলা গলায় আকার দিয়ে আগে গাইতেন, যুদ্ধের সময়ে দিল্লি রেডিও থেকে এঁর দশ থেকে পনের মিনিটের প্রোগ্রাম হত, আমরা শুনেছি। উনি নিজেও বলতেন ‘লোহা গরম করনেকে বাদই উসকো শেপ দিয়া যাতা।’ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তাঁর অসাধারণ সুকণ্ঠ নিয়ে জ্ঞানবাবুকে ছেড়ে বড়ে গুলাম আলি খাঁর কাছে গেলেন তখন উস্তাদ গলা শুনে একটিই কথা বলেছিলেন ‘চিল্লাও, গলেকা বজন বঢ়াও।’

প্রসূন বলেছিল আমায় প্রথম দিকে চিললাও চিললাও’ বলে নাকি জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। তা, বড়ে গুলাম আলি খাঁর মতো সুরে বিজ্ঞানসম্মত স্বরক্ষেপণ আমি তো অন্তত শুনিনি। একজন প্রতিষ্ঠিত প্রৌঢ় বাঙালি গায়ক সেদিন হঠাৎ কথায় কথায় বলে বসলেন,

‘তালিম আবার বাঙালি পেল করে?? শুনে চমকে উঠলাম। উনি ধ্রুপদের কথা বলেননি, খেয়াল ঠুংরির কথাই বলছিলেন। কথাটা আমার মনে অনেকদিনই ছিল। খামোখা অশান্তি হবে বলে পূর্বে কখনও লিখিনি। কলকাতা ছিল বাজার। এখানে উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে উদ্ভাদরা মাল বেচে স্বদেশে ফিরে যেতেন।

ব্যতিক্রম কিছু দ্বিতীয় শ্রেণীর উস্তাদ, যথা রামপুরের মেহেদি হুসেন, আশারাফ হসেন, গোয়ালিয়রের কেশব ঢেকনে, ওঙ্কারনাথের ভাই রমেশ ঠাকুর। পণ্ডিত দিলীপচন্দ্র বেদীও নিজে বছর দু-তিন কলকাতায় বসবাস করেছিলেন। কাননবালা ওঁর কাছে নাড়া বাঁধান। ফৈয়াজ খাঁর পিতৃকুল সেকেন্দ্রাবাদ ঘরানার দিল্লিবাসী মজফ্ফর খাঁ বহুদিন কলকাতায় ছিলেন। ইনি মহিষাদলের দেবপ্রসাদ গর্গ ও গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তীর গুরু। আর ছিলেন সারেঙ্গি নওয়াজ বদল খা।

শেষ বাঙালি গায়ক যিনি পর্যাপ্ত মুসলমান উস্তাদের কাছে তালিম পান, তিনি হলেন গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী। মজফ্ফর খাঁ ভিন্ন ইনি শিখেছিলেন কলকাতায় বদল খাঁর কাছে, রামপুরে এনায়েত্ হসেন ও নবাব সাদহ আলি খাঁ-র কাছে। ঠুংরিতে তালিম পান গণপত্রাও ভইয়া সাহেব ও মৌজুদ্দিনের কাছে।

এঁদের সকলের সম্পর্কেই তথ্য পাওয়া যাবে আমার ‘মাহফিল’ নামক পুস্তকে। কিন্তু গিরিজাবাবু এমন অসাধারণ প্রতিভাবান ছিলেন না যে এই বিশাল তালিমের সুযোগ ও সম্ভার নিয়ে সর্বভারতীয় খ্যাতি লাভ করতে পারেন। ওঁর শিষ্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুধীরলাল চক্রবর্তী, তারাপদ চক্রবর্তী, এ টি কানন, বীরেশ রায় প্রমুখ।

শেষোক্ত তিনজন যখন গিরিজাবাবুর কাছে শিখতে যান, তখন তিনি অশক্ত বৃদ্ধ, আসর থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছেন, শেখাতেও বড় একটা পারতেন না। তবে উনিই প্রথম বাঙালি উস্তাদ বা আচার্য, যিনি ভদ্রসমাজের ছেলে ও মেয়েদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে দীক্ষা দেন। তার আগে বাঙালি মেয়েদের কালোয়াতী গানবাজনা শেখা অকল্পনীয় ছিল। আগেই বলেছি, কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের কল্যাণে এ শহর গোড়া থেকেই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় মার্কেট। এই কারণে বহু ভবায়েফ এখানের পাকা বাসিন্দা হয়ে যান।

সেই রাজা রামমোহনের সময়কার নিকি বাই, রাজা রামচন্দ্রের পেয়ারের আশরুন বাই, জোড়াসাঁকোয় গান গেয়েছেন একাধিকবার জিন্নৎ বাই, হীরা বুলবুল, বেগম জান, হিসন বাই, বদ্রে মুনির চৌধুরান, রেহানা সুলতানা, স্বয়ং গহরজান, তাঁর ঘনিষ্ঠ সথী কাঞ্চনবালা ও দুলারি বিবি, গহরের মা বড়ি মালকা, আগ্রার মালকা জান ও মুস্তরী বাই চুলবুল্লে ওয়ালি মালকা, খিদিরপুরের কুলসুম ও জারিনা বিবি নাজমা বেগম, বউবাজারের জদ্দন বাই (নার্গিসের মা) কলকাতার বাজার আলো করে রেখেছিলেন। বাঙালি বাইজির সংখ্যাও কিছু কম ছিল না যাদের মধ্যে আমাদের বাল্যকালের ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া আরও অনেকেরই

নাম করা যেতে পারে। এঁদের পূর্বসূরিদের মধ্যে বিখ্যাত নাম কৃষ্ণভামিনী, বেদানা দাসী, শ্বেতাঙ্গিনী, কিরন্ময়ী, আশ্চর্যময়ী দাসী, যাদুমণি, মানদাসুন্দরী প্রমুখ। তবে ধনী সমাজ এঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজে এঁদের ছায়া মাড়ানোও পাপ বলে বিবেচনা করত। ফলে এঁদের কাছ থেকে তালিম নেওয়া তো দূরের কথা, এঁদের সংসর্গ করা মানেই অভিভাবকদের চক্ষে জাহান্নমের রাস্তা খোলা হয়ে যেত। বাড়ির মেয়েদের তো কথাই ওঠে না।

এখন যেমন গিরিজাদেবী, সিদ্ধেশ্বরী বাই, বেগম আখতারের কাছে তালিম পাওয়া ভদ্র ঘরের মেয়েরা গান গেয়ে অল্পবিস্তর নাম করেছেন, সমাজের এ চেহারা তখনকার দিনে থাকলে তায়েফদের কলকাতায় বসবাসের অনেক ফায়দাই বাঙালি ওঠাতে পারত। আমাদের দুর্ভাগ্য, বাঙালির কপালে ‘রীত কা গানা’র তালিম নেই।

একটি ব্যতিক্রমের উল্লেখ করতে হয় এখানে। অমিয়নাথ সান্ন্যাল, শ্যামলাল ক্ষেত্রী, মৌজুদ্দিনের কাছে গান শিখেছিলেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্রী রেবা মুহুরি বাপের কাছে ছাড়া বড়ি মোতিবাইয়ের তালিম নিয়ে খুবই ভাল গান করেছেন। নাম সেরকম হয়নি যদিও। আমারই উদ্যোগে সত্যজিৎ রায়কে ওঁর গান শোনানোর পর ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে ওঁর জায়গা হয়।

বদল খাঁর প্রিয়তম শিষ্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় এককালে বাঙালিকে মাতিয়েছিলেন। কিন্তু সারেঙ্গি বাজিয়ে গায়কি দিতে পারতেন না। ভীষ্মবাবু নিজের প্রতিভাবলে নিজের একটি গায়কি তৈরি করে নিয়েছিলেন যা তাঁর পূর্বে ও পরের কোনও কলাকারের গানের সঙ্গে মেলে না। বদল খাঁর কাছে যেতেন অনেক বাঙালি গায়কই।

তখন তাঁর বয়স একশর কাছাকাছি। টিকেয় আফিমের গুলি ধরিয়ে ওঁর নাকের কাছে ধরলে উনি ধীরে ধীরে চোখ খুলতেন এবং মাঝে মাঝে চি চি করে অস্থায়ী অন্তরা শোনাতেন। এর থেকে বিশেষ লাভবান হয়েছেন কোনও গাইয়ে এরকম খবর শোনা যায় না। অন্তত পরলোকগত ড. বিমল রায় তাই বলতেন।

রতনজনকর, ম্যারিস কলেজ ও ধ্রুবতারা যোশির কাছ থেকে ভাল তালিম পেয়ে এসেছিলেন চিন্ময় লাহিড়ী। এঁকে কলকাতা-ঢাকা-গুয়াহাটি-লখনউ-পাটনার লোকেরা এককালে চিনত। এঁরও কপালে সর্বভারতীয় খ্যাতি জোটেনি যদিও চল্লিশের শেষভাগে এবং পঞ্চাশের দশকে কখনও কখনও তারাপদ চক্রবর্তীর মতো সুর জমানো গায়কের ওপর টেক্কা মেরে আসর কেড়ে নিয়েছেন এবং বড়ে গুলাম আলি ও আমীর খাঁর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এঁর শিষ্যা পরভীন সুলতানা ও শিপ্রা বসু।

উস্তাদ আমীর খাঁ পাকাপাকি কলকাতায় বসবাস করেননি। উনি প্রথম পঞ্চাশ টাকার প্রোগ্রাম যখন পান লালাবাবুর কনফারেন্সে তখন উনি উস্তাদ এনায়েৎ খাঁর বড় জামাই এবং মাঝে মাঝে এসে কড়েয়ায় শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। পরে বিলায়েৎ খাঁর বড় বোনকে তালাক দিয়ে উনি মুন্নিবাইকে নিকা করে বউবাজারে ছিলেন, তখনও ওঁর নাম হয়নি। কলকাতার সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ তবে উনি হাতেকলমে শিক্ষা দিয়েছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজনকে, যথা: প্রদ্যুন্ন ও পূরবী মুখোপাধ্যায় এবং তাঁদের ভাগ্নী কঙ্কনা

ব্যানার্জি, পাটনায় শঙ্কর মজুমদার ও দিল্লির অমরনাথকে। এঁরাও কেউ ভারতবিখ্যাত হননি। এর প্রধান কারণ উস্তাদ আমীর যাঁর গায়কি আমার মতে অননুকরণীয়, বিশেষ করে তান সর্গম। যে সব সুন্নী শাগীদ ওঁকে ব্যর্থ নকল করে গাইবার চেষ্টা করেন তাঁদের গান বেশিরভাগ সময়েই একঘেয়ে লাগে। একমাত্র উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাই সপরিবারে কলকাতায় ডেরা গেড়েছিলেন।

এঁদের ঘরের গায়কি বাঙালির গলায় বড় একটা বসে না। একমাত্র অজয় চক্রবর্তীর সে এলেম ছিল এবং ইনি জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের পর কিয়ৎকাল মুনাব্বর আলি খাঁর কাছে তালিম পেয়ে বাংলার তথা ভারতের বাইরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অন্য শিষ্য-শিষ্যরা বলা বাহুল্য সে পর্যায়ে পৌঁছতে পারেননি যদিও অল্পবিস্তর নাম প্রসূন-মীরা দম্পতিও এককালে করেছিলেন।

যন্ত্রে সরোদিয়া কওকবা বাঁ ও কেরামউল্লা খাঁ কিছুকাল কলকাতায় ছিলেন এবং শোনা যায়, তাঁরা অত্যন্ত চশমখোর ছিলেন ও টিপে টিপে তালিম দিতেন। ফলে ওঁর ঘরের কোনও বাঙালি শাগৰ নাম । মহম্মদ আমীর খাঁকে রাজশাহীতে রেখে রাধিকামোহন মৈত্র পর্যাপ্ত তালিম পেয়ে নাম করেছিলেন এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে সর্বাগ্রে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর উল্লেখ করতে হয় যাকে দেশে-বিদেশে অনেকেই চেনে। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ অল্পবয়সে কলকাতায় ছিলেন, পরে কখনই নয়।

উস্তাদ আলি আকবর খাঁও পাকাপোক্তভাবে কখনও দীর্ঘকাল থাকেননি। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় থেকেছেন তবে ঊনি সপ্তাহান্তে শনি-রবিবারের তালিমে কোনও বিশেষ সুফল হয় একথা বিশ্বাস করতেন না। একমাত্র কিশোর চক্রবর্তীকে উনি দেশে থাকলে বছর নয়েক তালিম দেন তা সে আমার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও বাইরে বাজায় না। আলি আকবর খাঁর কোনও নামীদামি বাঙালি শিষ্য নেই। ওই একই কথা পণ্ডিত রবিশঙ্কর সম্পর্কে বলতে হয়।

এঁদের বিদেশে বসবাস আমাদের ভারতীয় যন্ত্র সঙ্গীতের উন্নতির অন্তরায় হয়েছে যদিও ওঁদের নকলনবিশের সংখ্যা প্রচুর। একমাত্র উস্তাদ এনায়েত্ খাঁ ও তাঁর সুযোগ্য সন্তান বিলায়েত্ খাঁর প্রভাব এককালে এই অঞ্চলে খুবই পড়েছিল। তার কারণ উনি গৌরীপুর ও কলকাতায় দীর্ঘকাল ঘরবাড়ি করে বসবাস করেছিলেন। ঠিক ওই কারণেই উস্তাদ মসীদ ধাঁর দৌলতে তাঁর সন্তান কেরামং খাঁ ও খ্যাতনামা শিষ্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বহু ভাল ভাল তবলিয়ার জন্ম দিয়েছেন এবং এই ঘরের বাজ শুধু ভারতে নয় সারা পৃথিবীতেই বাজছে।

এইটাই অভাগা বঙ্গদেশের ঐতিহাসিক দুর্বলতা। আমি অবশ্য প্রধানত কণ্ঠসঙ্গীতের কথাই বলছি। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে প্রতিটি ঘরানার বড় বড় উস্তাদ বোম্বাই পুনা কোলহাপুর মিরজ অঞ্চলে ডেরা গেড়েছিলেন। এঁদের নাম করতে গেলে গোলাপজলে কলম ডুবিয়ে নেওয়া উচিত।

জয়পুর ঘরানার জন্মদাতা উস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁ তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের অর্ধেকেরও বেশি কাটান কোল্হাপুর পুনা ও বোম্বাইয়ে। উনি ওঁর জীবদ্দশায় ওঁর তৈরি গায়কি ও ঘরানার রমরমা দেখে গেছেন। ওঁর নামী শিষ্য-শিষ্যাদের মধ্যে পড়েন ওঁর ছেলে মন্জি ও ভূর্জি খা, ভাই হায়দার খাঁ, নিবৃত্তিবুয়া সরনায়েক, কেসরবাই, মোঘুবাই।

প্রশিষ্যদের মধ্যে মনজি খাঁর খাস শাগীদ মল্লিকার্জুন মনসুর, ভুঞ্জি খাঁর তালিমপ্রাপ্ত গজাননরাও যোশি এবং তাঁর শিষ্য উল্লাস কশলকর, হায়দর খাঁর শিষ্য বামনরাও সাদোলিকর, প্রশিষ্যদের মধ্যে পড়েন মোঘুবাইয়ের মেয়ে কিশোরী আমুনকর। সর্দারবাই করদগেকর, লক্ষ্মীবাই যাদব, শ্রুতি সাদোলিকর, পদ্মা তলবালকর এবং আরও দু-চারজন যাঁরা ঠিক এঁদের পর্যায়ের গায়ক-গায়িকা নন।

কিরানার উস্তাদরা বলেন ওই ঘরানার জনক বন্দে আলি খাঁ। কিন্তু বর্তমান খেয়ালের গায়কির চেহারা প্রথম দেন আবদুল করিম খাঁ যিনি ধ্রুপদের আলাপকে বোলবিস্তারে পরিণত করেন। ওঁর আগে গোয়ালিয়রে খেয়ালের বিস্তার ছিল না। উনি যাকে নকল করতেন সেই হদ্দু খাঁর ছেলে রহমৎ খাঁ বিষ্ণুপস্থ ছত্রের সঙ্গে কুরুন্দাড়ে থাকতেন। আবদুল করিম খাঁরও বিবাহের পরের জীবন কেটেছে মিরজ পুনা ও বোম্বাইয়ে।

এঁর কাছে তালিম পেয়েছিলেন বড় ছেলে সুরেশবাবু মানে, মেয়ে হীরাবাই, ভাইঝি রোশনারা বেগম, প্রধান শিষ্য সওয়াই গন্ধর্ব (গঙ্গুবাই, ফিরোজ দস্তুর এবং ভীমসেন যোশির গুরু), কপিলেশ্বরী বুয়া প্রমুখ যাঁরা আজীবন পশ্চিম ভারতে অর্থাৎ মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের হাবলিতে কাটিয়েছেন। কিরানার আর একটি ধারার প্রবর্তক আবদুল বহীদ খাঁও (আমীর যাঁর মানসগুরু) তালিম পান সারেঙ্গি নওয়াজ হায়দর বখ্শের কাছে কোলহাপুরে। হীরাবাইয়ের তালিম সম্পূর্ণ হয় এঁর কাছে।

আগ্রা ঘরানার বিখ্যাত গায়ক নথন খাঁ ডেরা গাড়েন বোম্বাইয়ের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্কে। এঁর সন্তানসন্ততি আবদুল্লা খাঁ, বিলায়েত্ খাঁ, তাঁদের ভাগ্নে খাদিম হুসেন, আনওয়ার হুসেন, লতাফৎ হুসেন, পুত্র ইউনুস হুসেন খাঁ এঁরা সবাই বংশানুক্রমে বোম্বাই শহরে শ’য়ে শ’য়ে মারাঠি ছাত্রদের মধ্যে আগ্রা গায়কির প্রসারের জন্য দাবিদাওয়া রাখেন।

এঁদের ও বিলায়েৎ হুসেনের শালা আজমৎ হুসেনের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই নাম করেছিলেন এককালে। অঞ্জনিবাই লোলেকর, লক্ষ্মীবাই কেলকর, ললিত রাও, জ্যোৎস্না ভোলে, শ্রীমতিবাই নারভেকর মেয়েদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পুরুষদের মধ্যে খ্যাতি পেয়েছেন বিলায়েৎ হসেন খাঁর গাণ্ডাবন্ধ শিষ্য জগন্নাথবুয়া পুরোহিত (গুণীদাস), উল্লাস কশলকরের গুরু গজাননরাও যোশি, রাম মারাঠে, জিতেন্দ্র অভিষেকি, ড. এম আর গৌতম, রমাকান্ত রামনাথকর, সাংবাদিক বটুক দিওয়ানজি।

এঁরা সবাই বোম্বাইয়ের বাসিন্দা ছিলেন এবং এঁরা প্রায় সবাই মারাঠি। বিলায়েৎ হসেন খাঁ ও খাদিম হুসেন খাঁ দুজনেই ভাল শিক্ষক ছিলেন। মারাঠিরা আর সব ঘরানার গায়কির সমান মাহাত্ম্য দিয়েছে আগ্রাকে। বাঙালিরা দেয়নি, তাই ওঁদের সমকক্ষ কলকাতাবাসী আতা হুসেন খাঁর কাছে বড় একটা প্রতিভাবান বাঙালি ছাত্র ঘেঁষেনি।

বাঙালিরা চায় মিষ্টি গলায় মিষ্টি গান। এর ওপর যদি ঘন ঘন শূন্যে ডিগবাজি খাওয়ার কায়দা শেখাতে পারেন তো তিনিই আসল গুরু, আসল উস্তাদ। বিদ্যা আহরণ করার বা কোনও বিষয়ের গভীরে যাওয়ার প্রবণতা বাঙালি অনেকদিন হারিয়েছে। উস্তাদের গলা বা ম্যানারিজম শুধু নকল করে অনেক দূর যাওয়া যায় না।

ভীমসেন যোশি আবদুল করিম বা গুরু সওয়াই গন্ধর্বর গলা নকল করার চেষ্টা করেননি, তাঁদের দেওয়া গায়কি নিজের মতো করে নিয়েছেন। ওঁর কণ্ঠস্বরকেও সুমিষ্ট বলা চলে না, কিন্তু আজ গত তিরিশ বছর ভারতের এক নম্বর পোজিশন থেকে কেউ ওঁকে হটাতে পারেনি।

গোয়ালিয়রের হদ্দু খাঁ সাহেব বলতেন আমি মুসলমানদের শেখাব না। আমি শেখাব আর তারা বলে বেড়াবে আমি বাপ-চাচার কাছে শিখেছি। আমি শেখাব ব্রাহ্মণদের কারণ তারা তেজ দিমাক, বুদ্ধি তাদের সবচেয়ে বেশি। সিন্ধিয়া হোলকর ও গাইকোয়াড় মহারাজদের আমলে গোয়ালিয়র, ইন্দোর, বরোদায় মারাঠি ব্রাহ্মণদের অভাব ছিল না।

এই কারণেই নিজের পরিবার ও আত্মীয়দের বাইরে হদ্দু খাঁর নামকরা শিষ্যদের মধ্যে পড়তেন সার্কাস ম্যানেজার গায়ক বিষ্ণুপস্থ ছত্রে। বাবা দীক্ষিত, অন্ধ বা বালকৃষ্ণবুয়া সিনিয়র, বাসুদেবরাও যোশি, দেবজি বুয়া প্রমুখ। এঁদের কাছে শেখেন যাঁরা তাঁরাও মারাঠি এবং এঁদের দৌলতে গোয়ালিয়র গায়বিই সবচেয়ে আগে ছড়িয়ে পড়ে মহারাষ্ট্রে।

হন্দু খাঁ ছাড়াও বড়ে নিসার হুসেন খাঁর শিষ্য রামকৃষ্ণবুয়া ভাজে। ইনি এবং যাদের চেষ্টায় ওই অঞ্চলে গোয়ালিয়র গায়কি জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁরা হলেন প্রধানত বালকৃষ্ণবুয়া ইছলকরঞ্জিকর এবং তাঁর শিষ্য বিষ্ণু দিগম্বর। এঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যদের মধ্যে অনেক নামীদামি গায়ক হয়েছেন।

বিষ্ণু দিগম্বরের শিষ্য ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, বিনায়করাও পটবর্ধন, নারায়ণরাও ব্যাস, বিষ্ণু দিগম্বরের পুত্র ডি ভি পলুস্কর। বালকৃষ্ণবুয়ার শিষ্য অনত্তমনোহর যোশি (অস্ত্র বুয়া) গুরুর কাছে পর্যাপ্ত তালিম পেয়ে রহমৎ খাঁর পেছনে চার বছর তানপুরা ধরেছিলেন যদিও রহমৎ খাঁ কাউকে শেখাননি, অন্তবুয়াকেও নয়।

এঁরই পুত্র গজাননরাও যোশি এবং তাঁর শিষ্য আজকালকার উঠতি খ্যাতনামা গায়ক উল্লাস কশলকর যিনি ওঁর গুরুর মতো জয়পুরেরও তালিম পেয়েছেন। আজ তিনি কৃষ্ণরাওশঙ্কর পণ্ডিতের পরিবারদের পাশে গোয়ালিয়র ঘরানার অন্যতম ধারক এবং বাহক।

পাঠক এবার খানিকটা আন্দাজ করতে পারবেন আমি শহর কলকাতাকে মার্কেট বা বিক্রয় কেন্দ্র এবং বোম্বাইকে কণ্ঠসঙ্গীতের চর্চা কেন্দ্র কেন বলেছি, বোম্বাইয়ে এবং শহরতলির প্রতিটি মহল্লায় একটি সঙ্গীত সংস্থা আছে। তাদের বেশিরভাগই নিজস্ব হলঘর আছে, মাটিতে সতরঞ্চি পেতে তক্তাপোষের ডায়াসের সামনে বসে তারা রাত ভোর মন দিয়ে গান শোনে, এবং সব ঘরানার ভাল গায়ক এ শহরে কল্কে পায়।

আধ নিবন্ত আলো-অন্ধকারে হলে বসে যে ভাল গান হয় না, আমাদের গান-বাজনা যে chamber music এ তথ্য মারাঠিরা বোঝে। কলকাতায় এ ধরনের সংস্থা মুষ্টিমেয়, স্বল্পায়ু এবং নামকরা আর্টিস্ট না হলে সেখানে শ্রোতাদের ভিড় হয় না। আর সব ঘরানার গায়কিও বাঙালির খুব পছন্দসই নয় যার মধ্যে গোয়ালিয়র ও আগ্রা আগেভাগে পড়ে।

এ সমস্যার সমাধান কি এ তল্লাটে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের মধ্যে মিলবে? এর আংশিক সমাধান করার প্রচেষ্টা হয়েছিল আই টি সি-র সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমির দ্বারা কলকাতায় গুরুকুল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করার। ১৯৭৮ সালে বেশ ক’জন বড় বড় উস্তাদ ও কয়েকটি বাছা বাছা ছাত্র নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্টের সূচনা হয়।

এ সংস্থা থেকে বেরিয়েছেন রাশিদ খাঁ, অজয় চক্রবর্তী, অরুণ ভাদুড়ী, বিজয়া যাদব, শুভ্রা গুহ প্রমুখ। অবশ্য অজয় চক্রবর্তী জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও মুনব্বর আলি খাঁর কাছে তালিম পেয়ে এসেছিলেন, উনি আকাডেমিতে ওঁর ঘরানার উস্তাদদের টেপ শোনবার এবং অফুরন্ত রেয়াজ করার সুখসুবিধা পেয়েছিলেন, কারও কাছে তালিমের নয়।

আর নিসার হুসেন খাঁর শিষ্য রাশিদ খাঁ আকাডেমি না থাকলেও যেমন গাইছেন এইরকমই গাইতেন, ঠিক যেমন কৌশিকী চক্রবর্তীর গানের শিক্ষা আকাডেমির স্কলারশিপের ওপর নির্ভর করে না। তবে উপরোক্ত গায়ক-গায়িকাদের সঙ্গীতের বাজারে পেশ করার কৃতিত্ব নিশ্চয়ই আকাডেমিরই। বর্তমানে সে সব নামকরা শুরু পরপারে।

সহসওয়ানের ইশতিয়াক হুসেন, নিসার হসেন খাঁ, আগ্রার লতাফৎ হুসেন ও ইউনুস হসেন খাঁ, জয়পুর ঘরানার নিবৃত্তিবুয়া সরনায়েক, কিরানার হীরাবাই বড়োদেকর আর আমাদের মধ্যে নেই। গিরিজাদেবী বেশ কিছুকাল পূর্বেই আকাডেমি ত্যাগ করে কাশীবাসিনী হয়েছেন। আকাডেমিতে কেন, আজ হিন্দুস্থানে উস্তাদ কোথায়? ছাত্ররও মান পড়ছে এবং এর পেছনে আর্থ-সামাজিক ব্যাখ্যা আছে। শুধু বাঙালির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। সে প্রসঙ্গে পরে আসব।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে, একটু ভাল করে ঠাহর করে দেখা যাক।

১. আমাদের পরম্পরা গুরুশিষ্যের, oral tradition নিছক ছাপানো বই ও স্বরলিপির ওপর নির্ভর করে সঙ্গীত প্রভাকর, সঙ্গীত বিশারদ, বি মিউজ ও এম মিউজ হওয়া যায়, performing artist হওয়া যায় না। ওগুলো তালিমের বিকল্প নয়। সাচ্চা তালিম দেওয়ার যোগ্য সারা ভারতবর্ষে প্রকৃত উস্তাদ বা গুরুর সংখ্যা মুষ্টিমেয়। যে সব উস্তাদ পরপারে চলে গেছেন তাদের সন্তানরা সঙ্গীতের জগতে আদৌ প্রবেশ করেননি, এক-আধজন ছাড়া।

ঘরানাদার গাইয়ের সন্তানরা গানবাজনা না করে খুচরো চাকরি করবে কাচের বাসনের দোকান দেবে, ঝুরো ব্যবসায় দালালি করবে এ আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। ঘরানা সঙ্গীত বিপন্ন হওয়ার ফলে সকলের গায়কিই মোটামুটি একইরকম শোনাচ্ছে। এ অঞ্চলে একটি standard format এখন চালু হয়েছে। ভাতখণ্ডের বই খুলে আরোহী-অবরোহী দেখে তথাকথিত মীরখণ্ডী বিস্তার, তারপরই সার্গমের ছাড়াছড়ি এবং শেষ ওই সার্গমেরই তান দিয়ে।

ওড়ানো গান বলে সুরপ্রয়োগও একইরকম শোনায়। সব কলার মধ্যে সঙ্গীতেই ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে প্রতিফলন হয়। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ গানই সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বহীন। তবে এ যুগটা personality-র যুগ নয়। তবলার বাজও unisev বেশভূষার মতো ধীরে ধীরে একই রকম হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

২. ধ্রুপদ ধামারের মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে আপসোস করে লাভ নেই। আগে খেয়ালিয়ারা ধ্রুপদ শিখত এবং গাইত। ধ্রুপদের বৈশিষ্ট্য আলাপে এবং ধামারের বোলবার্ট ও লয়কারীতে। সুকণ্ঠ খেয়ালিয়া যদি রাগবিস্তার করতে পারে তো তাদের আলাপ করতে আপত্তি কি?

আলাপই তো আমাদের রাগ সঙ্গীতের মুখ্য ও সবচেয়ে আকর্ষক অংশ। সুকণ্ঠ খেয়ালিয়ারা যদি ধ্রুপদের দিকে ঝোঁকেন তো তাঁদের শিষ্য-শিষ্যাদের স্বরপ্রয়োগে মীড় সুতের ব্যবহার আসবে, ঠাহরান আসবে এবং একটা সুদূর সম্ভাবনা আছে খেয়ালে মুড়কির ও হালকা পাঞ্জাবি হরকতের ব্যবহার কিছুমাত্রায় কমবে। আমাদের বাল্যকালেও ঠুংরির মুড়কি খেয়ালে ব্যবহার করলে গায়ককে কান ধরে আসর থেকে তুলে দেওয়ার মতো কট্টর সমঝদার লোকের অভাব ছিল না।

৩. ধ্রুপদ ধামারের সঙ্গে বন্দিশভিত্তিক খেয়ালও এ অঞ্চলের বাঙালি উঠতি গাইয়ের মুখে বড় একটা শুনতে পাই না। ধ্রুপদ ধামারের মতই খেয়ালের বন্দিশের মধ্যে রাগের রাস্তাঘাট প্যাক করে দেওয়া আছে। অতএব যত ভাল বন্দিশ এবং পুরনোকালের গান শোনা যায় এবং জোগাড় করা যায়, ততই রাগের বিভিন্ন ফ্রেজের সঙ্গে শিক্ষার্থীর মাধ্যমে পরিচয় ঘটবে।

বাজনার ক্ষেত্রেও ওই একই কথা খাটে এবং বাজিয়েকে এই কারণে অবশ্যই গান শিখতে হয়। বিলায়েৎ খাঁ, আলি আকবর খাঁ, পণ্ডিত রবিশঙ্কর এই প্রকার অনুশীলনের ব্যতিক্রমী নন। আমার উস্তাদরা বলতেন, ‘বন্দিশকো চিপককে গাও’ অর্থাৎ বন্দিশকে কেন্দ্র করে ক্রিকেটের ভাষায় গায়কের ইনিংস রচনা করা উচিত তবেই রাগরূপ ও রাগভাব প্রতিষ্ঠিত হবে।

৪. আজকের দিনে ঘরানা সঙ্গীত যে বিপন্ন হবে তা নিয়ে আক্ষেপ করা অসমাজতাত্ত্বিক। প্রথমত ঘরানা সঙ্গীতের তালিম দেওয়ার গায়কের অভাব। দ্বিতীয়ত, রেডিও টিভি কনফারেন্স ইত্যাদির যুগে অনবরত cross fertilisation-এর কারণে সব ঘরানার গায়কিরই খাঁটি চেহারাটি ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে কিরানার বিস্তারের ধড়ে পাতিয়ালার মুণ্ডু চাপিয়ে গান বেশ কিছুকাল ধরেই শোনা যাচ্ছে। এর কারণ ইদানীং বড়ে গুলাম আলি খাঁ এবং আমীর খাঁই সঙ্গীত জগৎকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। তাঁদের তালিমপ্রাপ্ত গায়ক অত্যক্ষ, সুন্নী শাগীদ অসংখ্য। তবুও বলতে হয় এঁদের গুণে যাঁরা মানুষ হয়েছেন তারাও এখন প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েছেন। এখনকার প্রজন্ম তাঁদের পরিবর্তে কাদের শুনে নকল করার চেষ্টা করছে একবার কল্পনা করে দেখুন।

প্রশ্ন উঠতে পারে ঘরানার আজকের যুগে প্রয়োজন আছে কি? আমি মনে করি আছে, তালিমের জন্য। আমি ইতিপূর্বে অন্যত্র লিখেছি যে সব ধর্মের মতো সব ঘরানার মূলতত্ত্ব একই। তফাত শুধু শব্দতত্ত্বে—স্বরপ্রয়োগে, স্টাইল বা ম্যানারিজমে। কিন্তু এই মূলতত্ত্ব অর্থাৎ লয়বদ্ধ গায়কি, বন্দিশ মাহাত্ম্য, খেয়ালের বিভিন্ন অঙ্গগুলি বোঝাবার এবং শেখবার জন্য ঘরানাদার উস্তাদের কাছে বা তাঁদের প্রকৃত শিষ্যদের কাছে তালিমের প্রয়োজন।

শুনতে পাই অজয় চক্রবর্তী বলেন যে উনি ঘরানা মানেন না, অথচ ওঁর খেয়াল ও ঠুংরির গায়কি ওঁর দাদাগুরু উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁর গায়কির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। ওঁর সে প্রতিভা অবশ্যই আছে, উনি ইচ্ছে করলে বিভিন্ন গায়কির ভাল ভাল জিনিস নিজের মতো করে নিয়ে ওঁর গায়কিকে সাজাতে পারেন। কিন্তু ওঁর মূল কাঠামো পাতিয়ালারই থাকবে এবং তাকে উনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

এ কর্ম অনেকেই করেছেন ভাস্কর বুয়া, শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর, নিসার হসেন খাঁ, আমীর খাঁ এবং আরও অনেকে। কিন্তু আমি মনে করি তালিমের জন্য প্রাথমিকভাবে কোনও ঘরানাদার গায়কিকে আশ্রয় করা অবশ্য প্রয়োজনীয়। অতএব আজকের দিনে ঘরানা বা খানদান নিয়ে মারামারি করার যেমন প্রয়োজন দেখি না ঠিক সেইরকমই কোনও ঘরানার গায়কিকেই বা ঘরানাদার গানের আবশ্যকতাকে নস্যাৎ করাটাও বোধহয় উচিত হবে না।

৫. আমাদের হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয়ের আর একটি নিদর্শন আজ হারমোনিয়মের জনপ্রিয়তা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলা’য় লিখছেন ‘তখন হারমোনিয়াম আসেনি এ দেশের গানের জাত মারতে। কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কল টেপা সুরের গোলামি করিনি।’ পরবর্তীকালেও উনি ওঁর গানের সঙ্গে এসরাজ বাজানোই পছন্দ করতেন।

আমাদের সঙ্গীতের দুটি স্তম্ভ — মীড় ও শ্রুতি, যা জগতের অন্যান্য সঙ্গীতের সিস্টেম থেকে ভারতীয় সঙ্গীতকে পৃথক করে দিয়েছে। এই কারণে শ্রীকৃষ্ণ রতনজনকর উদ্যোগ নিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী কেকর সাহেবকে বলে হার্মোনিয়ামকে নির্বাসন দিয়েছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে।

এ সেই জওহরলাল নেহরুর আমলে যিনি সভাসমিতিতে দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে হার্মোনিয়াম বাজে বলে ওই যন্ত্রটিকে পদাঘাত করার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। অথচ আজ ওই মীড় ও শ্রুতিবিহীন বিদেশি বেজন্মা যন্ত্রটি মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের সব গায়কের সঙ্গে বাজছে এমনকি ধ্রুপদীদের সঙ্গেও!

বিশ-তিরিশ বছরে মনে হয় এই হার্মোনিয়ামের কল্যাণে কাফির, নায়কী কানাড়া দরবারী ও মিয়ামহলালের কোমল গান্ধার সব একাকার হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে ভৈরোর, তোড়ীর ও মারবার কোমল রেখাবও। কণ্ঠসঙ্গীতের সবচেয়ে কাছাকাছি আসে সারেঙ্গি। আই টি সি সঙ্গীত রিসার্চ আকাডেমিতে শুধু কণ্ঠসঙ্গীতেরই তালিম ও চর্চা হয়।

আজ গত বাইশ বছরে আমি এই সংস্থার কর্তাদের রাজি করাতে পারিনি একজন সারেঙ্গিয়াকে মোতায়েন করতে। এই অপূর্ব যন্ত্রটির প্রসারের জন্য তাঁদের চেষ্টাচরিত্র করা তো দূরের কথা।

৬. ভারতীয় সঙ্গীত, বিশেষত যন্ত্রসঙ্গীত এখন রপ্তানির সামগ্রী। যাঁরা হোম উইকেটে রান পান না তাঁরা ইউরোপ আমেরিকায় প্রতি বছর সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরি করেন। এইরকম শুনতে পাই। রবীন্দ্রসঙ্গীত বাংলা গান থেকে ঠুংরি গজল গায়ক এবং মধ্যমানের তবলিয়া সরোদ সেতার বাজিয়ে মনমোহন যশোবন্ত সিংহের প্রফুল্ল মন প্রফুল্লতর করার চেষ্টায় ভূপর্যটনে ব্যস্ত। যন্ত্রসঙ্গীতের ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর ত্রিমূর্তিই মার্কিন দেশে বাড়িঘরদোর গুছিয়ে বসে আছেন, বৎসারান্তে দেশে পদার্পণ করেন।

ফলে কেন্ জুকারম্যানের মতো এক-আধজন ফিরিঙ্গি বাজিয়ের নাম শোনা যায়। কিন্তু দেশে পণ্ডিতজি এবং খাঁসাহেবদের মান রাখতে পারবে এমন শিষ্য-শিষ্যা কজন এবং কোথায়? কণ্ঠসঙ্গীতের ঘরানাগুলির দিকে পাঠক একবার চেয়ে দেখুন। নথ্থন খাঁ ফৈয়াজ খাঁর আগ্রা ঘরানা বর্তমানে শ্মশান।

সবচেয়ে প্রাচীন গোয়ালিয়রকে টিম টিম করে বাঁচিয়ে রেখেছেন পণ্ডিত পরিবার ও অবশ্যই উল্লাস কশলকর। সহসওয়ানের রাশিদ খাঁ তাঁর সুকণ্ঠ ও তানের জন্য নাম করেছেন কিন্তু তাঁর উস্তাদের গায়কির অনেক বৈশিষ্ট্যই ওঁর গায়কিতে হারিয়ে গেছে, যথা বহুলাওয়া বোলবাট ছন্দের কাজ, বরাবর লয়ের তান সার্গম যা পদে পদে আগ্রার ঘরানাকে মনে করিতে দিত। আর ওঁর খানদান রওশন করবার মতো প্রতিভাও আর চোখে পড়ছে না।

জয়পুর ঘরানা এখন দুজনের হাতে, আমার প্রিয় গায়ক উল্লাস কশলকর ও কিশোরী আমুনকর। এই ভদ্রমহিলা পর্যাপ্ত তালিম। মার কাছ থেকে পেয়েছেন। ওঁদের গায়কিতে বিস্তার ছিল না সে অভাব উনি পূর্ণ করেছেন বটে কিন্তু কুমার গন্ধর্বর রাগ নিয়ে যথেচ্ছাচারিতার প্রভাব ও বলিউডের ভূত যখন ওঁর স্কন্ধে চাপে তখন এতবড় প্রতিভার এই দশা দেখে হাসব কী কাঁদব বুঝে পাই না।

পাতিয়ালার রেজা আলি খাঁ এখন জার্মানিতে থাকেন আর এ ঘরানার উত্তরসূরি অজয় চক্রবর্তী যত ভালই গান, তিনি স্বীকার করবেন তিনি নিশ্চয়ই বড়ে গুলাম আলি খাঁ নন। গম্বুবাইকে বাদ দিলে কিরানার পণ্ডিত ভীমসেন যোশি, আবদুল করিম খাঁ, সওয়াই গন্ধর্বর পরম্পরা একা গত তিরিশ বছর ধরে সামলাচ্ছেন এবং ভারতের এক নম্বরের জায়গা থেকে ওঁকে কেউ হটাতে পারেনি, কিন্তু ওঁর পরে কে?

কিরানার অন্য ধারাটির প্রবর্তক উস্তাদ আবদুল বহীদ খাঁর উত্তরসুরি তাঁর ভাইয়ের নাতি মশকুর আলি খাঁর কাছে প্রত্যাশা করা যায় না উনি বহীদ খাঁ বা আমীর খার মান পুরোপুরি রাখতে পারবেন।

একালের যে সব গায়কের নাম করলাম তাঁরা সকলেই ভাল গান করেন কিন্তু গোয়ালিয়ারর হদ্দু খাঁ, রহমত খাঁ, বালকৃষ্ণবুয়া ইছলকরঞ্জিকর, রামকৃষ্ণবুয়া ভাজের, বিষ্ণু দিগম্বর আগ্রার নথন খাঁ, আবদুল্লা খাঁ, ভাস্করবুয়া, ফৈয়াজ খা—কিরানার আবদুল করিম ও তাঁর সন্তানেরা –

সুরেশ বাবু মানে, হীরাবাই বড়োদেকর, ভাইঝি রোশনারা বেগম–জয়পুরের আল্লাদিয়া খাঁ, মনজি খাঁ, কেশরবাই, মোঘুবাই, মল্লিকার্জুন মনসুর, পাতিয়ালার আলিয়া ফতু, কালে খাঁ, বড়ে গুলাম আলি থা—এঁদের তুলনায় আজকের প্রতিভাবান গায়করা কোন পর্যায়ে পড়েন তার হিসেবনিকেশ একমাত্র আমাদের বয়সী শ্রোতা ও গায়করাই করতে পারেন।

৭. শ্রোতাদের মান বেড়েছে কি? আগে যারা সঙ্গীতসভায় বা কনফারেন্সে যেত তারা শুনতে যেত দেখতে বা দেখাতে নয়। সারা বছরে কলকাতায় তিনটি বড়মাপের কনফারেন্স হয়—আই টি সি এস আর-এর, ডোভার লেন ও রাজ্য সঙ্গীত আকাদেমির সঙ্গীত সম্মেলন। প্রথম দুটিতে বেশিরভাগ লোকই যান সেইপ্রকার মেজাজ ও মানসিকতা নিয়ে যেন বৎসরান্তে মেলা দেখতে যাচ্ছেন।

রাতভর গল্পগুজব, চপ, কাটলেট, ঘন ঘন চা-কফি এবং ফাঁকে ফাঁকে কিছু চেনা-অচেনা আর্টিস্টের গানবাজনা। দিল্লি অঞ্চলে টিকিট করে সম্মিলনী বড় একটা হয় না, তাই তার নেমন্তনপত্তর স্টেটাস্ সিম্বলের পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের বাল্যকালে উদ্ভাদরা পরস্পরের গান কনফারেন্সে শুনতেন। মীরাট, সীতাপুর, উনাও, কানপুর, এলাহাবাদ শহরে হলের বা শামিয়ানার বাইরে তাঁবু পড়ত, নিমন্ত্রিত আর্টিস্টরা সবাই সেইখানে বাক্সপ্যাটরা যত্তর নিয়ে উঠতেন।

এখন বহু আর্টিস্ট পকেটে প্লেনের রিটার্ন টিকিট নিয়ে স্টেজে ওঠেন, অন্য আর্টিস্টের শোনার ধৈর্য বা সময় তাঁদের কোথায়? অতএব কনফারেন্সের গানবাজনার মান পড়া স্বাভাবিক। ওয়ান ডে ক্রিকেটে যেমন 4 আর 6 লেখা বোর্ড নিয়ে দর্শকরা লাফায়, নয়নাভিরাম কপিবুক স্ট্রোক আর ব্যাটের খোঁচায় Streaky বাউন্ডারির মূল্য তাদের কাছে সমান, কনফারেন্সেও হাততালিটা ওঠে কখন বিদগ্ধ পাঠক দয়া করে লক্ষ্য করে দেখবেন।

৮. অনেকে বলেন, সঙ্গীতের এই অবক্ষয়ের কারণ কমার্শিয়ালাইজেশন। এই কথাটির অর্থ কি তা সঠিক বুঝতে হবে। গান-বাজনা করে টাকা রোজগার তো উস্তাদরা বহুকাল থেকেই করে আসছেন। আবদুল করিম খাঁ হল ভাড়া করে আট আনা মূল্যের টিকিট বেচে সপরিবারে পুত্র-কন্যার ও নিজের গানের আয়োজন করতেন। তফাত শুধু এই তাঁরা নিছক টাকার জন্য গান করতেন না।

পৃষ্ঠপোষক রাজা মহারাজা নবাবরা খুশি হয়ে যে প্রকার নজরানা দিতেন তার কিছুটা আন্দাজ আমার ‘মাহফিল’ পুস্তকে পাবেন। তখনও দরাদরির প্রচলন হয়নি। তিন লাখের নিচে তানপুরো ছোঁব না বা পাঁচ’ছ লাখের নিচে সেতার, সরোদের তার মিলবে না এ রেওয়াজ ছিল না।

পুঁটলিতে কড়কড়ে নোটের তাড়া নিয়ে বসে দায়সারা গান-বাজনা অনেক শুনেছি, এখন বৃদ্ধ বয়সে সে শখ আর নেই। মনে আছে আমার ছাত্রাবস্থায় ফৈয়াজ খাঁ সাহেবকে আমাদের সার্কলে ১০০ টাকায় প্রোগ্রাম কবুল করিয়েছিলাম, দিতে পেরেছিলাম ৬৯ টাকা। উনি পকেট থেকে শুনে শুনে ৩১ টাকা আমার হাতে দিয়ে পুরো একশ টাকা ফেরত দেওয়ার সময়ে বলেছিলেন ‘শেষকালে কি ছেলে-ছোকরাদের জেবখরচা নিয়ে গান শুনিয়ে দোজখে যাব?

কমার্শিয়ালাইজেশনের অন্য অর্থ যদি হয় হালকা চটুল গান গেয়ে পাঞ্জাবি হরকত্ ও মুড়কি-বহুল খেয়াল ঠুংরি শোনানো তা সে কর্ম তো বড়ে গুলাম আলি খাঁ করেছেন। বর্তমানে পণ্ডিত যশরাজের খেয়ালে উপরোক্ত অঙ্গ, অর্থাৎ ঠুংরি, ভজন গীত সব কিছুই পাওয়া যাবে। আবদুল করিম খাঁ ঠুংরি ভজন নাট্যসঙ্গীত গাইতেন, ফৈয়াজ খাঁ একই আসরে ধামার থেকে শুরু করে ঠুংরি দাদরা এমনকি গজলও আমাদের শুনিয়েছেন, তাতে তো তাঁদের সঙ্গীতের মান কিছু পড়েনি।

এক মুশতাক হুসেন খাঁ, আবদুল বহীদ খাঁ ও আমীর খাঁ এই প্রকারের কোনও আপস করেননি, তাতে তাঁদের সমঝদার শুধু নয়, জনপ্রিয়তাও কিছু কমেনি। শ্রোতাদের যা সিস্টেম্যাটিকালি গেলানো হবে তারা তাই কিছুদিন পরে চাইবে। এরজন্য দায়ী উদ্যোক্তাদের ও আর্টিস্টদের বিবেক ও ইমান। আর্টের ক্ষেত্রে অর্থগৃধ্নতার স্থান নেই, আর্ট নিছক ব্যবসায়ের পণ্য নয়।

৯. কেউ একজন দেখলাম লিখেছেন, বর্তমান সঙ্গীতের এই হালের পেছনে কোনও আর্থ-সামাজিক কারণ নেই, দায়ী সরকার। স্বাধীনতার পূর্বের নবাব রাজা বাদশার স্থান নেওয়া উচিত গভর্নমেন্টের। সরকারের হাতে আছে আকাশবাণী ও দূরদর্শন। শেষোক্ত সংস্থা খেলাধুলো ও তৃতীয় শ্রেণীর নাটক দেখাবার জন্য তৈরি হয়েছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও এককালে উচ্চাঙ্গ শুধু নয়, সকল প্রকার সঙ্গীতের এবং বড় মেজ ছোট

সর্বপ্রকারের আর্টিস্টের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। বর্তমানে রেডিও ও টিভির গলায় প্রসার ভারতীর দুটি বকলস বেঁধে দিয়ে সরকার বলছে মনিবের অন্ন ধ্বংস না করে চরে খেতে। ফলে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের কোটা তলানিতে এসে ঠেকেছে, যাঁরা এককালে রেডিওয় প্রতিমাসে প্রোগ্রাম পেয়েছেন, তাঁরা এখন তিন মাসেও একটা পান না এবং পেলে চেকের জন্য হাপিত্যেশ করে মাসের পর মাস বসে থাকতে হয়।

বেসরকারীকরণ এবং মুনাফার ধুয়ো ওঠার ফল এখন শুনছি আর্টিস্টদেরও নাকি স্পনসর ধরতে হবে ও বিজ্ঞাপনের জোগাড় দেখতে হবে। সরকার মানে তো আমলাতন্ত্র, সর্ববিষয়ে তাঁরা জ্ঞানী এবং তাঁদের হাতে পৃষ্ঠপোষকতা ছেড়ে দিয়ে কী হয় তা শুধু এই রাজ্যে নয়, ভারতের সর্বত্রই দেখতে পাচ্ছি। আর প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই একটি করে সরকারি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি আছে।

বছর ছয়েক আগে শেষবারের মতো গান করতে মুম্বই যাই। আমার এককালীন যুগলবন্দীর পার্টনার ভারতীয় বিদ্যাভবনের সঙ্গীত বিভাগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দিনকর কৈকিনীকে বলি ‘খানতিনেক প্রোগ্রাম আছে তোমার সাকরেদদের মধ্যে গোটা দুয়েক বেছে দিতে পার যারা তানপুরো ধরবে, গলা দেবে এবং মুখড়া ধরবে। দিনকরের জবাব ‘ছেলে! ছেলে কোথায় পাব, মেয়ে-ছাত্রী চাও তো দিতে পারি, ছেলেরা এ শহরে গান শেখে নাকি? তারা আজকাল তানপুরো তবলা ছেড়ে কমপিউটার ধরছে।

এইবার আমার শেষ বক্তব্যে পৌঁছেছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবাদ এক লম্ফে দশ যোজন পার করেছে। এর ফলে শুধু ভারতবর্ষে নয়, সর্বত্রই সায়েন্স ও টেকনোলজির প্রভুত্ব আমরা স্বীকার করে নিয়েছি। টেকনোলজির এক কথায় ডেফিনেশন Science applied to industry. অর্থাৎ মুনাফার জন্য যে শিল্প তার পেছনে যে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি তারই এখন জয়জয়কার।

যুক্তিযুক্তভাবে এর পরের ধাপই হচ্ছে অর্থকরী বিদ্যা না হলে বর্তমান সমাজে তার মূল্য নেই, না থাকারই কথা। হিউমান অ্যাক্টিভিটির ওপর যদি প্রচণ্ড চাপ পড়ে সায়েন্স ও টেকনোলজির তা হলে প্রথম শিকার হবে আর্টিস্টিক অ্যাক্টিভিটি। এটা শুধু আমাদের দেশের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়, এ Global phenomenon, সারা পৃথিবীতেই এ ঘটছে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিদেশে সাহিত্যে, দর্শনে, সঙ্গীতে (কমপোজার), ভাস্কর্যে, স্থাপত্যশিল্পে, বিভিন্ন চারুকলায় বিরাট ব্যক্তিত্ব কজন জন্মেছেন এ কড়ে আঙুলে গোনা যায়, যাদের ঊনবিংশ শতাব্দী এমনকি বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের অগুনতি মহারথীর সঙ্গে এক ক্ততে বসানোর প্রশ্নই ওঠে না। টেকনোলজি ও সায়েন্সেরও নিজস্ব বিরাট চাহিদা।

সে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রর জন্য প্রতিরক্ষার খরচা বাড়াচ্ছে দেশে দেশে, নিঃশত্রু মার্কিন দেশেরই ডিফেন্স বাজেট শুনি আড়াইশ বিলিয়ন ডলার। ছেলেপুলেদের বইয়ের পরিবর্তে ইডিয়ট বকস্ জোগাচ্ছে, কনজিউমারিজমের প্রচার করছে, ইনফ্লেশন ও পরিবেষণ দূষণ ঘটাচ্ছে এবং সবচেয়ে বড় কথা ফ্যামিলি ইউনিটকে দেশে-বিদেশে টুকরো টুকরো করে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মধ্যবিত্তের মূল্যবোধকে পাল্টে দিচ্ছে।

আর বর্তমান প্রজন্ম পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে টিভি মারফত এই ডিজেনারেট কালচারাল ইমপিরিয়ালিজমের শিকার হচ্ছে। দুর্নীতি, ভায়োলেন্স, সেক্স, কুৎসিত রুচির বিজ্ঞাপন ও মিউজিক যার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির কোনও সম্পর্ক নেই—এক কথায় নীরদ চৌধুরীর ভাষায় পৃথিবী জুড়ে ‘রিবার্বারাইজেশন’ বা আমাদের আজকালকার ভাষায় অপসংস্কৃতির বিশ্বায়ন হচ্ছে।

শুধু বড়লোকেরা নয়, মধ্যবিত্তরাও তাদের ঐতিহ্য ভুলে গেছে। এদের সন্তানেরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে, টিভির দৌলতে হয়ত রামায়ণ-মহাভারত খাপছা খাপছাভাবে দেখে থাকতে পারে, পড়েনি। পড়ার প্রশ্নই ওঠে না। এদের মধ্যে মাতৃভাষার চর্চা নেই, যে ইংরেজি বলে তা আমাদের কালে দো আঁশলা ট্যাশ ফিরিঙ্গি পরিবারের বাইরে শিক্ষিত ভদ্রসমাজে শুনলে কপালে পাদুকা প্রহার জুটত।

আমাদের কালোয়াতী সঙ্গীত এদের কাছে বিদঘুটে, আমাদের সামাজিক আচার-বিচার এদের কাছে হাস্যকর, আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য, সামাজিক ঐতিহ্য এক কথায় Composite Cultural Tradition-এর ছোঁয়াও এই মধ্যবিত্ত সমাজের বর্তমান প্রজন্মের গায়ে লাগেনি, লাগছে না। এরাই ভারতের ভবিষ্যৎ।

যদি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাবু কালচারের পেছনে সমাজতাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ ও ড. নীহাররঞ্জন রায় ‘স্পিউরিয়াস মিডল ক্লাস’ বা মেকি মধ্যবিত্ত সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করে থাকেন তো আজকের মধ্যবিত্ত সমাজ সম্পর্কে কী বলতেন জানি না। তাঁরা পুণ্যবান লোক ছিলেন, যথা সময়ে ভবিষ্যতের ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক আশা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন।

আর্নেস্ট হাউসার বেশ কিছুকাল আগে [১৯৫১] তাঁর Social History of Art নামক দু’খণ্ডের পুস্তকে দেখিয়েছেন কীভাবে সমাজের মূল্যবোধের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আর্টের চেহারা পাল্টে যায়। আমাদের বর্তমান সমাজের স্লোগান সরস্বতীকে ছেড়ে ‘ধর এইবার লক্ষ্মীর উপাসনা’। অতএব সঙ্গীত যদি অর্থকরী বিদ্যা হয় তো ভাল নচেৎ তাকে বিষবৎ পরিত্যাগ কর।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রজন্মের যে সব ছেলেমেয়ে লেখাপড়ায় সুবিধে করে উঠতে পারে না বা শৈশব থেকেই গানের দিকে ঝোঁকে, তাদের ভবিষ্যৎ ওই মেকি বি মিউজ, প্রভাকর, বিশারদ ও টুইশনি। এদের মধ্যে যাদের কিঞ্চিৎ প্রতিভা আছে, বছর পাঁচ-সাত শেখার পরই রেডিওর গ্রেডিং-এর জন্য এদের প্রাণ আনচান করে ওঠে, প্রোগ্রাম চায়, টিভিতে সুযোগ পাওয়ার জন্য জান দিতে পারে।

বিদ্যার্জনের প্রতি অনীহা, কোনও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার প্রতি বিমুখতা আমাদের বাপ-পিতামহর কালের কথা ছেড়ে দিচ্ছি আমাদের কালেও বাঙালির মধ্যে ছিল না। নাল্পে সুখম, ভূমাতেই সুখ এ রীতি শুধু অর্থ যশ নারী ও ভোগলিপ্সার রকম-বেরকমের খোরাকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বিদ্যার্জনের ব্যাপারে নয়! সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও শুধু প্রতিভার ওপর ভর করে এত অল্প পুঁজি নিয়ে সন্তুষ্ট সেকালের উঠতি গায়ক-বাদকরাও হতেন না, প্রতিষ্ঠিত আর্টিস্টদের কথা ছেড়েই দিচ্ছি।

অলমতি বিস্তরেণ। আমাদের মনে রাখা উচিত হিন্দুস্থানি সঙ্গীত তো প্রশান্ত মহাসাগরের আইল্যান্ড নয়, সে এই ভারতেরই, এই সমাজেরই অংশ। দুর্নীতি যে

সমাজের মূলনীতি—রাজনীতি থেকে আমলাতন্ত্র, ব্যবসায় থেকে শিক্ষা কেন্দ্র, এমনকি স্পোর্টসেও ইমান কেনা-বেচা হচ্ছে সে সমাজের কাছে এর চেয়ে পৃথক প্রত্যাশা অযৌক্তিক। এককালীন বোম্বাই প্রেসিডেন্সির গভর্নর, পরে এম সি সি-র বড়কর্তা Lord Harris ক্রিকেটকে the noblest of all games বলেছিলেন। এতে নাকি ইংরেজ বালকদের ইটন ও হ্যারোর মাঠে চরিত্র গঠিত হত। তাঁর উক্তি :

There is nothing mean or sordid about this game which teaches you to play nobly and selfsacrificingly and the class room is gods air & sunshine and the green fields of England.

বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাচ্ছি তিনি এখন কবরে ঘন ঘন পার্শ্বপরিবর্তন করছেন। উস্তাদ আলি আকবর খাঁ গত বছর এক সভায় বলেছিলেন : আমাদের সঙ্গীত entertainment নয়, এটি সাধনার মার্গ। তা সেই সাধনার মার্গ এখন ব্যবসায়ের পণ্য, আর সঙ্গীতের শিক্ষাদান নিম্নস্তরের বৈশ্যবৃত্তিতে পরিণত হয়েছে। গোটা সমাজের মূল্যবোধের যখন এই হাল তখন হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের ভবিষ্যতের মতন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বৃদ্ধ বয়সে চিন্তা করা শুধু বিলাসিতা নয়, দস্তুমত বেওকুফির পরিচয়।’

[ হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অবক্ষয় – কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment